জহির যখন আদাবরের পেট থেকে আলগোছে বেরিয়ে আসল রিং রোডে, ৭টা কি সোয়া ৭টা, তখনো শহরটা আরমোড়া ভেংগে পুরোপুরি উগলে দেয়নি সন্ত্রস্ত মানুষগুলোকে। একটা রিকশা নিতম্ব দুলিয়ে জহিরকে প্ররোচিত করার চেস্টা করে খানিক, শেষে ব্যর্থ হয়ে বেনী ঝোলানো ঘুমঘুম চোখের তিনটে কিশোরীর কিচিরমিচির ভর্তি করে চলে যায়। জহির পা চালায় দ্রুত,শ্যামলী ওভার ব্রিজের নিচে লেগুনার একটা ফাঁকা সিট নিদেন পক্ষে পাদানির একটা অংশ দখলের তাড়ায় ও ছুটতে চাইলেও গতরাতের অঘুমো ছটপটানি রিংরোডের কালো পিচে ওকে গেঁথে ফেলতে চায়। জহিরের মাথার উপর হলদে এক ঝাঁক নাছোড়বান্দা মেঘ সওয়ার হয়, আদাবর থেকে শ্যামলী অব্দি তাড়া করে ফেরা হলদে মেঘের চোখ রাংগানি ওকে ঘামিয়ে ঝরে পড়ে পিঠ বেয়ে।
জহির লেগুনার ভেতর সেঁধিয়ে পড়ে নাকি লেগুনা ভর্তি ৬ জোড়া মানুষের অস্বস্তি ওকে টেনে নেয় বুঝে ওঠার আগেই আলু কি পেঁয়াজ ভর্তি চটের বস্তা আর রেক্সিনের ব্যাগ আঁকড়ে ধারা দু'বুড়োর মাঝে নিজেকে ফিরে পায়। ৬ জোড়া মানুষের চোখে টলটলে ঘূম, লেগুনার ঝাঁকিতে আরো গাঢ় হতে থাকে, এমনকি হেল্পারের চড়-চাপড় আর লেগুনার আচমকা লাগাম টানাও ঢুলুনি থেকে তুলতে পারে না ওদের শুধু শিশুমেলা পেরুনোর সময় নাকে শিকনি টানা এক ছেলে এর ওর বগলের তলা দিয়ে সিমেন্টের ডাইনোসর দেখার প্রয়াসে উঁকিঝুঁকি দেয় এবং শেষতক ডাইনোসর ওর চোখ ফাঁকি দিয়ে শিশুমেলার গুহায় ঢুকে পড়লে সড়াৎ করে শিকনি টেনে মায়ের বুকে ল্যাপটানো ওমে নাক গুঁজে দেয়।
জহির মাসের ২য় সপ্তাহের প্রথম দিনটার টানাপোড়েনে ধন্দে পড়ে যায়। ভাবে, কোন কারনে যদি বেতনটা ওকে ফাঁকি দিয়ে রশিদের ফাইলের ভেতর থেকে না বেরয়...একখানা রুম, আধখানা বাথরুম আর রান্নাঘরের ভাড়া,মুদি দোকানে লকলকিয়ে ওঠা খাতা আর রাবুর একজোড়া গোল্ড ফিশের চিন্তা জহিরকে লেগুনার ঠান্ডা রডটা আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে। জহির এর বেশি কিছু ভাবতে চায়না বা পারেনা, এই না চাওয়া এবং না পারার মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে জহির দেখে দুটো প্রায়-মানুষ লেগুনার কাশি দিয়ে থেমে যাওয়ার অভিনয়ের ফাঁকে, আগারগাঁ বিএনপি বস্তির সামনে, অবলিলায় রড ধরে ঝুলে পড়ে এবং ময়লা পলিথিনের মতো ল্যাগব্যাগ করে উড়তে থাকে। ৬ জোড়া মানুষের ঢুলুনি চটকে গেলে একজন খিস্তি কেটে ওঠে।
"অই, হারামজাদা, পিসনে দুইজন উঠাইছস ক্যা?" একজনের চিৎকার আরেকজনের মধ্যে সাহস হয়ে সেধিয়ে পড়লে কেউ কেউ খেঁখিয়ে ওঠে।
"শালা, টেম্পুডারে উল্টায় ফালাইবো তো!"
"আবার দ্যাহোনা, হিরোইনচি উঠাইসে দুইটা!"
হেল্পার লেগুনার পাছায় কষে চাপড়াতে থাকলে এইসব চ্যাঁচামেচিখিস্তিখেউড় বিজয় স্মরনীর মোড়ে এসে ছিটকে পড়ে আর ল্যাগব্যাগে পলিথিনের প্রায়-মানুষ দুটো বাতাসে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ৬ জোড়া মানুষের কেউ কেউ ১ টাকা ঠকে যাওয়ার ভয়ে হেলপারের সাথে তর্কাতর্কি শুরু করলে, ফিরতি টাকা নিতে যেয়ে ১টা কয়েন জহিরের তর্জনি আর মধ্যমার ফাঁদ গলে দিব্যি পালিয়ে গেল। জহির পলাতক মুদ্রার খোঁজে ৬ জোড়া মানুষের জুতোর আনাচ-কানাচ, সিটের তলা, জংধরা পাটাতনের ক্যামোফ্লেজ হন্যে হয়ে তোলপাড় করে।
"বাদ্দেন বাই, ১ ডা ট্যাকাইতো, ১ ট্যাকাই কিসু অয় আইজকাইল?"
অধরা মুদ্রার পক্ষ নেয় একজন। নাগরিক হাওয়ায় কৌমার্য হারানো কয়েনগুলো কি নিজেদের আধুলি কি সিকে পর্যন্ত নামিয়ে ফেলেছে? তাহলে রাবু প্রতিদিন ওর পকেট হাতড়ে দলছুট এক-আধটা কয়েনের হদিস করে কেন? মরচে মোড়া ডানোর কৌটায় রাবু হপ্তায় দুটো কি একটা কয়েন টুপ করে ফেলে দিয়ে চকচোকে চোখে দেখে; যেনবা অতল কুয়োর জলে অনন্ত চাঁদ! রাবু প্রতিদিন কুয়োর জলে চাঁদের কনাগুলো গুনে দেখে
"দেখসো দুশো বিশ টাকা হয়ে গেছে! এই, বলো না দুইটা গোল্ডফিশ হবে না, জার সহ?"
"উম" অতল কুয়োর জলে টলটলে চাঁদ ঝলসে উঠলে বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিল জহির, এই ফাঁকে মুদি দোকানের গতমাসের জেরের লতাপাতা বিস্তৃত হয়ে প্রায় ছেয়ে ফেলেছিল গোল্ডফিশ দুটোকে।
২
শহরটা থকথকে টক বাতাসে আটকা পড়ে আছে, আর জহির আটকে পড়া বেসামাল শহরের যোনী দিয়ে নিয়ত বেরিয়ে আসা মানুষ গুলোকে দেখছে প্রতিদ্বন্দি দুটো বিলবোর্ডের ছায়ায়। যোনীসিক্ত মানুষগুলো ৬ নম্বর বাসে ঠ্যালাঠেলি করে উঠে পড়ে, কেউ কেউ; বাসটা গোত্তা খেয়ে আরো খানদুয়েক পিচ্ছিল মানুষ টেনে নিতে চাইলে, হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে না পড়ার অক্ষমতায় ম্রিয়মান হয়ে থমকে যায় এমনকি পরবর্তি বাসটা ভেঁপু বাজিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেলেও ঘোর কাটে না ওদের। জহির মাথা উঁচিয়ে হলদে মেঘের দংগলটাকে তালাশ করে, যেটা সারাদিন ওর মাথার উপর সওয়ার হয়ে আদ্ধেকটা ঢাকা শহর চষে বেড়ালো। বিলবোর্ডটা আড়াল হয়ে দাঁড়ালে জহির টের পায় হলদে মেঘের কামুক ঠোটের টানে বিলবোর্ডের মেয়েটার স্তন কেমন চুপসে যায় হঠাৎ। এইযে সারাটা দিন কখনো চিৎ হয়ে থাকা ফ্লাইওভার, তেড়েফুড়ে ঢুকে যাওয়া কাকরাইল রোড, ফার্মগেট আর মতিঝিলের জটপাকানো পাকস্থলিতে মোচড় খেতে খেতে শাহবাগের কাছে এসে নিজেকে উগলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিদ্বন্দি দুটো বিলবোর্ডের মাঝে, পকেটে রাবুর জমানো দুশো বিশ আর অফিসের কনভেন্স থেকে মেরে কেটে আরো তিরিশ টাকা, পিছ ছাড়ে না শালার জন্ডিস মেঘ আর দেখ মেঘের সাথে ঘোঁট পাকিয়ে কি সুন্দর এই আড়াইশটা টাকা গিলে খাওয়ার ধান্দা করে গোল্ডফিশ দুটো।
উজান ঠেলে যেতে যেতে জহির দেখে মাছ দুটো একটা তরুনীর কমলা ফতুয়ার ভাঁজে লুকিয়ে পড়লো। কখনো বা ঊর্দ্ধমুখি বেলুনের সাথে স্থির হয়ে ভাসে আবার ভোকাট্টা হয়ে ঝরে পড়ে স্কুল ফেরত একটা ছেলের আইসক্রিমে। খানিক বাদে জহিরের নিঃশ্বাষ চুরিয়ে মাছদুটো উড়ে গেল আদাবরের ১ খানা ঘর, আধখানা বাথরুম আর আধখানা রান্নাঘরে; নোনা দেয়ালে ওরা দুজন সৌন্দর্য বুনছিল,
"বুঝলা রাবু, টাকা আর জিনিস থাকলেই ঘর সাজানো যায়না, রুচি লাগে। আমাগো ম্যাডামের কথায় চিন্তা করো, ড্রইং রুমে তেমন কিসুই নাই। শুধু দুইটা গোল্ডফিশ ভর্তি একটা জার,তাতেই চেহারা চেন্জ হইয়া গেসে!"
দেয়ালের নোনা স্তনের আব্রু সাদাকালো পোস্টারের আঁচলে ঢাকার ফাঁকে বলেছিল জহির। জহিরের দেখা আর রাবুর অদেখা ম্যাডামের ড্রইংরুম যেখানে জহির কয়েক জন্মেও দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ, সেই ঘেরাটোপ থেকে বেরুতে পারেনা ও। গোল্ডফিশ দুটোর বেয়াড়া লেজের ঝালর সোনা ছেটাতে শুরু করে হঠাৎ, নোনা দেয়ালে ম্যাডামের ড্রইংরুমের আদ্ধেকটা গেঁথে গেলে জহির দেখে রাবু সেই আদ্ধেকটা ড্রইংরুমের আভিজাত্যে বেমালুম ঢুকে গেছে!
"বলো আমারে দুইটা গোল্ডফিশ কিনে দিবা?" ওর করতলে রাবেয়া, রাবু হতে হতে বলছিল।
"এইটা কুনো ব্যাপার? পাগলী! এই মাছগুলা খুব সস্তা, ১২০ টাকা জোড়া। সব মিলায়ে ২৫০ এর বেশি হবে না।" জহির করতলের আবেশেই হোক বা রাবেয়ার রাবু হয়ে ওঠার কারনেই হোক ২৫০ টাকাকে সস্তা করে ফেলেছিল সেদিন।
এখন, হলদে মেঘের নিচে মাসের ২য় সপ্তাহের প্রথম দিনটার টানাপোড়েনে, রশিদের ফাইলের নিচ থেকে না বেরুনো বেতনের আক্ষেপে শাহবাগ থেকে কাঁটাবনের পথটুকু দীর্ঘতর হতে থাকে। জহির মরিয়া হয়ে মাছদুটো খুঁজতে থাকে, ওদের কানকোই জহিরের চুরিয়ে যাওয়া নিঃশ্বাষের ছিটেফোটা তখনো লেগে ছিল, সাথে আদাবরের আধখানা ঘরের নোনা দেয়ালে ম্যাডামের ড্রইংরুমের আদ্ধেকটা, আর করতলে রাবেয়ার রাবু হয়ে ওঠার প্রবনতাও! ফুটপাতে পাছা ঘসটে চলা ফকিরের সানকিতে, হুশ করে বেরিয়ে যাওয়া তাতানো মানুষ আর কাঁচমোড়া দোকানের শার্সিতে... সবখানে মাছদুটোর ছায়াবাজি দেখে জহির। এমনকি ৩৮ দিনের মাসের হিসেব-নিকেশ, কলিগের কাছে ধার, মুদি দোকানে লকলকিয়ে ওঠা খাতা সবকিছু খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে বেয়াড়া মাছ। রাবুর মরচে মোড়া ডানোর কৌটায় জমানো কয়েন যা কিনা অতল কুয়োর জলে অনন্ত চাঁদের ছিটেফোটা বলে ভ্রম হয়, একসাথে জমাট বেধে পড়ে আছে ওর পকেটে। জহির পকেটের টুঁটি চেপে ধরে সজোরে, পাছে মাছ দুটো হামলে না পাড়ে।
মাছ তাড়িত জহির টের পায় সূর্য সংগমে হলদেমেঘের গর্ভিনী তলপেটটা কেমন কালো হতে থাকে আর নাছোড়বান্দা গোল্ডফিশ দুটো শাহবাগ থেকে কাঁটাবনতক সেই কালো চিরে-ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে, আবার গোত্তা খেয়ে নিচে নেমে বিদ্ধ করতে চায় ওকে। বৃস্টির অসন্তুস্ট ফোঁটা চুরমার হয় জহিরের চাঁদিতে, রাগত বৃস্টির তোড়ে ভেসে যায় ও কাঁটাবনের দিকে। ব্যাবহৃত কনডমের খোসা, চিপসের ঠোংগা আর সিগ্রেটের অসহায় মোথার সাথে ভাসতে থাকে জহির। ভাসতে ভাসতে কাঁটাবনের মোড়ে এসে বেপুথো আইল্যান্ডের ভাঁজে আটকে যায় নাকি ঘর-ফেরতা মানুষের বৃস্টিবিদ্ধ অবয়ব ভেংগে পড়লে সেই ভাংগনে ধরা পড়ে যায় , এই সব ভাবনার ফাঁকে ও দেখে সূর্যগন্ধি মেঘে পাক খেতে থাকা মাছদুটো চলে যাচ্ছে কাঁটাবনের সারিবদ্ধ দোকানের এক্যুরিয়ামের দিকে। জহির পকেটের টুঁটি চেপে ধরে, ধরেই থাকে!