দেশের চলমান রাজনীতিতে গণতন্ত্রের অচলায়ন অবস্থা চলছে। বিরাজমান রাজনীতিতে উদারনীতির নামে গণতন্ত্রের আবরণে রাজনৈতিক প্রহসনের ঘটনা ঘটছে। ক্ষমতাসীন দলের একদর্শিতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিডিয়া দলন, শিশু কিশোর নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের অঙ্গসংগঠনের বেপরোয়া আচরণসহ বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন মলিন।
অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ এখন চরম গণতান্ত্রিক সংকটে ভুগছে। সরকারের এ রকম উদারনীতির অগণতান্ত্রিক মনোভাবের ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গরম না পড়তেই তীব্র লোডশেডিং, প্রশাসনকে দলীয়করণ, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, শেয়ারবাজারে ধস, বিনা মূল্যে অন্য দেশকে ট্রানজিট প্রদান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে প্রহসনের নাটকসহ বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। বলা যায়, স্বাধীনতার চার দশক পর দেশ এখন সবচেয়ে কঠিন সংকটের মুখোমুখি।
২০০৯ সাল থেকে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উদার গণতান্ত্রিক ধারণা, অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতির উত্তরণের নামে একটা ঘোলাটে ও বিভাজন অবস্থার সৃষ্টি করছে। সমাজের অভ্যন্তরে টিকে থাকা এ রুপ বিভাজিত নানা শক্তির সয়লাব ও বাস্তবতাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, যা আগে এতটা স্পষ্ট দৃঢ় ও সুসংগঠিত ছিল না।
৭৫’ পরবর্তী ধারার রাজনীতির মুখ্য প্রভাব এর উপর আছে বলে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। যার কারণে বর্তমান সরকার একের পর এক ক্ষমতার পট পরিবর্তন, অশুভ এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতি, শিক্ষানীতি বিশেষ করে শিক্ষানীতিকে ইসলামমুক্ত করে পশ্চিমা ধাঁচে সাজানো, দেশের মুক্ত বুদ্ধিভিত্তিক সংস্কৃতিতে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গড়তে সেক্যুলার অপসংস্কৃতির সয়লাব সৃষ্টি করছে। এর কারণে যারা আত্নিক টানে দেশের ঐতিহ্যের লালন এবং ভারতীয় নাশকতা-আগ্রাসন থেকে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বদ্ধপরিকর ছিলেন, তাদেরকে আজ স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী জঙ্গিবাদদের দোসর হিসেবে নির্মূলের জন্য টার্গেট করা হয়েছে। সবকিছুকে দলীয়করণ ও ঢেলে সাজানোর পাঁয়তারা চলছে।
অপরদিকে বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিও দিল্লি তুষ্টে আবর্তিত। জনগণের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিকিয়ে তার অভিভাবকত্ব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার জন্য সরকার একরকম উঠে পড়ে লেগেছে। বিনা শুল্কে ট্রানজিট প্রদান করে যে সখ্যতা সরকার তৈরি করেছে তার বদৌলতে সীমান্তে ফেলানীর মতো শান্ত পাখিরা দিনের পর দিন লাশ হচ্ছে। কাউকে আবার গুম করে রাখা হচ্ছে তার কোনো হিসেব নিকেশ ও প্রতিবাদ জানানোর মতো যেন দায়িত্ব সরকারের নেই। এদিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। দিনে দুপুরে হত্যা, নারী, শিশু কিশোর, সাংবাদিকদের পিটিয়ে রক্তাক্ত ও গার্মেন্টস কর্মীদের সহিংসতা, বিডিআর বিদ্রোহ ও জেল জুলুমের প্রহসনে জনজীবন এখন বিপর্যস্ত। ধর্ষণ, ইভটিজিং-এর মতো মারাত্নক অপরাধের বিরুদ্ধে সরকারের চরম ঔদাসীন্যতার পরিচয় দিয়েছে। এসবের কারণে বরাবরের মতো বাংলাদেশের নেতিবাচক খবর হিসেইে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। এমনকি ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ যে ৩৭টি দেশের তালিকা তৈরি হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসিসহ বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যমে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের ওয়েব সাইটে বাংলাদেশের বর্তমান কলুষিত চিত্র ফুটে উঠেছে । ( আমার দেশ,২২ জানুয়ারি ২০১১)
এদিকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙখলার ক্ষেত্রে সরকার সবসময় ক্রসফায়ারকে নির্বাচন করেছে। মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের ৫:২ অনুচ্ছেদে ছিল, ‘‘বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করা হবে’’ ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত র্যাব পুলিশের হাতে ক্রসফায়ারে অন্তত ২৮০ জনের অধিক লোক নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে ছিল নিরাপরাধ ও প্রতিহিংসার বলয়। আর ক্ষমতা লাভের কয়েক দিনে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড অতীতের সকল রেকর্টকে ভঙ্গ করেছে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেছেন, ‘চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছিল। এরপর ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী জরুরী সরকারের সময়েও। এমতাবস্থায় আ.লীগ ক্ষমতায় এসে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন করেছে’। (আমার দেশ, ৫ ডিসেম্বর ২০১০) এ সরকার ক্ষমতা লাভের পর থেকে গত দুই বছরে ৪৭৮ জনের অধিক লোক বিচার বহির্ভূত হত্যাযজ্ঞের নির্মম বলি হয়েছে। দলের অধিকাংশ মুখরোচক মন্ত্রীদের মন ভুলানো কথায় মানুষের এখন মতিভ্রম হবার উপক্রম।
অপরদিকে সরকার লোকদের ১০ টাকার চাল-ডাল খাওয়ানোর কথা বললেও বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারমূল্য অতীতের চেয়ে দ্বিগুণ। ন্যায়সঙ্গত মূল্য বলতে নির্ভর যোগ্য সূত্র কারো কাছে নেই। তাই সময়ের আবর্তনে ভালো মনিটরিং-এর অভাবে নিত্য দ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী। এদিকে মুখরোচক বাণিজ্যমন্ত্রীর কথায় ও কাজে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না সাধারণ জনতা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বলে ক্ষমতায় এসেছিল। অনেক আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়ে এখন যুদ্ধাপরাধীদের মানবতা বিরোধী অপরাধী বলে সাব্যস্ত করেও সরকার কিছু করতে পারছে না। বরং এই ইস্যুটি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একের পর এক রাজনৈতিক ধ্রুমজাল সৃষ্টি করে দেশকে এখন অকার্যকর করে তুলছে। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার লেখা চিঠিতে ১৯৭১ সালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আটকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার অভিযোগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর জন বুজম্যান (দৈ. সংগ্রাম-২৭/১২/১০)। তিনি এই বিচারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করলেও ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) এ্যাক্টকে ত্রুটি পূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। সরকার এ সমস্ত ইস্যুকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ঢালাওভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করে ইতিমধ্যে বিতর্কিত হতে শুরু করেছে।
তাই বিরাজমান রাজনীতিতে উদারনীতির নামে প্রহসনের অবস্থা চললে বাংলাদেশের আগামী গণতন্ত্রের ধারা কতটুকু বিরাজমান থাকবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সংশয় দেখা দিয়েছে। আগামী সোনালী দিনের রাজনৈতিক সূচি ও বাস্তবতা এখন নির্ভর করছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সতর্ক দৃষ্টির উপর। সুতরাং আত্মবিলাশ ও আত্মতুষ্টি নয় বরং জনগণের কাম্য বিষয়কে সচেতনভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশ ও দশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতিকে বেগবান করা হলো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারার পরিচায়ক। তাই সরকারকে গণতন্ত্র লালন করার বৃহৎ করার স্বার্থে সকল প্রকার ঔদাসীন্যতা ও প্রহসন থেকে বেরিয়ে আসবে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৩:২৫