'হুম।'
'তোমাকে ডিস্টার্ব করে থাকলে সরি।'
'দেখো, আর যাই করো, বেশি বুঝবানা। তাহলে কিন্তু মেজাজ খুব খারাপ হয়।'
'বেশি বুঝার কিছু নাই। আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করছি। সে জন্য বললাম।'
'হুম।'
দুপুর থেকে ফেসবুকে বসে রয়েছি। ঘুম থেকে উঠেছি দেরি করে। আগের রাতে ঘুমিয়েছিও দেরি করে। ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিলাম আইডিবিতে। একটা রাউটার আর কিবোর্ড কেনার খুব দরকার ছিল। ঈদের আগেরদিন আইডিবি বন্ধ থাকবে জানতাম না। শুধু শুধুই গিয়ে ঘুরে এলাম। আসার পর ল্যাপটপ খুলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়ে রয়েছি। ঘুমও আসছে না, কাজ করতেও ইচ্ছে করছে না। আগামীকাল কুরবানীর পরের হাজারটা কাজের কথা চিন্তা করে এখনই মাথা ধরতে শুরু করেছে। আমি এমনিতেও কথা কম বলি। 'হুম' হচ্ছে আমার সবচেয়ে বেশি বলা আর লেখা শব্দ। তাই কেউ আমাকে বারবার হুম বলতে দেখলে প্রায়ই ভুল বুঝে যে আমি এড়ানোর চেষ্টা করছি।
কিন্তু কয়েকদিন কথা বলার পর বুঝে যাওয়ার কথা যে 'হুম' হচ্ছে আমার সবচেয়ে বেশি বলা শব্দ। কিন্তু তাও না বুঝলে আমার আর কী করার আছে। তাই আমিও তর্কে গেলাম না। বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরপর বাইরে থেকে ছাগলটার শুকনো গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। ছাগলটা এবার আমরা কিনিনি। ভাবীর বাসা থেকে পাঠিয়েছে। আমাদের গরু কেনা হয়েছে আজ দুপুরে। আর ছাগলটা বাসায় এসেছে গতকাল সকালে। অনেকদিন পর ছাগল দেখে মজাই পেলাম। আম্মু মনে করিয়ে দিলো, ছোটবেলায় নানাবাড়ীতে গেলে ছাগলকে কলাপাতা খাইয়ে আমার একটা বড় সময় কাটতো। আম্মু বললো, কলাপাতা তো আর পাবি না, কাঁঠালপাতা পাস কি না দেখ।
আমি একটু হেঁটে গিয়েই কাঁঠালপাতা পেয়ে গেলাম। ছাগলের ছোট্ট একটা হাট। সেখানে বিক্রি করছে। ২০ টাকা দিয়ে কিনে এনে ছাগলটাকে খাওয়ালাম।
আজ দুপুরে আইডিবিতে যাওয়ার জন্য বের হওয়ার সময় দেখলাম ছাগলটা পান্তা ভাত খাচ্ছে। গতকাল রাতে ভাতের মাড়ও খেয়েছিল। তাই ভেবেছিলাম ছাগলটার খাওয়ার ঝামেলা শেষ। কিন্তু বারবার শুকনো কাশি শোনার পর আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম ছাগল কিছু খেয়েছে কি না। আম্মু বললো, কিছু খায়নি। সামনে দেখলাম অনেক কিছু দেয়া। গতকাল পেয়াড়া গাছের পাতা খেয়েছিল। আজ তাও খাচ্ছে না। যাই হোক, আমি ভাবলাম খিদে নেই তাই হয়তো খায়নি। গুরুত্ব দিলাম না।
এরই মাঝে দুলাভাইয়ের ফোন এলো। চশমা ঠিক করা লাগবে আমার। তাই সন্ধ্যার পরপর ফোন পেয়ে দৌড়ে গেলাম ।পরিচিত দোকান বলে সামনে বসিয়েই চশমা ঠিক করে দিলো। সেটা নিয়ে বাসায় ফিরলাম ১০টার দিকে। বারান্দায় এসে দেখি ছাগল অর্ধেক আমার রুমে ঢুকে আছে। বুঝলাম না, রশি এতো ঢিল হলো কীভাবে। তবে কাল রাতের একটা কথা মনে পড়লো। ছাগলটাকে কাঁঠালপাতা খাওয়ানোর কারণে ছাগলটা আমাকে ভালোভাবেই চিনেছিল। তাই রাতে যতোবার দরজা খুলেছি, ততোবারই ছাগলকে আমার রুমের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেছি। লাগানোর সময়েও উঁকি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
ঘরে ঢুকে শুনলাম, ছাগল কিছুই খাচ্ছে না। কাঁঠালপাতা খাওয়ার পর এখন পাতাই খুঁজছে। পেয়াড়া পাতা দিয়ে কাজ হচ্ছে না। দেখলাম ছাগলটা আমার পায়ের কাছে শুঁকছে। মায়া লাগলো। বেচারা ছাগলটা নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকেই খাবার খুঁজছে। হয়তো আশাও করেছে আজ বিকেলেও ওর জন্য কাঁঠাল পাতা নিয়ে আসবো। নিরীহ প্রাণীটার কথা ভেবে মন খারাপ লাগলো। তাই সঙ্গে সঙ্গেই বেরোলাম সেই ছাগলের হাটের উদ্দেশ্যে।
কিন্তু রাত দশটায় কি আর কাঁঠালপাতা বিক্রি করে! কোথাও পেলাম না কাঁঠাল পাতা। আশেপাশে যতগুলো হাট আছে গেলাম। গরুর জন্য খড় আছে, ঘাস বা পাতা পেলাম না কোথাও। পরে মনে হলো, গাবতলী তো কাছেই আছে। সেখানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। যতদূর মনে পড়ে, অনেক আগে একবার গরু কিনে আনার সময় ঘাস আর পাতার পসড়া দেখেছিলাম।
রাত দশটায়ই রওনা দিলাম গাবতলীর উদ্দেশ্যে। অনেক বছর পর গাবতলী গেলাম। বিশাল হাট। প্রচুর গরু। হাজার হাজার গরু ফেরত যাবে বোঝাই যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক বেপারীকে দেখলাম ট্রাকে গরু উঠিয়ে হাট ছেড়ে রওনা দিয়েছেন। একটু সাবধান থাকার চেষ্টা করলাম। পরিচিত একজন গরুর হাটে গিয়ে অসুস্থ হয়েছে। আর আমি এসেছি রাত দশটায়!
গরুর অভাব নেই। ছাগলেরও অভাব নেই। কিন্তু কোথাও ঘাসের সন্ধান পেলাম না। নেই কাঁঠাল পাতাও। হয়তো রাত হয়ে গেছে, তাই পসড়া উঠিয়ে বিক্রেতারা চলে গেছেন। রাত পোহালেই ঈদ। একদিনের জন্য কি আর কেউ ঘাস কিনবে নাকি!
কোনো উপায়ন্তর না দেখে পৌনে এগারোটায় মিরপুরে ফিরতি গাড়ি ধরলাম। বাঙলা কলেজের সামনে দিয়ে গাড়ি যখন তুমুল বেগে ছুটছে, তখন মনে মনে খুব খারাপ লাগছিল। ছাগলটা আগামীকালই হয়তো কুরবানী হয়ে যাবে। আজ সারাদিন নিশ্চয়ই সে আশায় ছিল তার সামনের রুমে থাকা ছেলেটা তার জন্য কাঁঠাল পাতা জোগাড় করে নিয়ে আসবে। তার এই আশাটা ভঙ্গ হলো। কারো খাবারের আশা ভঙ্গ হলে আমার এমনিতেই খারাপ লাগে। আর এ-তো ছাগল; অবলা এক প্রাণী। আজকের আমার ভুলটা শোধরানোরও কোনো উপায় নেই। এই উপায় নেই যে কাল থেকে নিয়মিত পাতা এনে খাওয়াবো। কারণ, আজই যে তার শেষ রাত।
ছাগলটার এই ক্ষণিকের নিরাশা আমার মন খুব খারাপ করে দিলো। একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে শুরু করলো। জানি না, আল্লাহ মাফ করবেন কি না আমাকে।
প্রথম প্রকাশঃ ফেসবুক :: ব্লগ