সোহাগী জাহান তনু নামের একটা সোহাগী মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। একেবারে মেরে ফেলার আগে তার ওপর চালানো হয়েছে পাশবিক নির্যাতন। এরকম ঘটনা বাংলাদেশে প্রায়ই ঘটে-মানুষ গিলে ফেলে। পরিবার পরিজন মিলে ধামাচাপা দিয়ে ফেলে।
এইবার তেমনটা ঘটেনি। তার প্রথম কারণ এই যে, তনুর পরিবার যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। আর দশটা পরিবারের মতন কান্নাকাটি করে তারা দায় সারেনাই। তারা বিচার চেয়েছে। তনুর বাবা নিজে পুলিশের কাছে গিয়ে মামলা করেছেন। চমৎকার ব্যাপার।
তিনি রাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়েছেন আজকে থেকে সাতদিন আগে। এর মাঝে রাষ্ট্র তাকে যেটি দিয়েছে সেটি হলো নিদারুণ তৎপরতা। বাংলাদেশের মতন দূর্বল রাষ্ট্রের কাছ থেকে এই তৎপরতা পাওয়া একধরণের ভাগ্যের ব্যাপার। এই তৎপরতা এতো বেশি যে দেখে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে যতগুলো ধর্ষণ হয় তার মাঝে পচানব্বই দশমিক এক শতাংশের বিরুদ্ধে কখনো কোন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়না (ফুলু, ২০১৩, প.৪৫)। সেই দেশে ধর্ষণ হবার প্রথম সপ্তাহের মাঝে পুলিশ, র্যাব আর ডিবি পুলিশ মিলে যে কিনা তৎপরতা শুরু করলো-তা দেখে আমরা অবাক হলাম।
আরো অবাক হলাম এইজন্য যে জেলা প্রসাশনের পক্ষ থেকে নাকি তনুর পরিবারকে একখন্ড খাসজমি আর বিশহাজার টাকা দেয়া হচ্ছে। (মানবকন্ঠ, ২৪ মার্চ, ২০১৬)। বাংলাদেশে ২০১৫ সালের প্রথম ছয়মাসে দুইশআশিজন শিশু ধর্ষিত হয়েছে (ঢাকা ট্রিবিউন, ২০ জুলাই,২০১৫)। এদের সবাইকে যদি প্রসাশন খাসজমি দিতো তাহলে এতোদিনে বাংলাদেশে খাসজমি বলে কিছু থাকতোই না, অন্য কোন দেশ দখল করে জমিজিরাত দেয়া লাগতো। ইউএনও সাহেব এই টাকা আর খাসজমি তনুর পরিবারের কাছে তুলে দিয়েছেন। আমার প্রশ্ন হলো, এইসব কি একজন ইউএনওর সিদ্ধান্তে হতে পারে, নাকি আরো উপরের থেকে কোন সিদ্ধান্ত আসছে। যদি আসে, তার কারণ কি?
আমরা অনেক অনেকবার অনেক অনেক কষ্ট পেয়েছি, তাই আমরা আর মুলো দেখে ভুলে যাইনা। আমরা আসল কারণ অনুসন্ধান করি। খুব জটিল, কুটিল কোন ব্যাপার কি ঘটে গেছে এই তনু হত্যার রহস্যের পিছনে যেটা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র খুব হিসাব করে লুকিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। খুনের কারণ আর খুনের ধরণের সাথে খুনের ঘটনাস্থলের মাঝে গভীর কোন সম্পর্ক রয়েছে? যে সম্পর্ক বের হয়ে গেলে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের ভীত নড়ে যাবে, হাওয়াই গদিতে হাওয়া যারা ভরে, তাদের কদাকার মুখ বের হয়ে যাবে? এরকম কি হতে পারে?
তনু হত্যার পর থেকে তনুর পরিবার নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। এই নিরাপত্তার অভাব বোধ করার তাদের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্টাইলে তাদেরকে র্যাব তাদের বাসার থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছে আর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
রাত বারোটার সময়ে কিভাবে করে একটা দেশের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়ান্না রাস্কেলা স্টাইলে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়, সেটা আমার মাথায় ঢোকেনা। কেন সেটা নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করেনা, সেটাও আমার মাথায় ঢোকেনা।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে আশিবার জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের মেয়ের কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো নাকি। তার বাবাকে ধরে জিজ্ঞেস করা হয়-আপনি বলেন দেখি কে খুন করেছে। এমন একটা ভাব, যেন তারাই ইচ্ছা করে তাদের কন্যাকে খুন করেছে। নিচের অংশটি আজ আটাশ মার্চের প্রথম আলোর থেকে তুলে দিলামঃ
জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে সোহাগীর মা আনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক কথা আশি বার জিগগাস করছে। কন ভিক্টোরিয়া কলেজের কার সঙ্গে তনুর সম্পর্ক আছল। আমি তো মেয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে গেলে খোঁজ রাখছি। ভেতরে তো খোঁজ রাখি নাই। এইখানে সে ছোট বেলা থেকে বড় হইছে। সব অনুষ্ঠানে নাচগান করছে। নাটকও করছে। কোনো দিন কোনো কথা উঠে নাই। এখন মেয়ে নাই হাজারটা কথা উঠতেছে।’
আনোয়ারা বেগম-আপনি বুঝতে পারছেন না, কেন বারবার প্রেমিকের কথা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কারণ আপনার সোহাগী বড়ো বেশি ভালো মেয়ে। অনেক খুজেপেতেও আমাদের সমাজ তার কোন দোষ খুজে বের করতে পারেনাই। তার কাপড়চোপড়ে,তার চালচলনে কোনকিছুতে ধর্ষণ করে সামাজিক অনুশাসনের আওতায় আনার কোন সিস্টেম নাই। কাজেই প্রেম করতো নষ্টা মেয়ে বলে আন্দোলনকারীদের বাড়ি ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আর তা যদি নাও হয় তাহলে কমপক্ষে প্রকৃত খুনির বদলে কোন এক বেচারা কিশোর প্রেমিককে ধরে বলির পাঁঠা বানায়ে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে।
আমরা যারা তনু হত্যার বিচার চাচ্ছি-তাদের অনেকেই বেশকিছু ইংরেজি সিনেমা দেখেছি। সেখানে দেখেছি কোন আসামীকে পুলিশ যখন ধরে নিয়ে যায় তখন তাকে পড়ে শোনানো হয়- ইউ হ্যাভ দ্য রাইট টু রিমেইন সাইলেন্ট। এনিথিং ইউ সে অর ডু ক্যান এন্ড উইল বি ইউজড এগেইন্সট ইউ ইন দ্য কোর্ট অব ল। ইউ হ্যাভ দ্য রাইট টু স্পিক টু এন এটর্নি এন্ড হ্যাভ এন এটর্নি প্রেসেন্ট ডিউরিং এনি কোয়েশ্চেনিং।
এই শব্দগুচ্ছকে বলে মিরান্ডা রাইটস। উনিশশ ছেষট্টী সালের মিরান্ডা ভি এরিজোনা কেইসে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট এই বস্তু সৃষ্টি করে। একই রকম কিছু অধিকার আমাদের দেশের সংবিধানেও বলা আছে-
তৃতীয় ভাগ
মৌলিক অধিকার
গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ
৩৩। (১) গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।
গ্রেপ্তার না করে, রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোনরকম আইনজীবীর উপস্থিতি বাদে কেউ বাংলাদেশের কোন নাগরিককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে না। যদি পারে তাহলে আমরা বাংলাদেশে বসবাস করছি না।
আমি অনেক ছোট একজন মানুষ। সংবাদপত্রে খবরটা পড়ে আমার মিরান্ডা রাইটসের কথা মনে পড়েছে। সেই অনুযায়ী গুগুল করে করে আমি বাংলাদেশ সম্বন্ধে এই ব্যপারটি বের করতে পেরেছি। বাংলাদেশে অনেক বড়ো বড়ো আইন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন-তারা এই বিষয়ে অনেক বেশি জানবেন। তাদের এখন সোহাগীর পরিবারের পাশে এসে দাড়াতে হবে।তাদের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।
আমি অনেক অনেক ভাগ্যবান একজন মানুষ এই কারনে যে আমি এমন একটা সময়ে জন্মেছি যখন বাংলাদেশে একটা অমিত সম্ভাবনার তীব্র প্রজন্মের জন্ম হয়েছে। এই প্রজন্মের ছেলেপেলেরা যা করতে চায় তাই করে ফেলতে পারে। এদেরকে কেউ কোনদিন আটকাতে পারেনি-কেউ কোনদিন আটকাতে পারেনা। এই প্রজন্মের ছেলেপেলেরা এইবার কথা বলছে। এই প্রজন্মের ছেলেপেলেরা এইবার তনুর পরিবারের পাশে দাড়িয়েছে-তনুর মা বাবা হঠাৎ আবিস্কার করেছে যে তারা আর এই যুদ্ধে একা নন-তাদের আশেপাশে তনুর হাজার হাজার ভাই বোন, বন্ধুবান্ধব দাড়িয়েছে। এরা সকলে মিলে বিচার চায়। অনেক অনেকদিন ধরে এরা চুপ করে ছিলো। অনেক অনেকদিন ধরে এরা মুখ বুজে সহ্য করেছে। এইবার তারা বিচার চাইতে এসেছে।
আমি নিশ্চিত জানি যে এই তীব্র প্রজন্মের মাঝে অনেক অনেকজন আছেন যাদের মাথায় অনেক অনেক বুদ্ধি। তারা দেখুন-যে এইখানে একটা ভয়াবহ অবিচার হচ্ছে। দুইবছর আগে হয়ে যাওয়া একটা ঘটনার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একটা গণআনন্দলনের পক্ষে পক্ষে কথা বলে দেশের সরকের পিছন থেকে সেই আন্দোলনকে নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
হে তীব্র প্রজন্মের সৈনিকেরা-তোমরা সেই আলোকে নিভতে দিওনা-সেই আলোর চারদিকে কবচ হয়ে দাঁড়াও।
বিপদে আছে তনুর বাবা-বিপদে আছে তনুর মা। তারা কুমিল্লায়, ঢাকায় মানববন্ধন করে লাভ নেই। আমাদের তাদের পাশে দাড়াতে হবে। তাদের আইনী সহায়তা দিতে হবে। যদি কারো কোন পরিচিত আইনজীবী থেকে থাকে যারা এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল-তাদের বলতে হবে যেন তারা তনুর পরিবারের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করে।
আমরা অনেক অনেকদিন চুপ থেকেছি। তনুর বাবা মায়েরা অনেক অনেকদিন চুপ থেকেছে। আমরা আর কাউকে বন্ধুর ছদ্মবেশে আমাদের অধিকার হরণ করতে দেবোনা।
এখনই আমাদের সময়ে-উই হ্যাভ আর্ড আওয়ার রাইট টু ব্রেক আওয়ার সাইলেন্স।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৭:৩৯