আগের পর্বে আমি বাংলার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি “গায়ে হলুদ এর গান” নিয়ে পোস্ট দিয়েছিলাম। আর এই পর্বে থাকছে বাংলার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি “বিয়ের গান”।
আমার ছোট বেলায় দেখেছি বিয়ে মানেই ছিল সারা গ্রামের মানুষ রং আর কাদা মেখে ভুত সাজে বিয়ে কে উপভোগ করতে। কার বিয়েতে কে কত কাদা মেখেছে আর রং দিয়েছে সেই গুলোই ছিল আলোচনার বিষয়। বর যাত্রীদের ও নানা কায়দায় শায়েস্ত করত কন্যার বাড়ির মানুষ। কখন ও দয়ার গুড়া দেওয়া হত শরীরে কখনও বা জরি বা রং গুড়া। ক্ষেত্র বিশেষে বর যাত্রীদের খাবারে “জামাল ঘোটা”ও দেওয়া হত।
কখন ও কখন ও সেই সব মজা শুধু মজায় হয়ে থাকতো তবে মাঝে মাঝে সেটা বড় পীড়াদায়ক ও হয়ে দাঁড়াতো।
তবে সব সময় যে এমন করা হত সেটা নয়। স্থান, কাল, পাত্র বিশেষ ঘটনা আলাদা ও হত।
বাংলার সংস্কৃতিতে বিয়েতে বরাবর গান হয়। তবে দিন বদলের সাথে সাথে গানের ধরণ ও বদলে গেছে। এক সময় বিয়েতে আসে পাশের প্রতিবেশি বউ-ঝিদের বলা হত বিয়ের গান গাইবার জন্য। আর এর মধ্যে বিয়ের কনের উদ্দেশে যে সব গীত/গান গাইতো তার মধ্যে বিখ্যাত বা প্রচলিত গীত/গান ছিল এটা-
‘কালা বাইগুনের (বেগুনের) ধলা ফুল
রুমালে গাঁথিয়া তুল্
কইনা লো তোর দয়াল বাবাজির মায়া তুল্ ।
বরির (বরইয়ের) গাছে কুমড়ার ফুল
রুমালে গাঁথিয়া তুল্
কইনা লো তোর দয়া চাচাজির মায়া তুল্ ।’
বাংলার লোকগাঁথা সাহিত্য খুব সমৃদ্ধ। আর এলাকা বিশেষ পার্থক দেখা যায়। যেমন রংপুরের বিয়ের গানের চিত্র অনেক টা এই রকম-
“গাও তোলো গাও তোলো কন্যা হে
কন্যা পেন্দো বিয়ার শাড়ি।
এই শাড়ি পিন্দিয়া যাইবেন
তোমার শ্বশুর বাড়ি কন্যা হে।।
গাও তোলো গাও তোলো কন্যা হে
কন্যা পেন্দো নাকের ফুল।
পাতাবাহার চিরুনি দিয়া তুলিয়া বান্দো চুল কন্যাহে।।”
আবার টাংগাইলের বিয়ের গানের চরণ গুলো এই রকম-
“তার পরে পরাইল শাড়ি নাম আসমান তারা।
সেই শাড়িতে বান্দা আছে আসমানের তারা।।
তারপরে পরাইল শাড়ি নাম কনকলতা
সেই শাড়িতে লেখা আছে পরীরাণীর কথা।।”
আগে বিয়ে ও গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য আশেপাশের ‘গীত গাওনি’ মহিলাদের ডাক পড়ত। তবে এখন ও গান চলে তবে বিদেশী আর বাংলা ব্যান্ডের গান। আমি একদম এই গানের বিপক্ষে না তবে কিছুটা হলে ও বাংলার সংস্কৃতি এই গান গুলো বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে।
বিয়ের গান মানে যে সব সময় আনন্দের গান সেটা নয়। বাংলার সংস্কৃতিতে এই গানে বিরহের সুর ও পাওয়া যায়।
বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কনেকে তার এতদিনের চেনা বাবার বাড়ির সবার প্রতি যে মায়া মমতা জমেছে তা একে একে তুলে ধরা হয়েছে এই গানে। এ রকম অসংখ্য বিয়ের গান আছে যেখানে কনে বিদায়ের কথা আছে, আছে বিদায়ের সময় যে বেদনাবিধূর পরিস্থিতি তৈরি হয় তার বর্ণনা। এমনই একটি গানের কিছু অংশ -
‘মন বিন্দাইলাম বনে বনে
আরো কান্দন কান্দে গো মায়-ও বনে বনে
আরো কান্দন কান্দে গো মায়-ও নিরলে বসিয়া
আরো কান্দ কান্দে গো মায়ে ঠান্ডাতে বসিয়া
মায়-ও যদি দরদি হইতো
কোলের ঝি-ধন মায়-ও কোলে তো রাখিত।’
কনে-বিদায়ের আরেকটি গানে/গীতে দেখা যায়, স্বামীর ঘরে যাওয়ার আগে পাটের শাড়ি পরে বধূবেশে কন্যা এসে দাঁড়িয়েছেন তার বাপ-চাচার সামনে। এটি এমন একটি নাজুক সময়, যখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
পাটের শাড়ি পিইন্দা গো ঝি-ধন
বাবার ছানমন খাড়া গো ঝি-ধন
বাবার ছানমন খাড়া
হাইস্য মুখে দেও বিদায় বাবা
যাইতাম পরের ঘরেও বাবা
যাইতাম পরের ঘরে।
কারো লাগি পালছিলাম ঝি-ধন
রাজার চারহি (চাকরি) কইরা গো ঝি-ধন
বাদশার চারহি (চাকরি) কইরা
পরের পুতে লইয়া না যায় গা ঝি-ধনরে বুকে ছেল দিয়া
মাইঝাল খালি কইরা…’
মেয়েকে হাসি-মুখে বিদায় দিতে কি বাপ-চাচা বা স্বজনদের মন চায়? এত কষ্ট করে মেয়েকে বড় করেছি, এখন কিনা সেই মেয়েকেই পরের ছেলে নিয়ে যাচ্ছে আমার বুকে শেল দিয়ে, আমার কোল খালি করে। কিন্তু উপায় নেই এটাই চিরন্তন বাঙালি ঐতিহ্য। বাবা-মার এমন আহাজারির ভেতর দিয়েই একটি মেয়েকে বাবার ঘর আঁধার করে চলে যেতে হয় অন্যের ঘর আলো করতে।
আরো কত রকমের গান যে আছে। আছে বর-কনের গান, যেখানে বর অনুরোধ করছে কনেকে তার সঙ্গে যেতে। কনে জিজ্ঞেস করছে, বরের দেশে ভাতের কষ্ট আছে কি না, কাপড়ের কষ্ট আছে কি না। বর তাকে আশ্বস্ত করছে, জানাচ্ছে কনের যাতে কোনো ধরনের কষ্ট না হয় সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে। যেমন এই গানটি-
‘চলো চলো গো রইমান কইন্যা
ওই জানে আপনারই দেশে
তোমার দেশে যে যাইবামরে এলেম দুলা
ওই জানে ভাতের-নি কষ্ট পাইবাম
অন্তে না পন্তে গো রইমান কইন্যা আমন ধান বাইন্যাইবাম।’
নোয়াখালী অঞ্চলের বিয়ের গীতেও আছে একই বিষয়বস্তু, নতুন ও অপরিচিত একটি জায়গায় গিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাতে কোনো সমস্যা হবে কি না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কনে প্রশ্ন করছে তাকে নিতে আসা জীবন সঙ্গীকে।
“সোনার বাডার সোনালি
রূপার বাডায় পানি
হীরার বাডায় এইল্যা গো সুপারি
তবে কইন্যা চলো আপন রাজ্যে
তবে কইন্যা চলো আপন রাজ্যে
তোয়ার লগে গেলে রে
ভাতে কেল্লেশ পাইয়াম রে
সাইরে না সাইরে গো বিবি
আছে মাইল্যা ধানের ক্ষেতি।”
এই সব গান বা গীতের পর ও আছে “দামানের গান” অর্থাৎ জামাই বা বরের গানও। আর ও আছে বাসর শয্যার গান। কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খেয়ে ‘দামান’ পালংকে বসে আছে। কনে সেই ঘরে প্রবেশের পর স্বামী জিজ্ঞেস করছে, সে পাখা দুলিয়ে স্বামীকে বাতাস করতে পারবে কি না?
এই গানের চরণ গুলো অনেক টা এই রকম-
“কানচানা গুয়া খাইয়ারে দামান
পালংক দলিল রে
ওকি লাল কুমার ওই নারে
দরজা না খুলো দরজা না মেলো
বিবি না আইতো ঘরে গো
বিবি জানো আইবো গো ঘরে
পাঙ্খা-নি ইলাইতে জানে গো”
উত্তরে বিবি বলছে, এত বয়স হওয়া পর্যন্ত আমাকে কখনো কাউকে পাঙ্খা করতে হয়নি। ফলে ‘ওকি লাল কুমার, পাঙ্খা না ইলাইতাম জানি গো।’ এ শুনে ক্ষুব্ধ স্বামী উত্তর করছে এই ভাবে-
“তুমি যদি না অইগো পারো
আনো তোমার মায়েরে গো
আনো তোমার চাচীরে গো
ওকি লাল কুমার ওই নারে
আটানা পয়সার পাঙ্খারও লাগি
মায়েরে উডায়া গালি রে
আমার চাচীরে উডায় গালিরে…
আইয়ক আইয়ক দয়াল বাবা
কাইন্দা না কমু আমিরে
ওকি লাল কুমার ওই নারে
সেই না তত্ত্ব তুলুম রে দামান
আমার দেশে নিয়া গো
আমার রাইজ্যে নিয়া গো
ওকি লাল কুমার ওই নারে
তুমি বিবির লাইগা গো কইন্যা না যামু তোমার দেশে গো
না যামু তোমার রাইজ্যে গো…”
গানটিতে যে ঘটনার বিবরণ আছে, তা আমাদের সমাজে বিরল নয় বরং স্বাভাবিক ঘটনা
সিলেটের সংস্কৃতি সব সময় কিছুটা ভিন্ন। আর তাদের গায়ে হলুদের গানে ও কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া যায়। সিলেটি বিয়ের গান অনেক টা এই রকম-
“দেখছি কইন্যার মাথা ভালা ডাব নারিকেল জুড়ারে
দেখছি কইন্যার দাঁত ভালা আনারের দানারে
দামান্দেরও সাত ভাই সাত ঘুড়া ছুয়ারী
একেলা দামান রাজা চৌদল চুয়ারী
চৌদলের কিনারে পড়ে হীরা লাল মতিরে
চল যাই চল যাই দামান দেখিবারে।”
আমাদের দেশে এখন বহুল প্রচলিত বিয়ের গান মানে “লীলা বালী লীলা বালী ভর যুবতী সই গো” এই গান টা। যদি ও এটা অনেক পুরাতন একটা গান তবে সবার সামনে নতুন ভাবে আর পরিচিতি হুমায়ন আহমেদের মাধ্যমে। নেট ঘেঁটে পেলাম সম্পর্ন টা-
“লীলা বালী লীলা বালী ভর যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।
মাথা চাইয়া সিন্থি দিমু ঝাঝরি লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।
নাক চাইয়া নাকফুল দিমু মতিয়া লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।
কান চাইয়া কানপাশা দিমু পান্না লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।
গলা চাইয়া নেকলেচ দিমু সুনা লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।
আংগুল চাইয়া আংটি দিমু পান্না লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।
শরীল চাইয়া শাড়ি দিমু ঝাঝর লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।”
(গানটিঃ ছাতক ও দিরাই, সুনামগঞ্জ থেকে সংগৃহীত)
বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আমাদের প্রাণ। আর এই প্রাণ কে বাঁচিয়ে রাখার দায়িক্ত আমাদের সবার। বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনেক কিছু বিলুপ্তির পথে আর তার মধ্যে এই বিয়ের গান বা গীত অন্যতম।
বাংলার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি “গায়ে হলুদ আর বিয়ের গান”
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৬