সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু ঝড়ো হাওয়ার বেগ বেড়েছে। যেন বৃষ্টির কমে যাওয়াটা পুষিয়ে নিতেই বাতাস তার বেগ বাড়িয়ে নিয়েছে।
শহরের ব্যস্ত এই মোড়ের চিত্র অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক ভিন্ন। মোড়ের চা-পানের দোকানটা বন্ধ। রাস্তায় এক-দেড় ইঞ্চি পানি জমে আছে। আশেপাশের টিনশেড বাড়িগুলোর টুয়া থেকে সমানে বৃষ্টির পানি পড়ছে সেই ইঞ্চিখানেক জমে থাকা পানির উপর। খানিকটা ঝর্ণার মতো সেই শব্দের সঙ্গে যোগ হয়েছে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ। আর সেই সঙ্গে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ তো কান পর্যন্তই পৌঁছে যায়।
এসব কিছু শোনা গেলেও দেখা যাচ্ছে না ঠিকভাবে। সন্ধ্যা নেমে যাওয়ার পর থেকে দিনের আলোও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে কমে এসেছে। এখন কেবল অদ্ভূত এক গাঢ় নীল আবছা আলোয় মোড়ের এই বৃষ্টির ধারা দেখা যাচ্ছে।
শহরের বুকে এমন অবাস্তব ও অবিশ্বাস্য এক মূহুর্তে একলা হেঁটে চলেছে অর্পি। হাঁটার গতি দেখেই বলে দেয়া সম্ভব গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন। এই সময়টায় এখানে এমন দৃশ্য দেখলে সবারই এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে উপভোগ করার কথা। কিন্তু অতিপ্রাকৃতিক এই দৃশ্য উপভোগ করার মতো মন-মানসিকতা যে অর্পির নেই। তাই প্রকৃতির এই অপরূপ চিত্র অর্পির নজরের বাইরেই থেকে গেলো।
অর্পির এই খারাপ আবহাওয়ার দিনে বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো প্ল্যানই ছিল না। ছোট বোনের কাছ থেকে সারাদিন টিভির রিমোট লুকিয়ে রেখেছে সন্ধ্যার পরের কিছু নাটক দেখবে বলে। কিন্তু হঠাৎই ওর মন খারাপ হয়ে গেল। অনেকগুলো ভাবনা মাথায় এসে জড়ো হলো। কেন যেন ওর নিজের অস্তিত্বই অসহ্য লাগতে শুরু করলো। এসব থেকে স্বস্তি পাওয়ার আশায়ই বাসায় বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বেরিয়ে এসেছে ও।
কিন্তু ও জানে ওর গন্তব্য কোথাও না। বৃষ্টি না কমলে হয়তো বেরই হওয়া হতো না। বৃষ্টি কমায় এই দমকা হাওয়া ও টুপটাপ বৃষ্টির মাঝে হাঁটতে ভালোই লাগছে। তাই সে হাঁটছে। বৃষ্টির বেগ না থাকায় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ওর পায়ের আওয়াজ কেমন যেন এক ধরনের ছন্দের সৃষ্টি করেছে। মিনিট দশেক হাঁটার পর এই একলা পথ চলায় অর্পির সঙ্গী হয়ে উঠলো সেই ছন্দময়ী আওয়াজ। এক মূহুর্তের জন্য ও দাঁড়িয়েছিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন নীরবতা ওকে ঘিরে ধরেছিল। তাই দম না দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করেছে সে।
গত ক’দিন ধরেই কেন যেন কোনোকিছুতেই অর্পির আর মন বসছে না। ওর জীবনে না পাওয়ার সংখ্যা খুবই কম। দারুণ এক পরিবারে জন্ম ওর, অসাধারণ সব মানুষ ওর বন্ধু মহলে, কিন্তু তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে এর সবই অর্থহীন। হঠাৎই কাছের মানুষগুলোর সব কথাবার্তা, কেয়ার নেয়া, সবকিছু মেকি মনে হচ্ছে। মা সকালে এসে নাস্তা সাধলে মনে হচ্ছে ঢঙ করছে। ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু সিমি ওর জ্বর শুনে সারাদিন এসে পাশে বসে থাকার সঙ্গে সিমির নিজস্ব কোনো স্বার্থ জড়িত বলে মনে হয়েছে। দিনশেষে এই সব ভাবনার জন্য নিজেকেই চরম অপদার্থ বলে নিজের অস্তিত্বের জন্যই রাগ লাগতে শুরু করেছে ওর।
কী হয়েছে ওর? হঠাৎ কেন এতো বদলে যাচ্ছে? ওর আশেপাশের মানুষগুলো তো বদলায়নি। তাদের প্রতি অর্পির দৃষ্টিভঙ্গি কেন এতো বদলালো? বদলাবেই যখন, কেনই বা তা খারাপ দিকে যাবে?
এমনই শত প্রশ্নের মাঝে ডুবে যখন বৃষ্টিজমা গলতে পা ডুবিয়ে হাঁটছে অর্পি, তখন পাশের এক হোটেল থেকে ডাক এলো, “চা খেয়ে যান আপা! এই গরমে চা অনেক ভালো লাগবে। কফিও আছে।”
বয়স্ক লোকটার দিকে একবার কেবল তাকালো অর্পি। আবারও নীরবতা জেঁকে ধরবে এই ভয়ে হাঁটা বন্ধ করলো না। পরমূহুর্তেই যেভাবে মাথা নিচু করে হাঁটছিল, সেভাবে হাঁটতে শুরু করলো। প্রশ্ন জর্জরিত মন মূহুর্তেই আগের অবস্থায় ফিরে গেল। যেন এইমাত্র ঘটা ঘটনা কখনো ঘটেইনি।
অর্পির হেঁটে যাওয়া দেখে হোটেলে লোকটি দ্বিতীয়বার আর ডাকলো না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মসম্মানবোধও কিছুটা বেড়েছে। চা খেতেই তো ডেকেছে। মেয়ের বয়সী মেয়েটার এতে নিজেরও ভালো লাগবে, তারই দু’টো পয়সা আয় হবে। এতে এমন ভাব দেখিয়ে না শোনার ভান করার কি দরকার ছিল!
অথচ অর্পি কোনো ভাব দেখায়নি। সাধারণত ও সবার সঙ্গে খুব মিশুকভাবে কথা বলে। এতে করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে যে পড়তে হয়নি তা নয়। কিন্তু তবুও ও ভালো ব্যবহার করে সবার সঙ্গে। কিন্তু আজ ওর মন ভীষণ খারাপ। পাড়ার এক হোটেলে থাকা বৃদ্ধের তা বোঝার কথা না। সবাই নিজের অবস্থানে থেকেই আরেকজনকে বিচার করে। আরেকজন কী অবস্থায় আছে, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন কেউ বোধ করে না।
অন্ধকার ততক্ষণে জেঁকে ধরেছে অর্পিকে। এই রাস্তায় আর একা হাঁটা নিরাপদ বোধ করলো না। কেন হঠাৎ তার মনে এমন পরিবর্তন এলো, কেন কোনোকিছুই আর তার ভালো লাগছে না, কেনই বা এই খারাপ আবহাওয়ায় বাসা থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটাহাঁটি করলো, এর সব কিছুকে রহস্য রেখেই আবার ফেরার পথ ধরলো সে।
মানুষ কিছু কথা তার সবচেয়ে আপনজনের কাছ থেকেও গোপন রাখে। আবার কিছু কথা আছে, যেগুলো নিজের কাছেও গোপন রাখে, যেগুলোর উত্তর খোঁজাখুজি করে না। থাক না, সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে লাভ কী! মন খারাপের মূহুর্তগুলো শেষে কেবল বৃষ্টিমুখর এক সন্ধ্যার উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটির করে সময় নষ্টের বেশি কিছু হবে না।
আবার কে জানে, হয়তো কারো কারো কাছে সেই উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটিই মন ভালো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট!!
প্রথম প্রকাশঃ http://wp.me/pgq2S-bs
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৯