১।
চুল কাটতে গিয়েছি সেদিন সন্ধ্যায়। সেলুনের অবস্থা মোটামুটি ভালোই। এয়ারকন্ডিশনড। ক্ষৌরকার দু'জনকে নিজ নিজ কাজে ভালোই দক্ষ মনে হল। চুল কাটা শেষ হবার পর টাওয়েল দিয়ে ঘাড় - মাথা ঝেড়ে টেরে দিয়ে সিট থেকে উঠিয়ে দেবে, এমন সময় আমাকে প্রায় ঘাড় ধরিয়ে আবার বসিয়ে দিলেন সিটে। সামনের দিকের পাতলা হয়ে আসা চুলের সিথি নাড়াচাড়া করে আরও বেশ খানিকটা ফাঁকফোঁকর বের করলেন পুরো মাথার তালু জুড়ে। অভ্যস্ত আঙ্গুল। সময় বেশী লাগে না চুল সেট করতে, অথবা চুলের সর্বনাশ করতে।
চিন্তিত মুখে আমার থেকে কিছুটা পিছে সরে এসে, আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে আয়নায় তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষন।
- মামা, মাথা তো আপনের খালি হইয়া গেছে গিয়া!
তথ্যটা আমার জন্যে নতুন না। তবে আমার শোকে আমার চেয়েও বেশী কাতর লোকটাকে কি বলা যায়, এ নিয়ে যখন মহা চিন্তায় আছি, তখন লোকটা একটা ব্যবসায়িক প্রস্তাব দিয়ে আমার কাজ সহজ করে দিলো।
- হেয়ার ট্রিটমেন্ট করেন একটা? আপনি আমাদের খিলগাঁও এর জামাই। ১০০০ টাকা রাখি, আপনার জন্যে ৫০% ডিস্কাউন্ট। ৫০০ রাখবো।
আমি তাকে জানালাম, আমার আগ্রহ নেই। একইসঙ্গে নিজের গালে নিজের একটা থাপ্পড় মারতে মন চাইলো, কেন যে নাপিতের সঙ্গে ক্যাজুয়াল কথা বলতে বলতে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি যে আমার শ্বশুরবাড়ি এখানেই! এখন চুল কাটতে এলে প্রতিবারই হয়তো এই উসিলায় হেয়ার ট্রিটমেন্টের অফার করবে।
লোকটা আমার না শুনে খুব একটা হতাশ হল না। বরং, কণ্ঠে মধু ঢেলে বলল - তাইলে একটা ব্ল্যাক শাইনই করায়ে দিই। ২ মাস মাথার চুল পাতিলের তলার মতন কালা থাকবে। ফাঁকফোঁকর কিছু বোঝা যাবে না।
ভাবলাম তাকে জিজ্ঞেস করি, সে ক্ষেত্রে চুল ধোয়ার পর চুল থেকে পাতিলের তলার মতো কালি বেরুবে কি না। আলোচনাকে আরও অ্যাবজারডিটির দিকে না নিয়ে গিয়ে এই প্রস্তাবও এককথায় নাকচ করে দিলাম।
- তাইলে একটু মাথা ম্যাসেজ কইরা দিই।
আমি তার সমস্যাটা লোকেট করতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে চুল কাটার মূল ফি'র সাথে তার টিপসটা ধরিয়ে দিলে, তার মুখের হাসি প্রশস্ত হয়। সে আমাকে সেলুনের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নতুন উপায়ে কেশ বিন্যাস করে বলে, দেখেন, সামনের চুলগুলা এমনে কইরা উঠাইয়া উঠাইয়া রাখলে কিন্তুক আর চান্দি দেখন যাইব না।
তারপর, কণ্ঠে বেশ সহানুভূতি ঢেলে আমাকে বলে, মামা, আপনার কষ্ট আমি বুঝি...
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম।
২।
চুল কাটতে গিয়ে এরকম দরদি নাপিতের দেখা প্রায়ই পাই। বা, দেখছি গত ১২ বছর ধরেই। চুল পড়ার সমস্যা আমার বহু পুরনো। সময় আর অবস্থার ওপর নির্ভর করে পরিমানে বাড়ে - কমে। শীতকালে খুশকি বেশী হয়। ধুলাবালিওয়ালা রাস্তা দিয়ে বেশী যাতায়াত করলেও চুল পড়ে। এ আমার মোটামুটি জানা আছে। এও জানা আছে যে নাপিতদের দরদটা মূলত অর্থনৈতিক। মাথার চুল যাদের পড়ে যাচ্ছে, নতুন চুল উঠবে - এই গল্প একবার ভালোমতো ফেঁদে বসতে পারলেই ৫০০ - ১০০০ টাকার ট্রিটমেন্ট ফিটমেন্ট করায়ে নেয়া যায়। এই ফটকামো, বা ধান্দাবাজি ওদের রুটি - রুজিরই অংশ, কাজেই ওদের ক্ষমাঘেন্না করা যায়। বিরক্ত লাগে সামাজিক দরদিদের আচরনে।
ক্ষৌরকারদের বিপরীতে আমাদের অপরাপর এই দরদি বন্ধুরা হন উচ্চশিক্ষিত। আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পেশাগত সার্কেলের মধ্যেই। তাদের কাজই হচ্ছে, মোটামুটি হাহুতাশের সুরে আমাদের শরীরের খুঁত নিয়ে বিলাপ করা, বা বিলাপের আড়ালে আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা।
উদাহরনত -
~আরেহ আবির, এতো মোটা হইতেছ কেন দিন কে দিন? শ্বশুরবাড়িতে ঠাইসা খাওয়ায় খালি, তাই না?
~আরেহ সোনিয়া, তোর এই গায়ের রঙে কোন ছেলে তোরে বিয়ে করবো?
~কি মা, তোমার উপরের মাড়িতে ঐ দাঁতটা অমন ত্যাড়াব্যাকা কেন? ব্রেস লাগাও জলদি জলদি!
~আর লম্বা হইলি না, না? বয়স কতো? আঠারো পার হইসে? নইলে এখনি একটা দড়ি টানা সিলিঙ্গের সাথে। দিনরাত ঝুলবি।
~নাক এমন বোঁচা কেন রে? নোয়াখাইল্লা নাকি?
ইত্যাদি।
যারা এগুলো আমাদের বলেন, তারা কি মনে করেন - আমরা আমাদের শরীরের এসমস্ত খুঁতের ব্যাপারে জানি না?
রূপ নিয়ে, রূপের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বসত যার, রূপের সঙ্গে বিচ্ছেদের কষ্ট তাকে কারো শিখিয়ে দেয়া লাগে?
৩।
আজকের জেনারেশন নিজেদের আউটলুক নিয়ে মোটামুটি সচেতন। তারা জানে, আগেরমতো লামসাম উপায়ে চলাফেরা করা তাদের পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং এর জন্যে ক্ষতিকর। আগে মানুষ কোন প্রোগ্রামে, উৎসবে, অথবা ফর্মাল অকেশনে ছবি তোলার প্রস্তুতি নিয়ে যেতো। এখন প্রতিদিনই মানুষ সেলফি তুলছে, প্রতিমুহূর্তই ছবি তোলার নিত্যনতুন অকেশন। কেউ চায় না গ্রুপ সেলফির সবচে বাজে ছবিটা তার আসুক। কাজেই, প্রায় সবাই নিজের চেহারা, পোশাক, ফ্যাশান ইত্যাদি নিয়ে যথেষ্ট যত্নশীল থাকে।
অপরদিকে পুরো পৃথিবী যেন উঠেপড়ে লেগেছে আমাদের বার্গার - পিজ্জা - পাস্তা - কাচ্চি খাওয়ানোর জন্য। পৃথিবীর যত বিজ্ঞাপন, তার প্রায় অর্ধেক এখন খাওয়া দাওয়া নিয়ে। শুধু খাওয়া দাওয়া নয়, খাওয়া দাওয়ার ডেলিভারী নিয়েও বড় বড় সব অ্যাড। আপনি চাইলেই যে হাতের কাছে "স্বাস্থ্যকর" খাবার পাবেন, ব্যাপারটা এমন না। রাস্তায় বেরিয়ে ৩৬০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখবেন, খাবার দোকানের প্রায় ৮৫% ফাস্টফুড শপ। বাকি ১৫% এর মধ্যে ১০% ভাত - ভর্তার মতো বাঙ্গালী খাবারের দোকানের পরিবেশ দেখলে মন বিষিয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যসম্মত মনে হয় না। যারা কলেজ - ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি, বা চাকরি করছি, ঘর থেকে খাবার নিয়ে না গেলে (গৃহে স্বামী - স্ত্রী উভয়েই কর্মজীবী হলে যেটার সম্ভাবনা এখন খুব কম) শরীরের জন্যে উপকারি খাবার বাইরে প্রতিনিয়ত খাওয়া - মোটামুটি অসম্ভব এক ব্যাপার।
শরীর চর্চা করার জন্যেও, একটা বয়সে এসে উপযুক্ত পরিবেশ লাগে। স্কুল -কলেজ - ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় যখন দায়িত্ব অপেক্ষাকৃত কম থাকে, তখন শরীরচর্চা জীবনের প্রধানতম একটা কাজ হতে পারে। কিন্তু যখন মানুষ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, যখন তার নিজের পাশাপাশি তার পুরো পরিবারের ভালমন্দের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে, তখন দিনে দুঘণ্টা শরীরচর্চা করা প্রায় অপূরণীয় এক বিলাসিতায় পরিণত হয়। বাসার পাশে জিম না থাকলে নিয়মিত জিম করা হয়ে ওঠে না।
আমার এখন একটা ভালো জিমের পেছনে মাসে মাসে কিছু পয়সা খরচ করার সামর্থ্য আছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাসার ১ স্কয়ার মাইলের মধ্যে কোন জিম নেই। আমি জগিং করি। বৃষ্টির মাঝে জগিং করেছি। ভর দুপুরে জগিং করেছি। উন্মুক্ত রাস্তায়, নগরের প্রধানতম সড়কগুলিতেও, ট্রাক - বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাত সাড়ে নয়টা থেকে দশটা বাজে দৌড়েছি একসময়। নইলে সময়, বা দৌড়ানোর উপযুক্ত জায়গা মিলত না। এখন যে জায়গায় থাকি, আলহামদুলিল্লাহ, মেইন রোডে আর দৌড়ানো লাগে না। এলাকার ভেতরেই জায়গা আছে জগিং করবার।
পারিবারিক, অফিশিয়াল, বন্ধুবান্ধবদের আয়োজনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে না পারতে রিচফুড গ্রহণ করতেই হয়। এভাবে একবেলা ভারী খাওয়া হয়ে গেলে, অন্যবেলা প্রায় কিছুই খাই না। করোনার দিনগুলো থেকে রাতে রুটি খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে।
তবুও পারছি না।
শরীরের ওজন বাড়ছেই। না বাড়লেও একইরকম থাকছে। কমাতে পারছি না। ৩০ পার হয়ে গেলে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রন আর পুরোপুরি নিজের হাতে থাকেও না। যদি জিনগতভাবে স্লিম থাকা না যায়, তবে এ সময়ে জোর করে কোমরের মাপ ৩০ - ৩২ রাখা প্রায় অসাধ্য সাধনের মতো একটা ব্যাপার।
৪।
এসবকিছুর পরেও আমরা যারা ওভারওয়েট, যাদের চুল পড়ার সমস্যা আছে, সমাজের কুৎসিততম পরিভাষায় শরীরে নানারকম 'ডিফর্মিটি' আছে, আমরা কোন না কোনভাবে চেষ্টা করছি এগুলো ওভারকাম করবার। আর যারা চেষ্টা করতে করতে একসময় থেমে যাচ্ছি, কতোটা হতাশা, কতোটা কষ্ট নিয়ে থামছি - তা সাধারণ মানুষ বুঝবে না কোনদিন। স্রেফ দু'দিন জীবনটা রুটিনের বাইরে কাটালে অসুস্থ্য হয়ে পড়তে হবে, এ ভয়ে অফিস থেকে ফিরে, ক্লান্ত শরীরে, পরিবারের জন্যে, নিজের প্যাশনের জন্য নির্দিষ্ট করা সময়ের ফাঁকে যারা মেইনরোডে গিয়ে দৌড়াচ্ছে, মুখরোচক খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, ডায়েট করছে - এমন একজন মানুষ হঠাৎ কেন ডায়েট ছেড়ে দেয়, তা বডি শেমিং যারা করে, তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব না।
যারা খোঁটা দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে, তাদের বোঝানো সম্ভব না এমনিতেই কতোটা মানসিক যাতনায় থাকে জন্মসূত্রে স্পেসিফিক গায়ের রঙ, উচ্চতা, ওজন, চেহারা - ইত্যাদিতে জন্মসূত্রে পাওয়া মানুষরা।
কাজেই প্লিজ, এসমস্ত ইস্যু নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে আসবেন না। ভদ্রতার খাতিরেও না, কেয়ার করেন বলেও না, কথা বলার মতো অন্য কোন টপিক খুঁজে পাচ্ছেন না বলেও না। কারন যাই হোক, ভেতরে যতই চুলকাক, সিম্পলি না! কথা বলবেন না কারো শারীরিক কোন সমস্যা নিয়ে, যদি না উক্ত ব্যক্তি উপযাচক হয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২২ সকাল ১১:০৯