রফিক সাহেব তার নিউ হোমিও হলে বসে আছেন। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। মাথার উপরে একটা ৬০ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। নাম নিউ হোমিও হল হলেও বছর কুড়ি হয় গেছে। ওষুধ রাখার সেলফে ধুলো জমে আছে। এটা এখন রফিক সাহেবের বিকেল থেকে রাত ১০ টা পর্যন্তের আশ্রয়। বিকেল থেকে তার নাতি নাতনিদের প্রাইভেট টিউটর আসা শুরু করে। দুই ভাইবোন এক রুমে পড়তে পারে না। তাই রফিক সাহেবের ঘরটা ছেড়ে দিতে হয়। ঘর অবশ্য বলা ঠিক হচ্ছে না। একটা জানালা আছে, তার অপর পাশে বিশাল দেয়াল। রফিক সাহেবের স্ত্রী মারা গিয়েছেন ১২ বছর হতে চললো। এক ছেলে বউ আর ২ নাতিকে নিয়ে এই সংসার।
নিউ হোমিও হল বাজারের শেষ প্রান্তে। এদিকটায় বিশেষ কেউ আসে না। বিকেলের পর থেকে বাজারের কোলাহল খুব একটা চোখেও পড়ে না। চেম্বারের সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। রাস্তার অপর পাশে একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির মালিক চিত্তরঞ্জন বাবু দোতালায় একটা মেস চালান। কিছু বেকার ছেলে সেখানে থাকে। নাম মাত্র ভাড়া, খাওয়া দাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। রুমি দোতলার প্রথম ঘরটাতে থাকে। রফিক সাহেব আজকে রুমির অপেক্ষায় আছেন। অপেক্ষায় তিনি প্রতিদিনই থাকেন। অজানা কারনে ছেলেটা তার ভালো লাগে। মাঝে মাঝে রুমির ঘরে গিয়ে গল্প করতে ইচ্ছে করে কিন্তু যাওয়া হয় না। ছেলেটা বিকেলে টিউশনি করায়। রাত আটটার দিকে মেসে আসে।
রুমিকে বাসায় দাওয়াত করার সাহস পাচ্ছেন না।রফিক সাহেবের বউমা সাধারণত কথা কম বলে। দুপুরে একজনকে দাওয়াত করলে বউমা কি রকম আচরণ করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না। দুপুরের খাবারটা রফিক সাহেবের ঘরেই দেওয়া হয়। আজকে ছিলো মুরগির মাংস, গতকালের ভাজি আর ডাল। আজকে রফিক সাহেব অপেক্ষা করছেন বিশেষ কারনে। মাংসটা রফিক সাহেব নিয়ে এসেছেন। ছেলেটা মেসে কিনা কি খায়। তার অবশ্য লজ্জাও লাগছে। রুমি যদি কিছু মনে করে বা অপমানিত হয়। তার সাথে খুব অল্প দিনের পরিচয়। দু সপ্তাহের পরিচয়ে কি নিজে না খেয়ে বাসা থেকে কারো জন্য খাবার আনা যায়? রফিক সাথেব দীর্ঘদিন মেসে থেকেছেন। প্রতিদিনের খাবার ছিলো ডাল আর আলু ভাজি। এক বন্ধুর পরামর্শে শুটকি চিংড়ি কিনেছিলেন, অনেকদিন রেখে খাওয়া যাবে এই আশায়। প্রথম দিনেই বমি, পেট খারাপ। তারপর ডাল আলু ভর্তার বাইরে যাননি। শুক্রবারটা বেশ মন খারাপ হতো। চারপাশের বাসা থেকে পোলাও মাংসের সুবাস আসতো।
রাত নয়টার দিকে রফিক সাহেব মেসে গেলেন। ছেলেটাতো এতো দেরি করে না কখনো। রুমির ঘর ফাকা, অবশ্য বিশেষ কিছু থাকার কথাও না। চিত্তরঞ্জন বাবু জানালো রুমি দুপুরেই চলে গেছে। কাউকে বলেও যায় নি। যে বাসায় টিউশনি করাতো সেখান থেকে একটা দামি ঘড়ি চুরি করেছে। ঘড়ি তার পকেটে পাওয়া গছে। ওনারা ভদ্রলোক তাই থানা পুলিশ করেননি। চিত্তরঞ্জন বাবু ভাড়া বাবদ ১২৩০ টাকা পেতেন। সেটাও দিয়ে যায় নি।
রফিক সাহেব চেম্বারে ফিরে এলেন। আজ একটু দেরি করেই বাড়ি ফিরলেন। তার কেন যেন মনে হচ্ছে রাস্তায় রুমির সাথে দেখা হবে। ছেলেটার প্রতি তার কিসের এতো মায়া। নাকি রুমির মধ্যে তিনি নিজেকে দেখতে পান। নিজের জীবনের বেকার অসহায় সময়টা এতো বছরেও ভুলতে পারেন নি তিনি।