ধরে নেই আমার বাবা আমাদের তিন ভাইবোনকে দশ টাকা করে হাতখরচ দেয়। আমাদের সবার সেই দশ টাকা দিয়ে টিফিন খাওয়ার কথা। এখন আমি গাধামী করে আমার দশ টাকা দিয়ে নিনজা হাতোড়ির স্টিকার কিনে ফেললাম। তাহলে আমার কাছে আর টিফিন খাওয়ার টাকা নাই। প্রথমে যখন আমি খাতার মাঝে হাতোড়ির স্টিকার লাগালাম তখন আমার খুব ভালো লাগলো কিন্তু একটু পরে ঠিকই খিদে পেয়ে গেলো। তখন আমার প্রথম উপায় হচ্ছে আমার দুই বড়বোন থেকে টাকা ধার করা। তারা হয়তো আমাকে তিনটাকা ধার দিয়ে বললো যে আর যাতে কখনও এরকম না হয় আর নিজে মেঝোবোনের কাছ থেকে একটাকা ধার করে নিজের সমস্যা কিছুটা সামাল দিলো। আমি শুনলাম কিন্তু পরের দিন আবার পকেমনের স্টিকার কিনে বসে থাকলাম। তখন আবার বোনের কাছে হাত পাতলাম-হয়তো বোনের আবার টাকা দিতে হতে পারে। আবার ধার করতে হতে পারে। কাজেই সামগ্রিক ভাবে আমাদের তিনভাইবোনের কিন্তু সত্যিকারের খাবার খাওয়াটা কমে যাবে কারণ আমাদের সবাই আমার একার গাধামীর জন্য একটু করে বিপদে পড়েছি। এই সমস্যাটা ঘটতে পারছে কারণ আমাদের সবার টাকা এক বাবার কাছেই আসে। এখন যদি আমরা তিনজন আলাদা আলাদা আয়ের উৎস থেকে টাকা আনতাম তাহলে আমার গাধামীর জন্যে আমিই না খেয়ে থাকতাম বা চড়া সুদে অন্যের টাকা থেকে ধার নিতাম। আমার গাধামির জন্যে অন্যের নিজস্ব টাকায় টান পড়তো না।
ইউরোপের ক্ষেত্রে আমি হলাম গ্রীস আর আমার বড়বোন হলো জার্মানী আর আমাদের তিনভাইবোনের ছোট দলটাকে ধরে নিলাম ইউরোপিয় ইউনিয়ন। এখন একই যেহেতু ইউরো তাই অনেকে এই ছোট অদূরদর্শী রাষ্ট্রগুলোর জন্যে নিজেদের মুদ্রাকে বিপদে ফেলতে চায়না কেননা অনিয়ন্ত্রিত বাজেটের ফলে যখন ছোট দেশগুলো ক্ষমতার লোভে বড় বড় ঘাটতি বাজেট বানায় তখন মুদ্রামানের যে স্বাভাবিক তারতম্য হয় সেটার জন্য পুরো ইউরোপকেই বিপদে পড়তে হয়-কারণ মুদ্রা তো সেই একটাই। এটাকেই বলা হচ্ছে ইউরোজোন ক্রাইসিস আর এখান থেকে ব্রিটেনের ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাবার একটা সত্যিকার শক্তিশালী যুক্তি আসতে পারত যেটার উত্তরে ইউরোর বাজে আইডিয়া থেকে বের হয়ে আসলেই হতো।
এই একক মুদ্রার ব্যাপার বাদ দিলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি চমৎকার আইডিয়া। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থাকার মানে হলো এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা যেটাতে একটা বড় দেশের সব সুবিধা পাওয়া যায় কিন্তু বড় দেশের কোন অসুবিধা ভোগ করতে না হয়। বড় দেশের সুবিধা কি? একটা বিরাট ভূখন্ডের মাঝে বিরাট একটা ক্রেতাগোষ্ঠীর সামনে চমৎকারভাবে ব্যবসা করা যায় আর একটা শক্তিশালী কূটনৈতিক স্বত্তা হিসেবে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সহজ হয়। অনেকেই এটা শুনেছে যে ইউরোপে গেলে ভিসা ছাড়া অনেক দেশে ঘোরা যায়। একই ভাবে অনেক দেশে ইচ্ছামতন ব্যবসাও করা যায়-মানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে জিনিস বেচতে গেলে সরকারের কাছে যে ট্যাক্স দিতে হয়-ইউরোপে সেটা দেয়া লাগেনা। কাজেই একটা বিরাট এলাকা জুড়ে সহজেই শক্তিশালী অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। সেটার সুবিধা হলো এই যে-যখন একটা নির্দিষ্ট দেশের অন্য কোন দেশে আর্থিক বিনিয়োগ থাকে-সে নিজের আগ্রহে সেই দেশের শান্তি রক্ষা করার চেষ্টা করবে। সেটার জন্য এথিকস ফিলসফিতে যেতে হবেনা, সহজ সাধারণ আর্থিক ক্ষতির ভয়ে অটোমেটিক শান্তি রক্ষিত হবে। এই সুবিধাগুলোর কারনে এতোদিন ধরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন টিকে রয়েছে আর ইউরোপে শান্তি বজায়ে আছে। ইউরোটা তুলে দিলেই আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটু কমাতে চেষ্টা করলে হয়তো ইইউএর প্রধান সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা যেতো।
এটা ঠিক যে ইউরোপিয় ইউনয়নের বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে আর আমি ভেবেছিলাম সেই ঘাটতির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ব্রেক্সিটের যুক্তির উত্থান। কিন্তু দূ;খের ব্যাপার হলো ব্রেক্সিট-বা বৃটেনের ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাবার প্রস্তাবের পক্ষে প্রধান যুক্তি এই যৌক্তিক স্থান থেকে না এসে অতিডান অযৌক্তিক একটি জায়গা থেকে এসেছে। সারা বিশ্ব যে অসহিষ্ণুতার বাতাস বইছে-সেই বাতাস যুক্তরাজ্যেও পৌছেছে আর সেখানে উত্থান হয়েছে অতিডান রাজনৈতিক শক্তির। এদের ধারণা 'বাইরের দেশের' মানুষ তাদের দেশে এসে তাদের চাকরিবাকরি কেড়ে নিচ্ছে। সেই হাজার বছর পুরোনো হিটলার-ট্রাম্পের অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো ভাঙ্গা ক্যাসেট। ভয়ংকর ব্যাপার হলো এই যে এই ভাঙ্গা ক্যাসেট আজকাল পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গায় কাজে দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা আর সন্ত্রাস ভয়ের রাজনীতির একটা পাকপোক্ত জমিন সৃষ্টি করে দিয়েছে। ভারতে অতিডান বিজেপি ক্ষমতায় আসীন, রাশিয়ায় পুতিন, বৃটেনে উত্থান হলো অতিডান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টির আর আমেরিকায় উত্থান ঘটছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের। যে গণভোটের ফলাফল দেখে আমরা এতো শংকা বোধ করছি সেই গণভোটে কম শিক্ষিত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর জয় হয়েছে। ইংল্যান্ডে বাহান্ন শতাংশ মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাবার পক্ষে ভোট দিয়েছে আর এই ফলাফলের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করেছেন। গণভোটের ফলাফলের পরপরি পাউন্ড স্টার্লিংয়ের দাম ভয়াবহভাবে কমে গেছে, ভয়াবহভাবে ধসেছে যুক্তরাজ্যের স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক। এরই মাঝে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি থেকে যতো টাকা হারিয়ে গেছে সেটা ফিরিয়ে আনতে আরো কয়েক দশক লেগে যেতে পারে।
যুক্তরাজ্য আর ইংল্যান্ড যে একই ব্যাপার না সেটা আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। আদতে যুক্তরাজ্য হলো ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড আর উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটা সোয়া ফেডারল রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের ইংল্যান্ড ইইউ ছাড়বার পক্ষে দাড়িয়েছে ঠিকই কিন্তু স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ড চাইছে ইইউ তে থাকতে। এই অবস্থায় স্কটল্যান্ডের আবার কিছুদিন আগে বাতিল হওয়া স্বাধীনতার গণভোট পুনরায়োজনের উপক্রম করবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে লন্ডনের মেয়রকে বলছেন লন্ডনকে স্বাধীন ঘোষণা করে ইউরোপিয়ন ইউনিয়নে থেকে যাও। লন্ডন তো থাকবার পক্ষে ভোট দিয়েছে। মোটকথা ইউরোপে একটা বিতিকিচ্ছু অবস্থা লেগে গেছে এর মাঝেই।
এতে যে ঝামেলাটা হবে সত্যিকারের অর্থনীতিতে সেটা হলো যেসব করপোরেশন এতোদিন ইইউ এর মাঝে থেকে আরামসে ব্যবসা করে আসছিলো তাদের এখন বেশি ট্যাক্স গুনতে হবে আর অনেকের হয়তো ব্যবসার সুবিধার্থে বৃটেন থেকে অফিস সরিয়ে আনতে হবে। কাজেই অনেকে চাকরি হারাবে। যখন চাকরিজীবি চাকরি হারায় ব্যবসাও ক্রেতা হারায়। কাজেই অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হবার একটা চমৎকার মঞ্চ সৃষ্টি হয়। যেহেতু আজকের দুনিয়ার কোন বড় প্রতিষ্ঠানই একদেশে সীমিত নয়-এই মন্দার হাওয়া একদেশে থাকবে না, ডমিনো ইফেক্টের মতন করে ছড়াতে থাকবে। এইদেশে ব্যবসার মন্দা হলে সেই মন্দা অন্য দেশে হেডকোয়ার্টার ওয়ালা কম্পানিরও ক্রেতার অভাবে ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। আর যতো ইকনমি অস্থিতিশীল হবে-রাজনীতি অস্থিতিশীল হবে আরো বেশি। কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে দেখলাম ভয় পেতে পেতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয় পেয়ে বসে আছেন।
তবে আশার ব্যাপার হলো যে এই ব্যাপারটা হতে পারে সেটা অনেকে ধারণা করেছিলেন আর সেটা যাতে আন্তর্জাতিক না হয় সেরকম ব্যবস্থাপনাও নিয়ে রেখেছেন। যেমন আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ এর মাঝেই ইন্টারেস্ট রেট কমিয়ে এনে শক এবসর্ব করার ক্ষমতা তৈরি করে রেখেছে। যদিও এরকম কিছু সেফটি নেট রাখা হয়েছিলো-তবু সত্যিকারে কেউ বিশ্বাস করেনি যে এরকম কিছু হতে পারে। আগামী কয়েকদিন পৃথিবীর ইতিহাসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রেট বৃটেন আর গ্রেট নাও থাকতে পারে-তিন চার টুকরো হয়ে যেতে পারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে অন্য দেশগুলোও ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা শুরু হতে পারে। অথবা কোন একটি প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করবার পদক্ষেপ শুরু হতে পারে। যা-ই হোক, বিশ্বের সচেতন বাসিন্দা হিসেবে আমাদের চোখ কান খোলা রাখতে হবে আর লক্ষ্য রাখতে হবে। পৃথিবীর ভবিষ্যত হয়তো নতুন কোনদিকে মোড় নিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৬ রাত ১০:৪২