
২৭ নভেম্বর, ১৯৯০। সকাল দশটার দিকে বকশীবাজারের মোড়ে ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা। রিকশায় জালাল ভাই আর লালবাগ আওয়ামী লীগ কর্মী নজরুল ভাই। সালাম দিতেই বললেন, 'পিজিতে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ডাক্তারদের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে, তোমরা আস'। শাহবাগ যাওয়ার পথেই ডা. শামসুল আলম খান মিলন ভাইয়ের সঙ্গে জালাল ভাইয়ের দেখা, মিলন ভাই তার রিকশা ছেড়ে এসে উঠলেন জালাল ভাইয়ের রিকশায়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই, রিকশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা পেরুনোর পথেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিক থেকে ঘাতকের বুলেট ছুটে এসে ছিন্নভিন্ন করে দেয় ডা. মিলনের হৃৎপিণ্ড। তাৎক্ষণিক জরুরিভিত্তিতে ডা. মিলনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সহকর্মী চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে অচিরেই ডা. মিলন ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
ডা. মিলনের মৃত্যুর খবরে শোকাহত ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক-ছাত্র-কর্মচারীরা গর্জে ওঠে বারুদের মতো। তাৎক্ষণিক ছাত্র সংসদ ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ডা. মিলন হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে জোরালো দাবি জানানো হয়। এ ব্যাপারে একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক ডাকেন তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক কবিরউদ্দিন। মিটিংয়ের আগে অধ্যাপক নাজমুন নাহার আমাকে আর ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ফরহাদ আলী খানকে কলেজ শহীদ মিনারের পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, 'আমরা পদত্যাগ করতে রাজি, তোমরা তোমাদের দাবি অব্যাহত রাখ'। একাডেমিক কাউন্সিলের সভা চলাকালীন আমরা সভাটিকে বাইরের থেকে ঘিরে রেখেছিলাম। সভা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগে এক বিশাল মিছিল বের হয়। মিছিলটি জগন্নাথ হল পেরিয়ে টিএসসিতে এসে পেঁৗছলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা যোগ দেয়।
ডাঃ মিলন, পুরো নাম শামসুল আলম খান মিলন। ডাঃ মিলন নামেই আজ তিনি গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী হয়ে সবার মাঝে বেঁচে আছেন। ডাঃ মিলন একজন সাহসী প্রগতিশীল রাজনীতিক ছিলেন। সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশে একটি প্রগতিশীল, আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন করাই ছিল তার স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে লালন করতে গিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিলেন তিনি।
ডাঃ মিলন বাংলাদেশে পেশাজীবী আন্দোলনের একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। নিজের চিকিৎসা পেশায় সেবা ও মানবকল্যানে নিবেদিত থাকার পাশাপাশি পেশার দক্ষতা, গুরুত্ব ও পেশাজীবীদের দাবী আদায়ে সব সময়ই ছিলেন আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকায়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্য দিয়ে এ দেশের চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনকে এবং পেশাজীবীদের সংগঠন (প্রকৃচি) আন্দোলনকে ডাঃ মিলন তার জীবনের বিনিময়ে দেশবাসীর সামনে গৌরবান্বিত করে গিয়েছেন তিনি।
গণ বিরোধী স্বাস্থ্যনীতি, চিকিৎসকদের ২৩ দফা বাস্তাবায়নের আন্দোলন করতে গিয়ে এক পর্যায়ে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করতে হলো ডাঃ মিলনকে। ডাঃ মিলন কেন স্বৈরাচারের টার্গেট হলেন? পেশাজীবীদের দেশ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নিয়ামক ভূমিকা পালনের স্বপক্ষে তিনি সক্রিয় ছিলেন এটাই কি তার মূল অপরাধ?
ডাঃ মিলন বিশ্বাস করতেন, পেশাজীবী আন্দোলন দেশের সামগ্রীক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তা না হলে রাজনৈতিক আন্দোলন বা পরিবর্তন পরিপূর্ণ হয় না। পেশাজীবীরা যেহেতু রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ অবকাঠামো গঠন এবং জনসেবায় যুক্ত থাকেন,সেহেতু তাদের দেশ ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক উন্নয়নে অন্তর্নিহিত নিয়ামক ভূমিকা অপরিহার্য। ডাঃ মিলনের এই চিন্তা চেতনাকে দমানোর জন্যই হয়তো তিনি স্বৈরাচারের টার্গেট ছিলেন। যেমনি এদেশের বুদ্ধিজীবীদের ৭১’ এ পাকহানাদার বাহিনী জাতিকে মেধা শুন্য করার জন্য নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
একজন মেধাবী চিকিৎসক, পেশাগত সততা, দক্ষতা, সাংগঠনিক কর্মতৎপরতায় ডাঃ মিলন ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ডাঃ মিলন তৎকালীন বিএমএর নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ এবং ঢাকা কলেজের বায়ো কেমিষ্ট্রি বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। তিনি পেশাজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রিয়জন ও প্রিয়মুখ ছিলেন।
আজ পেশাজীবী ও রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রিয়মুখ গণতন্ত্রের আত্ম নিবেদিত সৈনিক ডাঃ মিলনের ২০ তম শাহাদাত বার্ষিকী। অথচ কি বিচিত্র এই দেশ! যার রক্তের বিনিময়ে একটি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থানে রূপ নিল, দেশের এত বড় পরিবর্তন হলো, মৃত্যুর ২০ বছরেও ডাঃ মিলনের হত্যাকারীদের কোন বিচার হলো না।
ডাঃ মিলন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জীবনদান করেছেন। সেই গণতন্ত্র কতিপয় ক্ষমতা লিপ্ত, দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিক, অসাধু ব্যবসায়ী, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির হাতে বন্দী থাকতে পারে না। মানুষের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক মানবাধিকার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করে জন কল্যানমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হোক ডাঃ মিলন দিবসের অঙ্গীকার।