উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। ভাবছি, শহরের মানুষগুলো কেমন যেন যান্ত্রিক। কর্মচঞ্চল মানুষগুলো যে যার মত ছুটে চলেছে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবলোকন করার মত অবকাশ কারও নেই। গোধুলির এই সময়টা আমার বেশ লাগে। অপরূপ সৌন্দর্য যেন ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যেতে চায়। আকাশে বিভিন্ন রঙের ছটা, কোথাও গাঢ়, কোথাও হালকা, কোথাও একেবারে মিলিয়ে গেছে। পাখিরা সব ঝাঁক বেঁধে নীড়ে ফিরছে। তাদের মাঝে আমার পাখিটাও আছে।
আপাত দৃষ্টিতে আমার ভাবভঙ্গিতে বেকার যুবকের নির্লিপ্ত দৃষ্টি। কিন্তু এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল, এক পা প্যাডেল এ রেখে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি, কখন পাখি তার দলছুট হবে।
পথচারীঃ এই যে ভাই, সাইকেলটা নিয়ে একটু সাইড হয়ে দাঁড়ান।
চিন্তায় ছেদ পড়ায় মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ফারিয়ার সাথে দেখা করতে আসলে প্রতিদিনই কোন না কোন ঝামেলায় পড়তে হয়, সেই তুলনায় এটা কিছুই না।
সবগুলো প্রাইভেট একই জায়গায় (টিচার্স কোয়ার্টার) পড়ার কারণে সপ্তাহে ৭দিন ই দেখা করার স্কোপ থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝেই মিস হয়ে যায়। বুঝলেন না! যেদিন বডিগারড সাথে থাকে। মা কিংবা বাবা মাঝে মাঝে আসেন, সেটা আমার জন্য সমস্যা না। সমস্যা হল যেদিন ওর ফারজানা আপু আসে। শকুনি চাহনি দিয়ে সব কিছু অবসারভ করতে থাকে। আর ফারিয়া গাধাটা ( গাধার স্ত্রী লিঙ্গ কি! গাধী নাকি মহিলা গাধা!) আমার দিকে বারবার তাকানোর চেষ্টা করে। অন্যান্য দিন না তাকালেও সেদিন এই কাজটা সে বারবার করবেই! কি যে বুঝাতে চায়! আমার জানা নেই। এজন্য আপুকে দেখলেই আমার দিচক্র-যান নিয়ে আমি হাওয়া হয়ে যাই। ধরা পড়লে আমার গণধোলাই নিশ্চিত। পাবলিক শুধুমাত্র মেয়েদের বিশ্বাস করে! তাই আমার কোন মতেই ভুল করা যাবে না।
আজ সাথে কেউ নেই দেখে ভাল লাগল। কিন্তু এত জোরে হাঁটছে কেন? মনও বেশ খারাপ মনে হচ্ছে। আরে এ যে ল্যাম্পপোস্ট ক্রস করে চলে যাচ্ছে! এই ল্যাম্পপোস্টটা আমাদের মিলন স্থান। লাইট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মুখ অস্পষ্ট দেখা যায়, এটা একটা সুবিধা। আবার আশেপাশের দোকানের লাইটের কারণে কার্যক্রম দেখা যায়, যার ফলে কেউ অমূলক সন্দেহ কিংবা বিরক্ত করে না। একদমই যে করে না, তা না! তবে সেটা ইগ্নোর করা যায় আর কি!
ফার্স্ট ডেসটিনেশন ক্রস করে যাচ্ছে। তার মানে সেকেন্ড ডেসটিনেশন এ ল্যান্ড করতে হবে, কফি-শপে ঢুকতে হবে। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। না হলে তো সেকেন্ড ভেনু সিলেক্ট করার কথা না। এটা বেশ নিরিবিলি এসময়, আমার জন্য নিরাপদ (আমার জন্য হলেও আমার মানিব্যাগের জন্য নয়)
ঢুকেই কফি অর্ডার করল ফারিয়া।
ফারিয়াঃ ভ্যাগাবন্ড লাইফ-স্টাইল্টা চেঞ্জ কর। তোমার লেখাপড়ার কি দশা?
আমিঃ কি আবার! বেহাল অবস্থা। (এইটুকুন মেয়ের মুখে এসব ভারিক্কি কথা শুনতে ভাল লাগে না, কিন্তু মেয়েদের ম্যাচুরিটি নাকি আগে আসে! )
আচ্ছা আমি কি কক্ষনো তোমাকে এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন করেছি?
ফারিয়াঃ (মুখ গোমড়া করে )রেজাল্ট খারাপ করেছি। মা, বাবাকে ছেলে দেখতে বলেছে। মার ভাষ্যমতে বাচ্চা মানুষ করার মত বয়স, লেখাপড়া দুটোই হয়েছে।
প্রচন্ড হসি পেলেও সেটা গোপন রেখে মুখে সিরিয়াস ভাব বজায় রাখলাম। একটু নড়েচড়ে বসলাম।
আমিঃ তোমার মাকে আমার কথা বল নি?
ফারিয়া মুচকি হেসে আমার দিকে তাকাল। মনে হল এই প্রথম সে ভালভাবে আমার দিকে তাকালো।
ফারিয়াঃ চাল-চুলা কিছু আছে তোমার? আমার দায়িত্ব নেবে কিভাবে?
(কি করে বলব তোমার পিছনে ফিল্ডিং মারতে গিয়েই এই দুরবস্থা। একট টিউশনি হারিয়েছি, আরেকটা যায় যায় )
আমিঃ তোমার বাবাকে বল না, আমার দায়িত্বটা নিতে। চাকরি পেলে সুদে-আসলে সব শোধ করে দিব। ফারজানা আপুর তো বিয়ে হয়ে যাবে! তারপর প্রয়োজন হলে আমার বউ এর সাথে সাথে তার বউ এর খরচটাও চালিয়ে দিব।
ফারিয়াঃ আহা! কিছু করার মুরদ নাই, আবার শখ কত? (বলেই ভেংচি কাটল)
বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হয়তোবা কোন মেয়ের দিকে চোখ পড়েছে।
ফারিয়াঃ মেয়েদের দিকে তাকাবে না, তাকালে কিন্তু......
আমিঃ তোমার দিকে কি তাকাতে পারব?
মুখ ঘুরিয়ে নিল ফারিয়া।
ফারিয়াঃ আচ্ছা তুমি কি স্মার্ট হবে না? আমার বান্ধবীদের বয়-ফ্রেন্ডরা কত স্মার্ট! যত সব ফালতু বিষয়ে তোমার অগাধ জ্ঞান, এই মেধাটা একটু লেখাপড়ায় দিলে তো পার।
ফারিয়া রেগে যাচ্ছে। বেশি রাগানো যাবে না, উঠে চলে যেতে পারে। আমার কাছে টাকা তো দূরের কথা কোন কয়েনও নাই (এক যুগ আগে হলে চার আনা/ফুটা-পয়সা লিখতাম, এখন ফকীরও এই পয়সা নেয় না)। চলে গেলে বিল দিতে পারব না, আর পুরুষ-শাসিত সমাজ ধরবে তো আমাকেই! তাই ফারিয়ার পার্সটাই আজ আমার ভরসা।
আর একটা প্রবলেম আছে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট যুগের মুভির নায়িকার মত আমার নায়িকারও কোন মোবাইল নেই, যার ফলে মান ভাঙ্গানো বেশ কঠিন। আছে একটা ল্যান্ড ফোন। ফোন করলে টাকা তো যায়-ই, ফোন ফারিয়া পর্যন্ত পোঁছায় না। বাবা, মা, বোন কেউ একজন ধরেই। ফারিয়ার বাবা ধরলেই, হ্যালো, এটা কি পুলিশ স্টেশন? বলে লাইন কেটে দেই। ফারিয়া ব্যাক না করা পর্যন্ত কথা বলার উপায় নাই। তাই আমি কোন রিস্ক নিচ্ছি না।
তবে আমার অগাধ বিশ্বাস ফারিয়া এ কাজ করবে না। দীর্ঘদিন এক সাথে থাকতে থাকতে গৃহপালিত পশু-পাখির প্রতিও মহব্বত জন্মায়, আর আমি তো রক্ত মাংসের মানুষ।
কফিশপ থেকে বের হয়ে একটু এগুনোর সাথে সাথে হাতে খামচি দিল, মনে হচ্ছে রক্ত বের হয়ে যাবে।
আমিঃ উহ! ব্যথা পাচ্ছি তো।
ফারিয়াঃ বাবা!
ব্যথা ভুলে বিদ্যুৎ গতিতে দিচক্র-যান এবং নিজের জান বাঁচিয়ে পালালাম।
এখন উদাস মনে ধুম্র-শলাকা টানছি। এর চেয়ে ভাল এনজাইটি রিমোভার আমি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাই নি। আগে মোর কিংবা পাইন ছাড়া খেতাম না। আর এখন! পাতার বিড়িও খাই, টাকা না থাকলে। ফারিয়া বহুবার প্রশ্ন করেছিল সিগারেট খাই কিনা। বলিষ্ঠ কণ্ঠে না বলেছি। ‘দেয়ার ইজ নো লাই ইন লাভ এন্ড ওয়ার’। ফারিয়া অবশ্য বিভিন্নভাবে ট্র্যাপ দেয়ার চেষ্টা করেছিল। একদিন বেশ মধুরভাবে বলল
ফারিয়াঃ আমার এক বান্ধবী বলেছে যেসব ছেলেরা স্মোকিং করে না তারা আন-স্মার্ট।
কিন্তু আমি তো ঘাগু মাল। যে পথে পথিক নেই আমি আছি সেই পথে। ঘুঘুর ট্র্যাপে পা দেয়ার কোন মানেই হয় না।
অনেক চেষ্টা করেও ফারিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি অবশ্য তেমন কিছু করছি না,স্রেফ টেলিপ্যাথির সাহায্যে খবর পাঠানোর চেষ্টা করছি।
ফারিয়া ফোন দিলে......
(চলবে)
আর ফোন না দিলে তো বুঝতেই পারছেন......এখানেই...
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১:২২