আজ রমনার চিরাচরিত চঞ্চল আর প্রাণবন্ত রুপটা যেন নেই। গাছগুলো কে অনেক বেশি হিজিবিজি আর বেমানান মনে হচ্ছে নয়লির কাছে। নয়লি ঠিক যে বেঞ্চয়ে বসে আছে; তাঁর সামনে একটা বিশাল কাঞ্চন গাছ। আর সেই গাছ জুড়ে ধরে আছে থোকা থোকা সাদা কাঞ্চন ফুল। তবে তাঁর কাছে এই সাদা কাঞ্চন ফুলের সাদা রং টা খুব চোখে লাগছে, এই ক্যাঁটকেটে রোদের জন্য। মাঝে মাঝে চোখ জোড়া জ্বলে যাচ্ছে নয়লির, সেই সাদা কাঞ্চন ফুলের চোখ ঝলসানোর উৎপাতে।
পায়ের কাছের ঘাস গুলো কে একে বারে ন্যাড়া মনে হচ্ছে তাঁর। মনে হচ্ছে কেউ যেন খাবলে উঠিয়ে নিয়েছে সবুজ ঘাস গুলো কে। নয়লি যে বেঞ্চয়ে বসে আছে তাঁর ঠিক পিছনে পার্কের কর্মচারীরা ঘাস কাটতে লেগেছে কিছুখন আগে থেকে। কাঁচা ঘাসের ঘ্রাণ তার খুব ভাল লাগে কিন্তু আজ খুব উটকো লাগছে ঘ্রাণ। এক কথায় বলা যায় এ সব কিছু খুব অসহ্য লাগছে নয়লির কাছে।
নয়লির পাশে বসে আছে অনঘ। আর সে এখন নয়লি এর কাছে দুনিয়ার শ্রেস্ট অপরাধী। শুধু যে অপরাধী তা নয় ঘৃণার পাত্র ও বটে।
নয়লি একে বারে কাকের মত কর্কশে গলায় আর ভাব বাচ্যে বলে উঠলো অনঘ কে উদ্দেশ্য করে
- কি প্রয়োজনের আমাকে এইখানে আসতে বলা হয়েছিল ? আমি কি সেটা জানতে পারি ?
- তুমি এই ভাবে কথা বলো না আমার সাথে ? প্লিজ নয়লি
- তো, কি ভাবে কথা বলতে হবে আমাকে ?
- আমি তো বলেছি আমার ভুল হয়েছে। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি ডল-টা।
- এই সব মুখের কথায় আর চিড়া ভিজবে না কখনও। আমি আর তোমার সাথে কেন সম্পর্ক রাখতে চাই না। তোমার যা খুশি তুমি তাই করতে পারো। আর ফ্যাস ফ্যাস করে কেঁদে ও কেন লাভ হবে না। আর যাই হোক তাতে আমার মন গলবে না এটা জেনে রেখো।
- এই ভাবে আমাকে শাস্তি দিয়ো না প্লিজ। আমাকে ক্ষমা করবে না তুমি ? আমি তো স্বীকার করেছি, আমি মিথ্যা বলেছি তোমাকে।
- যে মিথ্যা বলেছ সেটা কি বলার মত ছিল। আর যাই হোক সেটা মশকরা করার মত ব্যাপার ছিল না। তুমি জানতে আমি তোমার তিন বছরের বড়, আর তুমি !! সুন্দর করে বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলে তুমি আমার সমবয়সী। এটা কি মশকরা করার মত কোন ব্যাপার ছিল !! ? আর যদি আমি সত্যিটা জানতাম তাহলে কখন ও তোমার সাথে কোন সম্পর্কে জড়াতাম না। কারন আমাকে সমাজে থাকতে হবে আর এই অসম বয়সী সম্পর্ক কেউ ভাল চোখে দেখে না। সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে "দেখো দেখো নয়লি একটা কচি ছেলের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে"।
- প্লিজ এই ভাবে বলো না। আমি জানি, আমি ভুল করেছি। তোমাকে তো আমি সত্যি বলেছি, প্রথমে বিষয়টা মজা করে বলে ছিলাম; যে আমি তোমার সমবয়সী। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি তখন আর সাহস হয়নি তোমাকে সত্যিটা বলার। কারন আমি তোমাকে যত খানি চিনেছি সেটাতে নিশ্চত ছিলাম, সত্যি জানার পর তুমি আর আমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চাইবে না। আর সেই ভয়ে আমি এতদিন তোমাকে কিছু বলিনি। কারন আমি তোমাকে হারাতে চাই না।
সত্যি বলছি নয়লি, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।
নয়লি এবার আর ও কঠিন আর রুক্ষ হয়ে বললো - যে সম্পর্কের সুচনা মিথ্যা দিয়ে সেই সম্পর্ক কে আর যাই হোক; আমার পক্ষে আর বিশ্বাস করা সম্ভব না।
অনঘ এর মনটা একেবারে দমে গেলো; নয়লির এই কঠিন কথা শুনে। সাথে মাথাটা ও ঝিমঝিম করতে লাগলো। আবার ও হতাশা আর হারানের ভয় তাকে গ্রাস করতে শুরু করলো মুহূর্তের মধ্যে। যেন কেউ তাকে অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড গতিতে,এই এক নিমেষে মধ্যে। ঠিক এই হারানের ভয়ে এত দিন নয়লির সাথে মিথ্যা অভিনয় করেছিল সে বয়স নিয়ে। আর আজ, সেই অন্ধকারেই তলিয়ে যাচ্ছে তাদের সম্পর্ক। এক পলকে ভালবাসা চলে এসেছে শূন্যের কোঠায়। আর বিশ্বাস, সেটার আর কোন মুল্য নেই এখন নয়লির কাছে। কারন সে নিজের হাতে সে পথ ধ্বংস করেছে।
নয়লির কথা শেষ হবার কয়েক মুহূর্ত পর অনঘ বলে উঠলো ''বেশ, এইটাই যদি তোমার শেষ কথা আর সিধান্ত হয় তাহলে আমি আর কি বললো"। শুধু তোমাকে এইটুকু বলতে চাই "হ্যাঁ এটা ঠিক, শুরুটা মিথ্যা ছিল কিন্তু আমার ভালবাসা মিথ্যা ছিল না। আর সমাজের কথা বললে তুমি ; সমাজ মানুষ সৃষ্টি করে। সমাজে এমন অনেক অসমবয়সী বিবাহিত দম্পতি আছে, যার দিব্বি সংসার করছে। আর তাঁরা যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারবো না ?।'
তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ "আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যেও না...... প্লিজ"
অনঘ এর কথা শেষ হবার পর নয়লি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বলে উঠলো
- আমি স্বাভাবিক জীবন চাই। কোন ব্যতিক্রম জীবন আমার পছন্দ না। আর সমাজের অসম-বয়সী সম্পর্ক কে ব্যতিক্রমী ঘটনা মনে করা হয়। আর ঐ সব বিবাহিত দম্পতিদের আঁড় চোখে দেখা হয়। আমি আর আট-দশটা মানুষের মত জীবন চাই।
তোমার কাছে ও আমার একমাত্র আর শেষ অনুরোধ; দয়া করে আমার সাথে আর দেখা করার চেষ্টা করো না। আমার জীবন থেকে তুমি সরে দাঁড়াও।
কথা শেষ হওয়া মাত্র নয়লি উঠে দাঁড়ালো আর রমনার কংক্রিটের রাস্তা ধরে হনহন করে হেঁটে যেতে লাগলো। অনঘ ও উঠে দাঁড়িয়ে ছিল নয়লির দেখা দেখি কিন্তু নয়লি রুক্ষ কন্ঠে বলে গেছে যাবার সময় "আমি বেরিয়ে যাবার পর তুমি বের হবে, আমার সাথে না।"
অনঘ তাকিয়ে রইল নয়লি চলে যাবার পথের দিকে। সে একবার ও পিছনে ফিরে তাকাবে না এটা জানে অনঘ। কিন্তু তাঁর পরও অনঘ তাকিয়ে রইল নয়লির চলে যাওয়া পথের দিকে।
অনঘের মনে বার বার একটা চিন্তাই ঘুরপাঁক খেতে লাগলো "ও কি একা একা রাস্তা চিনে বের হতে পারবে রমনার থেকে ? ও তো কখনও একা একা রমনার থেকে বের হয়নি"
জীবনের সব ছক নিজের ইচ্ছা মত কাটা যাই না। নয়লির জীবনে ও ঠিক সেই রকম কিছু ঘটে ছিল। নয়লি চেয়ে ছিল অনঘ এর সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না আর সে ব্যতিক্রম সম্পর্ক চাই না কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। নয়লি এই সম্পর্ক না রাখতে চাওয়ার ঘোষণার পরের রাতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে অনঘ। এক পর্যায়ে তাকে ঘরের দরজা ভেঙ্গে বের করতে হয় আর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় জরুরী ভিত্তিতে। অতঃপর অনঘ এর বন্ধুদের অনুরোধে তাকে দেখতে যাওয়া নয়লির আর আবার ও নতুন করে তার প্রেমে পড়া। শেষমেষ আবার ও দুজনে তাদের ভুল গুলো শুধরে নতুন করে একসাথে পথ চলার প্রতিঙ্গা করে।
এবং অনেক চড়ায় উৎরাই পেরিয়ে আর নিন্দুকদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবশেষে তাঁরা বিয়ে করে পাঁচ বছর পর দুই পরিবারের সম্মতি ক্রমে।
স্বর্গীয় প্রেম হয়তো এমনই নয়। মানে না কোন বাঁধা, মানে না সমাজের প্রচলিত নিয়ম আর বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না বয়সের পার্থক্য। আর তাই হয়তো ভালবাসা অমরত্ব নিয়ে এসেছে এই ধরাধামে সকলের জন্য।
আমার Facebook Page : Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ২:৩৬