বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রথম ও প্রধান শর্ত হল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। এখনকার সময় অনুসারে এই অনুষ্ঠান মানে হল, ছাদে বড় করে প্যান্ডেল টানিয়ে সারা রাত জেগে সব থেকে উচ্চ শব্দে ব্যান্ড সংগীত আর হিন্দি গান লাগিয়ে কাওকাও করা। আর তামাম দুনিয়ার মানুষের কান ব্যথা করা।
তবে এমন এক সময় ছিল যখন বাংলার সংস্কৃতি কে গুরুত্ব দেওয়া হতো আর গাওয়া হতো বাংলার সব বহুল প্রচলিত গায়ে হলুদের আর বিয়ের গান। তবে এই গানের কথা হয় তো আমরা ভুলে গেছি। আর যাদের মনের কোন এক কোণে একটু হলে ও ঠাঁয় করেছিল সেই সব গান গুলো সেটা হয়তো কালের গ্রাসে আমাদের মন প্রায় ভুলতে বসেছে। আর আজ তাই সেই সব গায়ে হলুদ আর বিয়ের গানের কথা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বসলাম।
আজকের পোস্ট গায়ে হলুদের গান নিয়ে।
বিয়ে শব্দটা শুনলে সবার প্রথমে মনে পড়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের কথা। শহরের অনুষ্ঠানের সাথে যদি ও গ্রামের অনুষ্ঠান মেলানো যাবে না। তবে এখন প্রায় সব সমান হয়ে গেছে।
এক সময় গ্রামের মহিলারা এই দিন বিভিন্ন ধরণের গায়ে হলুদের গান গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করতেন তাদের মত করে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের সময় সকলে মিলে গোলাকার হয়ে বসে গানের জলসা তৈরি করতো এবং যারা গান গায়তেন তারা চারপাশ ঘুরে ঘুরে গান পরিবেশন করতেন। অনেকে আবার ছদ্দ বেশে ও গান পরিবেশন করতেন। আর নিজেরা সাজতেন বিভিন্ন চরিত্রের রুপে। এই গানের জন্য গানের কন্ঠ ভাল ভাল হওয়া প্রয়োজন হত না। অনেক সময় এই গানের তালে তালে সুতার গোলক ধাঁধা ও করা হত। অনেকে মিলে একটা গান গায়তেন আর বিভিন্ন ভাবে সুতার প্যাঁচ দিয়ে বিয়ের কন্যাকে আটকাতেন। এই সুতার গোলক ধাঁধা গানের কথা আমার নানীর মুখ থেকে শোনা।
লোকসাহিত্যের মধ্যে সব থেকে প্রচলিত আর জনপ্রিয় গায়ে হলুদের গান হলো এটি-
‘কালা বাইগুনের (বেগুনের) ধলা ফুল
রুমালে গাঁথিয়া তুল্
কইনা লো তোর দয়াল বাবাজির মায়া তুল্ ।
বরির (বরইয়ের) গাছে কুমড়ার ফুল
রুমালে গাঁথিয়া তুল্
কইনা লো তোর দয়া চাচাজির মায়া তুল্ ।’
আরেকটি গান ও আছে যেটা কম জনপ্রিয় না। সেটা হল-
“কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে
মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে
হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে
বাবা দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে।”
বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রাজশাহী অঞ্চলের বিয়েতে বর-কনেকে গোসল করানোর সময় একপ্রকার বিশেষ নাচের প্রচলন দেখা যায় যেটা বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া যায়। বর-কনেকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী নারীরা এ নাচের আয়োজন করে থাকেন। তারা ধান, দূর্বা, পান, কড়ি ইত্যাদি দিয়ে বিয়ের নাচে অংশগ্রহণ করেন। এ ধরণের নাচে বিশেষ ধরণের গানও প্রচলিত রয়েছে। যেমন-
একটু ঠিকর করে লাচরে ভাবের মার্যানী,
একটু গিদার করে লাচরে ভাবের মাল্যানী।
তোকে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনী
তোকে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনী।
পল্লী-গাঁয়ের বিয়ের উৎসবের গানের কথা বা চরণ এক সময় এমন ছিল-
"উলু উলু মাদারের ফুল-।
বর আসছে কত দূর।।
বর এসেছে বাগনা পাড়া
বড়ো বউ গো রান্না চড়া।
ছোটো বউগো জলকে যা।।"
ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের গায়ে হলুদের সময় গোসলের ও আলাদা গান গাইতে দেখা যেত। আর এই গান গাওয়া হতো কন্যার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর গোসল করানোর সময়।
‘পাতা পানিত নাইম্যা লীলা পাতা মাঞ্জন করে,
গলা পানিত নাইম্যা লীলা গলা মাঞ্জন করে।’
কিশোরগঞ্জের প্রচলিত বানুর গোসলের গানেও আছে একই বর্ণনা-
‘আডু (হাঁটু) পানিত নাইম্যা বানু আডু মাঞ্জন করে
কমর (কোমর) পানিত নাইম্যা বানু কমর মাঞ্জন করে।’
আজ থেকে দশ-পনের বছর আগেও গ্রামের বিয়েতে বিশেষ করে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ‘গীত গাওনি’ মহিলাদের ডাক পড়ত। আর সেই সব ‘গীত গাওনি’ আলাদা একটা দল ও ছিল। যাদের খুব সমাদর করে অনুষ্ঠানে আনা হত। অনুষ্ঠানের পূর্ণ রুপ দেবার জন্য।
তবে এখন ও কিছুটা এটা দেখা যায় এই প্রচলন। সাম্প্রতিক সময়ে আমি এক বিয়ের অনুষ্ঠানের গিয়ে এটা দেখলাম। এখন ও কিছু মানুষ আছে যারা এই সংস্কৃতি কে ধারণ করে রেখেছে। তারা এখন গলা ছেড়ে সেই সব গীত ধরে, যা আমরা অনেকে আগে কখন ও শুনিনি।
আমার পরবর্তী পোস্ট হবে লোক সাহিত্যের বিয়ের গান নিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:০৮