কলিং বেলের শব্দে অনিতা উঠে এলো। গেটের বাইরে একজন মধ্য বয়সি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে বেশ কিছু ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। অনিতা কিছু বলার আগেই লোকটা বললেন ,”কেমন আছো বউ মা? রঞ্জু বাসায় নেই ?”।
অনিতা বলল,”ভেতরে আসুন।” গেট খুলতে এগিয়ে গেলো অনিতা। মাঝে মাঝে অবাক লাগে এতো অপরিচিত মানুষ আসে অনিতার তাও কেমন যেন মনে হয় এরা অনেক আপন। কখনো সন্দেহ হয় না। পরে অবশ্য মনে হয় খারাপ লোকও তো হতে পারতো। এতো কম পরিচয়ে কি করে সে একজন মানুষকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে? অনিতার সংসার শুরু হয়েছে ২ মাস হলো। ভালোই কাটছে , আজীবন ছোট বাসায় থেকেছে অনিতা এখন এই বাড়ীতে দারুন লাগছে। অনেক পুরোনো দেয়ালে ঘেরা বাড়ী, মেইন গেট থেকে একটু ভিতরে। বাড়ির পিছনেও অনেক গাছ আছে। সারাক্ষন পাখির কিচিরমিচির । শহরের মধ্যে থেকেও যেন অনিতা শহরের বাইরে। লোকটা রঞ্জুর শিক্ষক বলে পরিচয় দিচ্ছেন, উনার নাম আজাহার । আচ্ছা আগেও কি কেউ এই পরিচয়ে এসেছিলো। মনে পড়লো না অনিতার। বিয়ের এই দু মাসে অনিতা অনেক কিছু পেয়েছে। রঞ্জু অনেক ভালো বাসে তাকে, বাড়ী থেকে যে এতো দূরে এসে থাকছে তাতে তার একদমই কষ্ট হচ্ছে না। তবে অনিতা একটা ব্যাপারে খুব অবাক হচ্ছে, রঞ্জুর বাবা মা নেই, এক ভাই আছে সে বিদেশে থাকে। তবুও বিয়ের দিন থেকেই অনিতা কখনো একা থাকে নি । কেউ না কেউ তাদের সাথে ছিলো। আজ যেমন রঞ্জুর স্যার আছে।
বউমা ,ঝুড়িতে মাছ আছে, আমাদের নিজের পুকুরের মাছ। অনেক কষ্ট করেও এর চেয়ে বড় মাছ পেলাম না। মাছ আগে ছিলো, সেই দিন কি আর এখন আছে। একটা বটি দাও , মাছটা কেটে দেই। তুমি নতুন বউ পারবে না। অনিতা কথা না বাড়িয়ে বটি আনতে গেলো। একবারো অনিতা আপত্তি করলো না , নাকি আপত্তি করতে পারলো না । অপরিচিত একজন মানুষ এসে রঞ্জুর শিক্ষক পরিচয় দিচ্ছে। একটু পরে সে মাছ কাটার জন্য বটি চাইছে , এসব অনিতার কাছে অনেক অদ্ভুত মনে হয়। অনিতা প্রথম প্রথম এসব মানতে পারতো না । এখন অনেকটা সহজ ভাবেই মেনে নেয়। রঞ্জুকে বললেও রঞ্জু কিছু বলে না। ও বরাবরই কথা কম বলে। অবশ্য অনিতা রঞ্জুকে চেনেই ২ মাস, বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত রঞ্জুকে চিনতো না অনিতা। তার দাদার বন্ধু রঞ্জু, প্রাইমারীতে একসাথে পড়ত। রঞ্জুর কথা অনেক শুনেছে অনিতা । কখনো দেখেনি আগে, দাদা সুযোগ পেলেই রঞ্জুর গল্প করতো। এতো মুগ্ধ দাদা কিভাবে হলো অনিতা তাও জানে না। দাদা অনেক বার অনিতার সংসার দেখতে আসতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে। রঞ্জু বলেছে আর একটু গুছিয়ে নেই তারপরে আসবো। রঞ্জু ঠিক কি গোছানোর কথা বলছে সে বুঝতে পারছে না। এই বাসায় সবই আছে। বিয়ের পরে রঞ্জু কিছুই কেনে নি। এই বাড়ীতে সব ছিলো আগে থেকেই । দুটো বিশাল বিশাল খাট, আলমারী, টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, কাসার অনেকগুলো বাসন। ড্রেসিং টেবিলটা অনিতার বেশি পছন্দ। অনেক বড় আয়না, সামনে দাড়ালে অনিতার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখা যায়। অনিতার ধারনা সে বিয়ের পরে আরো সুন্দর হয়ে গেছে। হয়তো এই আয়নায় মুখ দেখার পরেই বেশি সুন্দর হয়েছে। মুখে আগে বেশ কিছু দাগ ছিল , এখন একটাও দাগ নেই, চেহারাও কেমন ভরাট হয়েছে। রোজ দুপুরে অনিতা আয়নার সামনে বসে চুল আচড়ায় , ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় এভাবে। পরে অনিতার মনে হয় সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এই পুরো সময়টায় সে কি ভেবেছে তাও মনে করতে পারে না।
আজাহার মাস্টারের কথায় অনিতার ঘোর কাটলো। বউমা মাছটা কাটা হয়ে গেছে। কয়েকটা মুরগিও নিয়ে এসেছি, আমাদের নিজেদের পোষা মুরগি, তোমার কাকি মা শখ করে পাঠিয়েছে। বউমা আমার খুব ক্লান্ত লাগছে মুরগিটা কালকে কাটলে হয় না? আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। এইবলে আজাহার মাস্টার করুন চোখে অনুমতির জন্য দাড়িয়ে রইলো। অনিতার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো, আজাহার মাস্টারের চোখে ভয়। কিসের ভয় তার, তাকো তো কাজ করতে বলা হয় নি , এই কাজ তার করার কথাও না। তবে কেন সে এতো ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে ? কেউ কি তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে? কে সে?
অনিতা বলল, “আপনি হাতমুখ ধুয়ে আসুন ,আমি খাবার দিচ্ছি। “
আজাহার মাস্টার প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলো । অনিতা বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে খাবার দিতে গেলো। টেবিলে ছোট মাছ ভাজি , মুরগির ঝোল আর ডাল আছে। আজাহার মাস্টার তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। অনিতার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। এসব কি আসলেই অস্বাভাবিক? নাকি অনিতার ভুল। এই নির্জন বাড়ী কি তাকে এইসব ভাবতে বাধ্য করছে?
আজহার মাস্টার বললো বউ মা কাল বড় মাছটা রান্না করবো । অনিতা চমকে উঠলো । এই লোক রান্না করবে মানে? তার বাসায় সে রান্না করবে। আচ্ছা আজকের রান্না কে করেছে? অনিতার মনে পড়ে না সে কখনো রান্না করেছে। আর এই বাজার কে করলো। রঞ্জু কখনো বাজার করে না। কেউ না কেউ ওদের বাসায় বাজার দিয়ে যায়। অনেক মাছ- মাংস , সবজি, দুধ সব কিছু । গতকাল ওদের বাসায় কে ছিলো ? অনিতা মনে করতে পারছে না। আজাহার মাস্টারের খাওয়া শেষ হয়েছে, সে অবলিলায় উঠে গেলো , বাসনগুলো ধুয়ে মুছে রাখলো। এরপর বাতি নিভিয়ে অনিতাদের পাশের ঘরে শুয়ে পড়লো। যেন এসব আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো।
রঞ্জু বাসায় ফিরলো রাত ১২ টার দিকে। প্রতিদিন একই সময় ফেরে রঞ্জু , একই সময় বাইরে যায়। যেন সব কিছু ছকে বাধা। অনিতা হাতের ব্যাগ নিতে নিতে বললো ,”তোমার স্যার এসেছেন।”রঞ্জুর ভাবান্তর হলো না, যেন এমনই হওয়ার কথা ছিলো। খাওয়া শেষ করে রঞ্জু হাত মুছে একটা সিগারেট জ্বাললো। বারান্দায় দুজন পাশাপাশি বসে আছে। চাঁদ উঠেছে, রঞ্জুর মুখের উপর ছায়া পড়েছে। গাছের ছায়ায় অদ্ভুত লাগছে রঞ্জুকে। অনিতা বললো,”দাদা কবে আসবে?” আসবে অনিতা, আরেকটু গুছিয়ে নেই তখন আসবে। সবাইকেই আসতে হবে, যার যখন সময় হবে তখনই আসবে। রঞ্জু উঠে দাড়ালো। সিগারেট ফেলে দিয়ে আজাহার মাস্টারের ঘরে গেলো। ভিতর থেকে দরজা আটকে দিলো । এখন আর কোনো শব্দ আসছে না, নিশ্বাসের শব্দও না। অনিতা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, শোনার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো শব্দই হচ্ছে না ভিতরে। অনিতার অনেক ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কত কাল সে ঘুমায় নি। অনেক চেষ্টা করেও সে জেগে থাকতে পারছে না তলিয়ে যাচ্ছে, আরো গভিরে।
সকালবেলা ঘুম ভাঙলো অনিতার। রঞ্জু পাশে নেই , বাইরে চলে গেছে। এতো বেলা পর্যন্ত অনিতা ঘুমাতে চায় না তবুও কেন যেন উঠতে পারে না। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় বসলো অনিতা ।
বউমা, তোমার চা।
অনিতা সহজ ভাবে চা নিলো । যেন এটাই হবার ছিলো । রঞ্জুর মাস্টার একদিন এসে মাছ কুটবেন , বাসন ধোবেন , সকালে চা করবেন। বউমা , বাজার যা আছে তাতে এক মাস হবে না ?
আমি জানি না স্যার।
তুমি কি একটু রঞ্জুকে বোঝাবে? ও যদি একটু…
আজহার মাস্টার আর কিছু বলল না, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । একটু পরে রান্না ঘর থেকে শব্দ আসতে লাগলো। আজহার মাস্টার রান্না করছেন, কি সুন্দর গন্ধ আসছে। এভাবে দিন কাটতে লাগল আজাহার মাস্টার রান্না করছেন , বাগান পরিষ্কার করছেন আর প্রায়ই গেটের খুব কাছে গিয়ে দাড়িয়ে থাকছেন। যেন তার ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তবুও সে বের হতে পারছে না। ধীরে ধীরে আজাহার মাস্টার অসুস্থ হতে লাগলেন। শরীর দুর্বল হয়ে গেল, চোখে কম দেখতে লাগলেন। শেষের দিকে অনেক চিতকার করতেন। একদিন সকালে বাড়ীর সামনে অ্যাম্বুলেন্স আসলো, আজাহার মাস্টারকে নিয়ে গেলো।
রাতে রঞ্জু ফেরার পরে অনিতা বললো ,”বাজার শেষ”
রঞ্জু খেতে খেতে বললো , “চিন্তা করো না , কাল দাদা বাজার নিয়ে আসবে।”
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০২১ বিকাল ৫:০৫