আমার রিকশায় করে ঘুরতে বেশ ভাল লাগে। কিন্তু অর্থাভাবে ঘুরতে পারি না। অবশ্য আরও একটা কারন আছে। সেটা হচ্ছে, রিকশাওয়ালারা আবার আমাকে যথাসম্ভব অ্যাভয়েড করে। একে তো পুরুষ, তাও আবার সিঙ্গেল! রমণীরা রিকশায় উঠলে তিনারা আবার বিশেষ গতিবেগ প্রাপ্ত হন। অন্তত রিকশায় উঠার জন্য হলেও খুব দ্রুত মিঙ্গেল হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আপাতত দিচক্র যান ই আমার সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ সঙ্গী।
এক অলস বিকেলে দিচক্র যান নিয়ে ঘুরছি। আর আনমনে জীবন নামক ট্র্যাজেডির খাতা খুলে পাওয়া না পাওয়ার অসম সমীকরণ সমাধান করার চেষ্টা করছি। দক্ষ গণিতবিদই এই সমীকরণ সমাধান করতে পারে না, আর আমি তো কোন ছাড়! এভাবে চলতে থাকলে পাগল হতে বেশীদিন লাগবে না। চিন্তাটা দ্রুত ডাইভারট করতে হবে।
কি নিয়ে চিন্তা করা যায়! ভাবতে ভাবতে এক দোকানের সোকেসে সাজানো Marlboro এর প্যাকেট এর দিকে চোখ পড়ল। নেশাতুর চোখ নেশা দ্রব্যের দিকেই ধাবিত হয়! Marlboro টপিকসটা সময় কাটানোর জন্য খারাপ না। Marlboro লেডিস নাকি জেন্টস সিগারেট চিন্তার বিষয়। Marlboro এর অ্যাডগুলো দেখে এর চাইতে পৌরষদীপ্ত সিগারেট কল্পনা করা সত্যিই কঠিন। অথচ তাদের ফিল্টার সিগারেটের স্লোগান হল Mild as May । মে মাসের লাবণ্য যোগ হয়ে Marlboro পুরোদস্তুর রমনীয় কমনীয় সিগারেটের প্রতীক।
চিন্তা করতে করতে একদল রমণীর দিকে চোখ পড়ল। দল বেঁধে যাওয়া আর কাঁধে ব্যাগ দেখেই বলে দেয়া যায় প্রাইভেট পড়ে ফিরছে। এদের মধ্যে অনন্যার দিকেই দেখলাম অপলক দৃষ্টিতে তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে আছে অনেকগুলো চোখ। আমার বন্ধুদের মতে অনন্যা ড্যাম স্মার্ট! যেন খাপ খোলা তলোয়ার! একটা ধারালো অস্ত্রের সাথে সবাই প্রেম করতে চায় কেন, কে জানে! আমার আবার অস্ত্রপাতি দেখলে ভয় করে। এই মেয়ের সাথে প্রেম! মনে হবে সাথে একটা অস্ত্র নিয়ে ঘুরছি, তাও আবার খাপ নাই! যে কোন সময় অঘটন ঘটতে পারে। ডেঞ্জারাস!
[নামগুলো অবশ্য পড়ে জেনেছি]
আঁকানো ঠোঁটের আর্টিফিশিয়াল বাঁকানো হাসি আমাকে মোহিত করে না, আমার চোখ তাই সায়নার দিকে। উজ্জল শ্যামলা, এক হারা গড়ন, চোখে যেন সাগরের গভীরতা। সেই সাথে কমলার কোয়ার মতো তৃষ্ণা জাগানিয়া ঠোঁট। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। ভার্সিটি লাইফ আমার কত পরিবর্তন নিয়ে এসেছে ভাবতেই অবাক লাগে। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি থেকে এসেছি বলে একটু কনজারভেটিভ টাইপ। স্কুল-কলেজে মেয়েদের সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারতাম না, আর সেই আমি আজ! নির্লজ্জের মত একটা মেয়ের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি। বাবার আর্দ্র চোখ, মায়ের অশ্রুবাষ্প, সব পিছুটানের সীমারেখা ছেড়ে দুর্নিবার পথে ছুটে চলেছি।
মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। প্রথম দেখা থেকেই বুকের ভেতর কেমন যেন একটা অনুভুতি। কিভাবে তার সাথে কথা বলব ভেবেই কূল পাচ্ছি না, প্রপোজতো অনেক দূরের কথা! কিন্তু প্রেম এর ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় প্রপোজ। প্রেম হবে কি না তা অনেকটা নির্ভর করছে প্রপোজ করার ওপর। ভাল মত প্রপোজ করতে পারলেই নাকি প্রেম হয়ে যায়।
একবার ভাবলাম চিঠি দিলে কেমন হয়? কিন্তু এই যুগে কি কেউ চিঠি দেয়? আর কেউ যদি দেখে ফেলে? ধরা পড়লে সব শেষ। ব্যতিক্রম কিছু একটা করতে হবে। কি করা যায়, কি করা যায়, হুম ফ্রেন্ডশিপ। ফ্রেন্ডশিপ থেকে ফ্রেমশিপ আই মিন প্রেমশিপ। প্রেম নামক এই শিপ আমার বাইতেই হবে। “বাই হুক অর বাই ক্রুক”
পরদিন একই সময়ে উপস্থিত হলাম। সায়নাকে দিচক্র যান নিয়ে ফলো করলাম। তার অনেক কাছ দিয়ে ঘুরে এলাম। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। “সো ক্লোজ বাট সো ফার”
মাঞ্জার এর দ্বারস্থ হলাম। জানতাম ফাজিলটা কোন সমাধান দিতে পারবে না। কি মনে করে যে গেলাম ওর কাছে!
মাঞ্জারঃ শোন তোকে একটা জোকস বলি,
হাবলু এক মেয়েকে প্রপোজ করলো। মেয়েটি রেগে গিয়ে হাবলুকে অনেকগুলো থাপ্পড় মারল।
এরপর স্যান্ডেল দিয়ে মারতে লাগলো। মারতে মারতে হাবলুকে মাটিতে ফেলে দিলো। হাবলু উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় পরিষ্কার করতে করতে বলল, “আমি কি তাহলে উত্তর ‘না’ ধরে নিব?”
রুমমেটরা সব হাবলুর স্থানে আমাকে কল্পনা করে হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। অন্য সময় হলে আমিও তাই করতাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমি কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
চাঁদের আলোয় ধুম্রশলাকা ধরালাম। নিকোটিনের সংস্পর্শে মস্তিষ্কের সমস্ত নার্ভ গুলো যেন নেচে উঠলো । এই একটা জিনিস আমার সাথে কক্ষনো বিট্রে করে না। খুব দ্রুত ভাবনাগুলোকে একমুখী করে দেয়। বুঝতে পারলাম যা করার নিজেই করতে হবে।
এর পরদিন ল্যাম্পপোস্ট এর কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আজ কিছু একটা করতেই হবে “হয় এস্পার না হয় ওস্পার”। সায়নাকে একা দেখতে পেয়ে কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলাম। হৃদপিন্ডটা পেন্ডুলামের মতো দোল খেতে শুরু করল।
সায়নাঃ বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি আমাকে ফলো করছেন। কারণ কি?
কানের পাতা গরমে লালচে হয়ে উঠেছে, ভোকাল কর্ড ঠিকমত কাজ করছে না। গলার স্বরের কম্পাঙ্কও আজ স্বচ্ছন্দ নয়। কোন রকম নিজের পরিচয় দিলাম। কিন্তু সায়না যা বলল তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
সায়নাঃ তো?
আমিঃ আমি তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই।
সায়নাঃ একজন ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কখনও ফ্রেন্ডশিপ হয় না। আর আমার গার্জিয়ান দেখলে খবর আছে! [শেষ কথাটায় কোথায় যেন প্রশ্রয়ের সুর, তাই আমি এক স্টেপ অগ্রসর হলাম]
আমিঃ আমরা মোবাইলে কথা বলতে পারি। আমার মোবাইল নাম্বার ০১৭১.......। তোমারটা?
সায়নাঃ কাগজে লিখে দিন। আর আমি যাকে তাকে মোবাইল নাম্বার দেই না।
যাকে তাকে? বুঝলাম আমার পজিশন কোথায়। নাহ! যতটা এগিয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে গেলাম। ব্যাক টু দ্যা প্যাভিলিয়ন। এই মেয়ে কোনদিন কল করবে বলে মনে হচ্ছে না। মেয়েরা এসব ক্ষেত্রে বেশ হিসেবি হয়।
পরদিন লাস্ট ট্রাই করার জন্য সেম টাইম, সেম প্লেসে ওয়েট করছিলাম। সায়না অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল। আমি অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে কথা শুরু করতে যাব এমন সময় সে চমকে উঠে রাস্তার উপর পড়ে যেতে ধরল। আমি হাত বাড়িয়ে পড়ে যাওয়া রোধ করলাম। সায়না লজ্জাবতীর ন্যায় তার লতা(বাহু) গুটিয়ে নিল। ভীত হরিণীর ন্যায় আমার দিকে একবার তাকিয়ে সোজা চলে গেল। কি ভাবল কে জানে? তীরে এসে তরী ডুবিয়ে দিলাম! ডুবন্ত তরীর গতিপথে নির্বিকার চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
বিষণ্ণ মনে রুমে ফিরলাম। কিছু ভাল লাগছিল না। গেমসগুলোও কেন যেন পানসে লাগছে আজ। হাওয়া খাওয়ার জন্য ব্যালকনিতে আসলাম। ধুম্রশলাকা ধরিয়ে মনে হল মায়ের হাতে এক-কাপ চা খেতে পারলে মন্দ হত না। বেশ কিছুদিন মায়ের সাথে কথা বলা হয় না। এক মেয়ের পিছনে ধর্না দিতে গিয়েই এই অবস্থা। মাকে কল করতে যাব এই সময় আন-নোন নাম্বার থেকে ফোন এল, টি-অ্যান্ড-টি নাম্বার।
আমিঃ হ্যালো স্লামালাইকুম।
অপজিট এন্ডঃ আপনি কি স্বপ্নাতুর বলছেন?
আমিঃ হ্যাঁ।
অপজিট এন্ডঃ আমি সায়না।
কণ্ঠ পরিচিত মনে হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই চিনতে পারছি না। ব্রেনের সমস্ত নার্ভগুলোর উপর চাপ পড়ছে, একসময় ভারটিগো হতে লাগল। কিন্তু চিনতে পারলাম না। আজ দিনের সাথে সাথে মনে হচ্ছে রাতটাও খারাপ!
অপজিট এন্ডঃ মনে করতে পারছেন না? গতকাল নাম্বার দিলেন, আজ সন্ধ্যায়......
ওহ! মনে পড়েছে ওর নাম তা হলে সায়না! বেশ স্টাইলিশ নেম। নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল, নামটাও জানি না!
সায়নাঃ কি চিনতে পেরেছেন, এখন?
আমিঃ (আমতা আমতা করে) আ হ্যাঁ।
সায়নাঃ গুড। যে সময় ঘাপটি মেরে সাইকেল নিয়ে বসে থাকেন সেই একই সময়ে আগামীকাল কফি-শপে আসবেন। আর এভাবে ভূতের মত অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসবেন না। আমার হার্ট উইক। আজ তো আর একটু হলেই এক্সিডেন্ট হয়ে যেতাম [বলেই হাসতে লাগল, বাঁধ ভাঙ্গা হাসি] রাখি।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাইনটা কেটে দিল। মেয়েটা এত নিষ্ঠুর! কত কথা বলার ছিল, কিংবা শোনার। কল যে ব্যাক করব তারও তো উপায় নেই। মোবাইল নাম্বারটাও দেয় নি।
কথা বলার রেশ এখনো কাটেনি আমার। কিছুক্ষণ মোবাইল স্ক্রিন এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সায়নার হাসির ফ্লেভার এখনও লেগে রয়েছে সেখানে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:১৭