একবার আমার এক আত্মীয় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা-উপল, তুমি তো জিপিএ ফাইভ পাইসো, তাইলে আমার একটা সায়েন্সের প্রশ্নের উত্তর দাও দেখি?
আমি আত্মীয়দের সাথে খুব ভালো খাতির করে উঠতে পারিনা, তাই শুকনো হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করলাম।
চেষ্টা সফল হলোনা-আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে আত্মীয় প্রশ্নটা করেই ফেললেন-বলোতো-যদি নিউটন মহাকর্ষ বল বের করতে না পারতো তাহলে আমাদের প্রথম কোন সমস্যাটা হতো? আমি বললাম, সম্ভবত আমরা মহাকাশে পাঠানোর জন্য রকেটের গতিবেগ টতিবেগ করতে পারতাম না। আত্মীয় খুব খুশি হয়ে গেলেন-আমি ভুল উত্তর দিয়েছি। সে একান ওকান হাসি দিয়ে বললো-আরে পাগল! মহাকাশে যাওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যে তুমি হাগু করো, সেই হাগুই তো শরীর থেকে বের হয় মহাকর্ষের জন্য। হা! হা! হা! হা! হা!
জিপিএ পাঁচ পাওয়া ছাত্রকে হেনস্থা করে তিনি প্রচন্ড আনন্দিত। আমি এখনও ভেবে বের করতে পারিনা যে নিউটন মহাকর্ষ বল সংক্রান্ত সূত্র বের না করতে পারলে আমাদের হাগু কেনো বের হবে না? নিউটনের আগে কি মানুষ হাগু করতো না নাকি? একটা নির্দিষ্ট প্রজন্মের কিছু মানুষ আমাদের প্রজন্মের মানুষের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে হাসাহাসি করে মজা পায়। নিজেকে অন্যের থেকে বুদ্ধিমান মনে করবার জন্য মানুষ হাজার হাজার প্রক্রিয়া বের করেছে-পরীক্ষা যার মাঝে অন্যতম। সেই পরীক্ষা থেকেও যারা নিজেদের মান সম্মান বাঁচিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছে-তাদের হেনস্থা করতে পারলে তো আরও ভালো। কেউ পাবে আর কেউ পাবেনা-তা হবেনা তা হবেনা।
ইদানিং একই রকম হেনস্থা মার্কা একটা ভিডিও প্রচুর পরিমাণে চোখে পড়ছে, সেটা হলো এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়া কিছু ছেলেমেয়ের টেলিভিশনে নেয়া সাক্ষাৎকার। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় নেপালের রাজধানী কি? তারা বলে নেপচুন!
এরকম অনেক ভিডিও এর আগেও আমি দেখেছি-যেখানে জিমি কিমেল বা এরকম কোন টক শো হোস্ট আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় গিয়ে আমেরিকানদের জিজ্ঞেস করে, বলেন তো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নাম কি? তারা বলে আব্রাহাম লিংকন। দর্শক হো হো করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। এই জিনিসগুলো দেখে আমাদের আত্মতৃপ্তি হয়-মনে হয়, হায়রে আমিতো জানি যে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নাম বারাক ওবামা, অতএব এভারেজ আমেরিকানের চেয়ে আমি অনেক বুদ্ধিমান। হো হা হা হা!
অনেক পুরোনো একটা টিআরপি ফাঁদ-সেটারই পুনঃমঞ্চায়ন আমরা দেখলাম বাংলাভাষার টেলিভিশনের স্ত্রিনে। ব্যাপারটা হয়তো পাতানো, হয়তো ছেলেপেলেগুলোকে আগে থেকেই বলে দেয়া হয়েছিলো যে তোমরা এরকম ভুলভাল উত্তর দেবে-কিন্তু তবু আমি এই টিভি রিপোর্টকে সাধুবাদ জানাই, কারণ এই প্রথম আমি দেখতে পেলাম যে বাংলাদেশের একটা বড় অংশ মিলে শিক্ষাব্যবস্থার ভুলত্রুটি নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে, সেটাতে তাদের নিজেদের লেজে আগুন থাকুক আর না থাকুক। বাংলাদেশে শিক্ষা সংক্রান্ত যেকোন আন্দোলনের সমস্যা হয়ে যায় এইটাই, যার যখন লেজে আগুন লাগে, সে তখন সেটা নিয়ে লাফায়-বাকিরা কেউ খুব একটা গা করে না। আবার যখন আগুন নিভে যায়-তখন আর কেউ গভীরের সমস্যাটার কথা বলতে চায়না, আগুনহীন লেজ নিয়ে তারা দারুণ আনন্দে দিনাতিপাত করে। সকলে যে একে একে মানুষ থেকে লেজওয়ালা হনুমান হয়ে যাচ্ছে-সেই লেজ নিয়ে তাদের আর কোন মাথাব্যথা থাকেনা।
এইবার সবার লেজে একসাথে আগুন লেগেছে-যারা জিপিএ পাঁচ পায়নি, তারা প্রমাণ করতে নেমেছে যে জিপিএ পাঁচ কতো বাজে একটা মেধা নির্ণায়ক আর যারা পেয়েছে তারা বলতে নেমেছে যে এই সাংবাদিক কতো বড় হলুদ সাংবাদিক আর যে ছেলেপেলেগুলোর সাথে কথা বলা হয়েছে তারা কতোবড় বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কমপক্ষে সবাই মিলে আমাদের শিক্ষা নিয়ে আরেকবার ভাবতে বসেছেন-যে শিক্ষাযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমরা বারো বছর, ষোল বছর পার করি-সেটা নিয়ে কথা বলতে বসেছে।
একের পর এক সরকারী পরীক্ষা আর আধাসরকারী ভর্তিপরীক্ষার পাশা খেলে খেলে আমরা বড় হই আর সবাই মিলে অপেক্ষা করি সরকারী নিয়োগের মহাপাশাখেলার জন্য। প্রত্যেক বারে বারে আমরা দোয়া করে যাই যাতে এইবারে ডাবল ছক্কার দান ওঠে আর আমরা পরের ধাপে উতরে যাই। প্রতি ধাপে ধাপে পুনরায় ডাবল ছক্কা ওঠবার সম্ভাবনা ছোট হতে থাকে আর যারা উতরে যায় তাদের নিজেদেরকে অন্যদের থেকে বড় কিছু একটা মনে করবার আরো একটা উপায় সৃষ্টি হয়। যেই কেউ একধাপ উতরে যায়-তার চোখে আর পাশাখেলাটাকে ভুল বলে মনে হয়না। আর যারা ততোটা ভাগ্যবান নয়-তারা তো নষ্ট হয়ে যাওয়া ব্যর্থ ছেলেপেলে-তাদের কথা আর কে শোনে?
কাজেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় জন্য দেশ অধঃপাতে যাচ্ছে-এই কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। অবশ্যই একটা সরকার এমনভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তোলবার চেষ্টা করবে যাতে করে গণহারে উন্নতমানের চাকুরে গড়ে তোলা যায়। আর উন্নতমানের চাকুরের যোগ্যতা হলো মাথা গুঁজে যত বেশি সম্ভব তত বেশি উপরঅলার ঝাড়ি খেয়ে যাওয়া আর যা করতে বলা হয় মুখ বুঁজে তাই করে যাওয়া। সেইটুকু উৎপাদন করতে আমাদের শিক্ষা ‘ব্যবস্থা’ যথেষ্ট সফল। সরকারী শিক্ষাব্যবস্থা কাজ করবে যাতে করে শিক্ষাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যাতে করে সহজ জিপিএ-র সহজ হিসাব দিয়ে সফলতা দেখিয়ে লম্ফঝম্প দেয়া যায়, যাতে করে শিক্ষার মাধ্যমে একটা মনোলিথিক একজাতীয় জনগণ তৈরি করা যায় যাদের ভেতর থেকে কোন বিপ্লবের বিপ বিপ বের না হয়। সেইটুকু করতে অবশ্যই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ভালো কাজ করে যাচ্ছে। কোন দুঃখে সরকার বুদ্ধিমান আর উদ্ভাবনী ছাত্রছাত্রী বানাতে যাবে? গঠনমূলক সমালোচনা শোনবার জন্যে?
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যতটা সমস্যা তারচেয়ে বেশি আমাদের সমস্যাটা হলো আমাদের শিক্ষাগত দর্শনে, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে। যেই সংস্কৃতি উঠতে বসতে দিনে তিনবার সরকারকে গালি দেয় আবার কোন একটা সমস্যা হলেই সরকারের পানে তাকিয়ে বসে থাকে। যেই সংস্কৃতি কোন একটা অদ্ভুত কারনে বিশ্বাস করে যে উপরে কোন একজন আছেন মহান জ্ঞানী ব্যক্তি-যাবতীয় সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন, আর তার কথামতো আমরা চলবো আর কোন ভুলত্রুটি যদি হয় তাহলে আবার সরকারকে গালাগাল করে হা হুতাশ করে ক্ষান্ত হবো। আমাদের কোন দোষত্রুটি নাই।
ব্যপারটা ঠিক কিভাবে গড়ে উঠেছে আমি জানিনা। হতে পারে দশকের পর দশক মিলিটারি শাসনের নিচে থেকে, হতে পারে বছরের পর বছর একের পর এক আন্দোলন ব্যর্থ হতে দেখে-হতে পারে মাসের পর মাস প্রতিবাদকারীদের, ভিন্নমতের অধিকারীদের মৃত্যুর খবর দেখে দেখে। আমরা মাথা নিচু করা একটা জাতি হয়ে যাচ্ছি। আমরা ভুলে গেছি যে পরিবর্তন কখনো উপরের থেকে আসেনা, পরিবর্তন সবসময় গোড়া থেকে আসে। সরকার মানুষের জীবনযাত্রা নির্ধারণ করবার কেউ নয়-মানুষের মতামতের উপর সরকার টিকে থাকে।
কাজেই যখনই আমরা এরকম কোন একটা ভিডিও দেখি আমরা হায়রে নাহিদ সাহেবের এ প্লাস, দেশটা গাঙ্গের জলে ভেসে গেলো, শিক্ষাবিদেরা কি আঙ্গুল চোষে, নীতিনির্ধারকেরা কোথায়-হ্যানো ত্যানো বলে চিৎকার চেঁচামেচি করি, আমাদের চোখের আড়ালে আমাদের পিঠের একটু নিচে লেজটা আরেকটু লম্বা হয়। আমাদের সেই লেজগুলো একত্র করে আমাদের চোখের আড়ালে কেউ গিঁট বাঁধে, আর সেই গিঁট ধরে আমাদেরকে এদিকে ওদিকে নাড়ায়-এদিকে ওদিকে পাঠায়। আমাদের জীবনকে দাবার গুঁটির মতন ব্যবহার করে।
আমি জানিনা কে আমাদের বলে দিয়েছে যে আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর একক দায়িত্বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব মোটেই সেটা নয়। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছেঃ
Ministry of Education is the apex policy making institution of the Government regarding administration and development of post-primary education sector.
দেয়ার! শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো দেশের প্রাথমিক উত্তর শিক্ষার যে প্রশাসন আর উন্নয়ন খাত রয়েছে সেটার তদারক করার। সেটার ব্যপার হতে পারে তহবিল বৃদ্ধি, তহবিলের কার্যকর বন্টন, শিক্ষার কাঠামো তৈরী করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এর সবকিছুই আমলাতান্ত্রিক হাবিজাবির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবার কথা-যেটার সাথে একজন ব্যক্তিগত শিক্ষকের ব্যক্তিগত ক্লাসরুমের কারিকুলাম সাজানোর কোন সম্পর্ক নেই।
এর মাঝেই যে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একধাপ এগিয়ে গিয়ে চারটা পাবলিক পরীক্ষা নেয়-সেইটাই আসলে মন্ত্রণালয়ের কাজের চেয়ে বেশি আর অপ্রয়োজনে পয়সা নষ্ট করা বলে আমার মনে হয়। তবে আমাদের মতন একটা উন্নয়নশীল দেশে এই পাবলিক পরীক্ষাগুলোর দরকার হয় এইজন্য যে-যাতে করে মনিটর করা যায় যে দেশের সব জায়গায় একই রকম শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে কিনা। যে স্কুলে এসএসসিতে জাতীয় গড়ের চেয়ে খারাপ ফলাফল হচ্ছে-সেখানে কোন একটা ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি আছে-যেটাকে ঠিক করা দরকার, এই ধরণের ডায়গনসিস করবার জন্য সরকারী পরীক্ষা। একটা সরকারী পরীক্ষা দিয়ে ছেলেপুলের মেধা যাচাই করে ফেলা যায় এতোটা ঐশ্বরিক সম্ভবত শিক্ষাবোর্ডও নিজের পরীক্ষাকে মনে করেনা।
মান নিশ্চিত করার এই পরীক্ষাটিকে যে ঐশ্বরিক পর্যায়ে আমরা তুলেছি যে এইখানে গোল্ডেন পেলে সে জাতের আর গোল্ডেন না পেলে সে অজাত-কুজাত, সেটা তো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন নির্দেশনা না। সেইটা আমরা স্বেচ্ছায় করেছি। পাবলিক পরীক্ষায় গোল্ডেন যদি এতই গুরুত্বহীন হয়-তাহলে আমরা সেটাকে গুরুত্ব দেই কেন? দুনিয়ার সবাইকে কেন আমরা পরীক্ষার পরে গোল্ডেন, গোল্ডেন করে মাথা খারাপ করে ফেলি?
কারণটা খুব সরল। কারণটা হলো, আমরা খুব অলস প্রকৃতির মানুষ। একটা ছেলেকে বা একটা মেয়েকে তার ভেতরের যে মেধা বা প্রজ্ঞা-সেটাকে খুঁজে বের করে তাকে উৎসাহিত করতে যে ধৈর্য্য লাগে, সেই ধৈর্য্যটা আমাদের নেই। আমরা খুব সহজ কোন প্রক্রিয়ায় আমাদের ছেলেপেলেদের বিচার করে ফেলতে চাই। গোল্ডেন পাইসো? বা অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইসো মার্কা হ্যা না উত্তরে সেটা করে ফেলা খুব সহজ, তাই আমরা সেটাই করে ফেলতে চাই। এই একই আলস্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন বিষয়ে আমরা পাশ করে সেই বিষয়ের চাকরি নাই চাকরি নাই করে মাথা ফাটায়ে ফেলি-চাকরি তৈরি করার চেষ্টা করিনা। লো রিস্ক, হাই গেইন মার্কা সরকারী চাকরি খুঁজে চাকরি পাবার প্রক্রিয়ায় খরচ হওয়া ঘুষের টাকা সুদে আসলে উঠিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি।
আমি ভার্জিনিয়ায় থাকি-এখানের অনেক ছেলেমেয়েকে পড়াই। ইদানিং তারা একটা পরীক্ষা নিয়ে খুব বেশি করে প্রাকটিস করছে-সেটা হলো এসওল-স্ট্যান্ডার্ড অফ লার্নিং। ভার্জিনিয়ার শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রতিবছর এই পরীক্ষাটি নেয়া হয়, এই ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখবার জন্য-যে সব স্কুলে একই শিক্ষার মান বজায় আছে কিনা। যারা হাইস্কুলে এলজেব্রা ওয়ান বা টু নিয়েছে-তাদের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষাটার নাম এন্ড অফ কোর্স-তারমানে, এই নির্দিষ্ট বিষয়টিতে যথেষ্ট জ্ঞান নিয়ে শিক্ষার্থীটি পরের ধাপে উঠবার সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে কিনা সেটা বের করার জন্য একটা পরীক্ষা। আমার এক ছাত্রীর নাম আরিয়ানা। আরিয়ানা প্রথম এক ঘন্টায় এসওএল এর জন্য পড়ে বললো-আচ্ছা, আমার না ফিজিক্স ক্লাসের জন্য একটা রিসার্চ পেপার লিখতে হবে-একটা ছোট এক্সপেরিমেন্টের মতন করতে হবে। আমি চিন্তা করেছি হাইড্রোইলেক্ট্রিসিটি নিয়ে কাজ করবো-কিন্তু ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর ডিপেন্ডেন্ট ভেরিয়েবল কি হবে-সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। ক্যান ইউ হেল্প মি উইথ দ্যাট?
এই ছোট্ট গল্পটা বললাম এইজন্যে যে আমার চোখে ভার্জিনিয়ার এন্ড অফ কোর্স আর বাংলাদেশের সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট খুব একটা আলাদা কোন ব্যপার নয়। সরকারি একটা শিক্ষার মান নির্নয়ের পরীক্ষা-যেটাতে খুব সাধারণ মানের প্রশ্ন হয়, যাতে করে শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে পরের পর্যায়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে কিনা সেটা যাচাই করা যায়। এখানের ছাত্রছাত্রীরা সেটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়না-কোনমতে পাশ করে যেতে পারলেই খুশি-পরের ক্লাসে উঠতে পারবে!
এরা গুরুত্ব দেয় এসএসটি নামের একটা পরীক্ষাকে যেই পরীক্ষার স্কোরকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে দেখে। এই পরীক্ষাটি কিন্তু একটা বেসরকারি পরীক্ষা। আর যখনই এই দেশের মানুষ বোঝা শুরু করলো যে এসএটি পরীক্ষারও কিছু কিছু সমস্যা আছে-তখন তারা আরেকটা বেসরকারী পরীক্ষা বেছে নেয়া শুরু করলো, যেটার নাম এসিটি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এইসব পরীক্ষার স্কোরের বাইরেও স্কুলের গ্রেড দেখে, এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি দেখে, এডমিশন এসে দেখে, রিসার্চ এক্সপেরিয়েন্স, জব এক্সপেরিয়েন্স দেখে, সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।
আমি ভাবতে চাই যে বাংলাদেশের যেইসব শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করা মানুষজন-তারা মিলে এমন কিছু বেসরকারী মেধা যাচাইয়ের মাধ্যম উদ্ভাবণ করবে যেগুলো সরকারী শিক্ষার মনোপলিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে-যেগুলো ব্যবহার করে খুব দ্রুত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতন হোলিস্টিক এডমিশন সিস্টেমের দিকে এগিয়ে যাবে আর আমাদের এসএসসি এইচএসসি-ভর্তি পরীক্ষা বলে মাথা কুটতে হবে না।একাধিক মেধা যাচাইয়ের উপায়ের মধ্য থেকে র্যাশনাল এক্টরেরা সবচেয়ে চমৎকার মাধ্যমটি বেছে নিতে পারবে আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সেটা দেখে ছাত্র বাছাই করতে পারবে।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এক পিস সরকারি পরীক্ষা দেখে ফর্ম বিক্রি করে-আরেক পিস ইররিপ্লেসেবল পরীক্ষা দিয়ে ছাত্রত্ব দেয়। পরীক্ষার বাইরে কোনকিছু দেখবার মতন ধৈর্য তারা করে উঠতে পারেনা-আর পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রেও ছাত্রছাত্রীদের কয়েকটি অপশন দিয়ে উঠতে পারেনা। যখন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এরকম এক পরীক্ষা-এক রেজাল্ট নির্ভর ব্যবস্থায় বেঁচে থাকবে-তখন তো গোড়ায় সমস্যা লেগেই থাকবে।
আমেরিকার স্কুলগুলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি, বেসরকারি কোন পরীক্ষারই বিশেষ ধার ধারেনা। তারা তাদের মতন করে আলাদা করে কারিকুলাম বানায়। তারা ক্লাসে কি পড়াবে না পড়াবে-সেটা পুরোপুরি তাদের নিজেদের উপর। আমার ছাত্রীর ফিজিক্স টিচার চায় এসওএল এর বাইরেও তার ছাত্রীরা একটা করে রিসার্চ পেপার লিখুক। তাদের সরকারী পরীক্ষার সাথে যেটার কোন আগামাথা মিল নেই। তার ছাত্রছাত্রীদের ইনোভেশন আর সায়েন্টিফিক এনকোয়ারি উদ্বুদ্ধ করবার জন্য তিনি এই কাজটা করলেন। আমেরিকার অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষকেরাই এরকম করে সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন প্রজেক্ট, ফিল্ড ট্রিপ, রিসার্চ-ইত্যাদি দিয়ে গুছিয়ে ছেলেপেলেদের ক্লাসগুলোকে সাজায়। তার ফলে যেটা হয়-সেটা হলো, ছেলেপেলেরা নিজেদের থেকেই বুঝে ফেলে যে একটা সরকারি পরীক্ষার চেয়ে কোনকিছু একটাকে ভালোমতন জানা আর সেই জানাটাকে একটা বাস্তবিক রূপ দেয়াটা কতটা আনন্দদায়ক।
আমরা কেনো সেরকম কিছু একটা করতে পারিনা? কেনো আমাদের ক্লাস এইটের একটা বাচ্চা জেএসসি দিয়ে পাশ করে ওঠার আগেই তাকে আমরা এসএসসির জন্য প্রস্তুত করা শুরু করে দেই? কেনো আমাদের সব অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা একেবারে হুবুহু এসএসসি মডেলে তৈরি করা হয়? এমন কোন বাঁধাধরা নিয়ম কি স্কুলগুলোতে করে দেয়া আছে-নাকি আমরাই বেশি অলস বলে আমরা অন্য কোনভাবে ভাবতে শিখিনাই? শিক্ষকের কি পারেন না-সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নিতে যে না তারা শুধু পরীক্ষা না-আরো অনেক কিছু দিয়ে মিলিয়ে এইবার শিক্ষার্থীদের মান নির্ণয় করবেন?
আমি অনেক এমন চিন্তিত মানুষকে দেখেছি যারা কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য নিয়ে চিন্তা করতে করতে মাথায় ভাঁজ ফেলে দিচ্ছে। আমি যখন বলি যে কোচিং সেন্টার নিয়ে আপনাদের এতো সমস্যা কি? কিছু উদ্যোগী তরুণ নিজেরা কিছু গড়ে খেতে পারছে-খারাপ কি? তখন তারা বলে-কোচিং সেন্টারের জন্য নাকি ছেলেপেলেরা স্কুলে যায়না, তাই তারা চিন্তিত। আরে ভাই! আমাদের স্কুলগুলোই যদি কোচিং সেন্টার হয়ে যায় আর একেকটা সরকারি পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছেলেপেলেকে প্রস্তুত করার জন্য কোমর বেঁধে নামে-তাহলে তো তাদেরকে কোচিং সেন্টারের সাথে প্রতিযোগিতা করতেই হবে। একই প্রোডাক্ট বিক্রি করবেন-আর একুই মার্কেটে কম্পিটিশন করবেন না, তাই কি হয়? যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর দীক্ষা প্রতিষ্ঠানের তফাৎ আমরা না বুঝি-আমাদের সব স্কুল পরাজিত কোচিং সেন্টার হয়ে যেতে বাধ্য।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো জাতির সন্তানদের জীবনের জন্য প্রস্তুত করা-মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তাদের অন্তরীন উদ্ভাবনি শক্তির বিকাশ ঘটানো। কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষা কেমন করে পাশ করতে হবে-সেটার জন্য দীক্ষা দেয়া না! আমাদের কয়জন শিক্ষার্থী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে স্কুলে গিয়ে তারা যেটা শেখে-সেটা কোচিংয়ে গিয়ে তারা পায়না?
আমি জানি আমাদের অনেক অনেক মেধাবী আর উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন শিক্ষক রয়েছেন যারা চাইলেই এরকম কিছু একটা করতে পারেন যেটা দিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতির বাইরে গিয়ে জীবনের জন্য ছাত্রছাত্রীকে প্রস্তুত করতে পারা যায়। তাহলে তারাই কিন্তু আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থাটাকে বদলে দিতে পারেন। শুধু তাদের শিক্ষাগত দর্শনটা নিয়ে আরেকবার ভাবতে হবে। তারা কি পড়াচ্ছেন ছাঁচেগড়া চাকুরিজীবি বানানোর জন্য নাকি তারা চান কিছু কিছু গবেষক আর উদ্যোক্তা বের হয়ে আসুক-যারা কিনা বাংলাদেশের সবার জীবনের মান একসাথে ভালো করে তোলবার মতন কিছু একটা করে ফেলতে পারবে?
সেই নিউজ রিপোর্টটি সাজানো হোক আর না সাজানো হোক-সেটাতে ছেলেমেয়েগুলোর চোখেমুখে যে ভয়, সেটা কিন্তু সাজানো নয়। সবার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবার ভয়-হাত পা শক্ত হয়ে যাওয়া-ঘাম বের হওয়া, এগুলো সত্যি। এগুলো আমি আমার সহপাঠীদের মাঝে, আমার জুনিয়রদের মাঝে দেখেছি। মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলতে ভয় পাই। নিজের মতটা তুলে ধরতে ভয় পাই। এই মানুষগুলোর অনেকে এসএসসি পাশ, এইচএসসি পাশ এমনকি অনার্স মাস্টার্স পাশ। বারো বছর-ষোল বছরের শিক্ষা এদের মুখে কথা ফুটিয়ে তুলতে পারেনাই। এরা গণতন্ত্রে অংশ কেমন করে নেবে? এরা নিজেদের চাহিদা কিভাবে করে ফুটিয়ে তুলবে? কিভাবে করে এরা গবেষণা পত্র লিখবে? গবেষণাপত্রের শেষে তো মুখস্ত কথা-কনভে মাই বেস্ট রিগার্ডস টু ইওর প্যারেন্টস এন্ড লাভ টু ইয়ংগারস লিখে দিলে হয়না-নিজস্ব নতুন কোন উদ্ভাবণ তুলে ধরতে হয়। যে ছেলেপেলেগুলো ষোলবছর ধরে ছাঁচে ছাঁচে বেড়ে উঠেছে-তারা ছাঁচের বাইরে গিয়ে কেমন করে ভাববে?
এই সমস্যাগুলোকে সমাধান করা আসলে তেমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। আরো গোড়ায় চলে যেতে হবে। যে সমস্যার যত গোড়ায় যাওয়া যাবে-সেই সমস্যা সমাধান করা হবে ততই সহজ। আমাদের মাঝে যেইসব শিক্ষার্থীরা এই ভিডিওটি শেয়ার দিচ্ছি আর দেশের শিক্ষা নিয়ে হা হুতাশ করছি-আসলে তারাই চাইলে দেশের শিক্ষার উন্নতি করে ফেলতে পারি। হ্যা, হয়তো সকল শিক্ষকের কাছে কাছে পৌছে তাদের উদ্ভাবনি কারিকুলাম বানিয়ে নিতে বলা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে কিন্তু আমি জানি আমার লেখাগুলো অনেক অনেক তীব্র কিছু কিশোর কিশোরী পড়ে। তোমরা চাইলে সবকিছু বদলে দিতে পারো।
জার্মানিতে একসময় একটা ছাত্র সংগঠন ছিলো উনিশ শতকের দিকে। নাম ছিলো বুরশেনশাফট। তোমার আমার মতন ছাত্ররা একত্রে এসে গল্প করতো, আড্ডা দিতো আর নিজেরা নিজেরা প্রাতিষ্ঠানিক আর অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা করতো। একসময় দেখা গেলো জার্মানির রিইউনিফিকেশনে এরাই সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকায় উঠে দাঁড়িয়েছে। অতোদূরে না যাই-আমাদের বাংলাদেশের একাত্তর পুর্ববর্তী ডাকসু-সাধারণ ছাত্রদের একসাথে এসে সমাজ নিয়ে কথা বলা। নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তিকে বিকশিত করা-একে অন্যের। এরচেয়ে সুন্দর শিক্ষার ভিত্তি কি হতে পারে?
তোমরা যারা আমার লেখা পড়ো-তোমাদের স্কুলে ডিবেট ক্লাব আছে তো? আর্ট ক্লাব আছে? ডান্স ক্লাব আছে? ক্রিকেট ক্লাব আছে? ফুটবল ক্লাব আছে? থাকলে যোগ দাও। আরো মানুষকে যোগ দিতে বলো। না থাকলে বানিয়ে ফেলো। নিজের যেটাতে আগ্রহ-যা ভালোবাসো, সেটা সবাইকে ভালোবাসতে শেখাও। নিজেরা নিজেদের শিখাও। একেকজন যদি আমরা একেকজনের শিক্ষক হতে পারি-তাহলে কিন্তু সমাজের একত্রিতায় শিক্ষার মান অনেক অনেক বেড়ে যেতে পারে। এইজন্যে আমি ছাত্র সংগঠনের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি-কারণ একবার যদি ছাত্র সংগঠনগুলো ফেস্টিভাল করা আর স্পন্সর খোঁজা বন্ধ করে একসাথে বসে সমস্যা সমাধান করা নিয়ে চিন্তা করা শুরু করে-তারা দুনিয়া বদলে দিতে পারে। যেকোন সরকারী পরীক্ষা-সরকারী নীতিনির্ধারণ-শিক্ষাবিদের বক্তৃতার চেয়ে অনেক অনেক কার্যকরী আর শক্তিশালী ভাবে।
আমাদের শিক্ষা আমাদেরই ঠিক করতে হবে-কারণ পরে যখন আমাদের সামনে কোন একজন মানুষ ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন নিয়ে দাঁড়াবে, তখন দেশের অলস মানুষেরা কিন্তু তোমাকে দোষ দিতে এক মুহুর্ত আলসেমি করবে না। কাজেই তোমার যোগ্যতা তোমাকেই গড়তে হবে-আর কেউ কিছু করুক, বা না করুক।
বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার এমনকি লক্ষ লক্ষ ছেলেপেলে পরীক্ষা পাশ করে বের হয়। এদের মাঝে অনেকেই অনেক অনেক ভালো রেজাল্ট করে ছাত্রজীবনে ঠাঁটবাট নিয়ে চলে। কিন্তু পাশ করবার পরে তারা কতটুকু কি করতে পারে? আনফুলফিলিং একটা চাকরিতে ঢুকে সারাটাজীবন মাথাগুজে পেচিয়ে পুচিয়ে নিজের নাম সই করতে থাকে আর বিড়বিড় করতে করতে বলে-এই পরীক্ষায় আমি হ্যানো বোর্ডে ত্যানো হয়েছিলাম।
নিখাদ সত্যটি হচ্ছে-ভবিষ্যতের তীব্র প্রতিযোগিতার বাংলাদেশে একধাপ এগিয়ে না থাকলে, একটু উদ্ভাবনী-একটি গবেষণাধর্মী মনোভাব নিয়ে বেড়ে না উঠলে টিকে থাকতে তোমাদেরই কষ্ট হয়ে পড়বে। আমাদের শিক্ষা-আমাদের হাতে। আমাদের ভবিষ্যত আমাদের হাতে। আর কেউ উপরের তলার থেকে নেমে এসে বিপুল জ্ঞানে আর বিক্রমে আমাদের উন্নত করে দিয়ে যাবে না-কারণ উপরের তলার মানুষের আমাদের নিয়ে কিছু এসে যায়না।
আমাদের নিজেদের শিক্ষা গড়তে হবে নিজেদের প্রয়োজনে-নিজেদের অংশগ্রহনে। যাতে পরেরবার আমাদের নিয়ে কেউ উপহাস করতে আসলে আমরা তাদেরকে নিয়ে একচোট হাসাহাসি করে নিতে পারি-আর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলতে পারি, এতো বছর বয়সে এতোজন মানুষকে নিয়ে একসাথে আমি এতোগুলো সমস্যার সমাধান করেছি। শিক্ষাবিদেরা এসে আমাদের সমস্যা সমাধান করে দিয়ে যাননাই-আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করতে শিখেছি। আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করতে শিখেছি।
লেখকঃ অনুপম দেবাশীষ রায়,
রাজনীতিবিদ্যা, অর্থনীতি ও দর্শন,
হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি,
ওয়াশিংটন ডি.সি.
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৯:৩১
১. ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৯:৫৮ ০