প্যারামেডিক্যাল সার্ভিসেস
পেশাদার চিকিত্সকদের যাঁরা সাহায্য করেন, তাঁদের জীবিকাই হল প্যারামেডিক্যাল সার্ভিসেস। নতুন ধরনের এই পেশায় প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছেই।
বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে-সঙ্গে ক্রমশ ফুলপ্রুফ হচ্ছে ডাক্তারবাবুদের ডায়াগনোসিস করার উপায়। ডাক্তারবাবুদের অভিজ্ঞতা, হাতযশ বা অনুভব করার ব্যক্তিগত ক্ষমতার সঙ্গে-সঙ্গে এসে গিয়েছে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যার মাধ্যমে নির্ধারিত রোগটি সম্বন্ধে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে। ফলে অনেক বেশি সুবিধে হচ্ছে চিকিত্সা করতেও। প্যারামেডিক্যাল সার্ভিসেস-এর মধ্যে যেসব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা পড়ছে, সেগুলোর উদাহরণ হল, রেডিয়োগ্রাফি, মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি টেকনোলজি, নার্সিং, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশন্যাল থেরাপি ইত্যদি। এককথায় বলা যেতে পারে, প্যারামেডিক্যাল প্রফেশন্যালরা মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞদের টেকনিক্যালি সাহায্য করেন চিকিত্সার কাজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য।
আধুনিক সময়ে চিকিত্সা ক্ষেত্রে প্যারামেডিক্যাল সায়েন্স ক্রমশ আরও বেশি করে অপরিহার্য হয়ে ওঠার জন্য, মেডিক্যাল পড়াশোনার একটি অন্যতম শাখা হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে প্যারামেডিক্যাল সায়েন্সেস। চিকিত্সার পাশাপাশি প্যারামেডিক্যাল ফিল্ডে এই ধরনের উন্নতি, বলা যেতে পারে, চিকিত্সার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, প্যারামেডিক্যাল সার্ভিসেসই হল আধুনিক মেডিক্যাল চিকিত্সা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড, যা ছাড়া মেডিক্যাল সায়েন্স অচল। যে ধরনের প্যারামেডিক্যাল কর্মীদের চাহিদা এই মুহূর্তে খুবই বেশি, সেগুলো হল, ফিজ়িও থেরাপি, ফার্মাসি, নার্সিং, অকুপেশন্যাল থেরাপি, অডিয়োলজি অ্যান্ড স্পিচ থেরাপি, মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি টেকনোলজি, রেডিয়োলজি বা এক্স রে টেকনোলজি, ডেন্টাল হাইজিনিস্ট ও ডেন্টাল মেকানিক্স, অপারেশন থিয়েটার অ্যাসিসট্যান্ট, অপ্টোমেট্রি এবং অপথ্যালমিক অ্যাসিসট্যান্ট এবং এই ধরনের আরও অন্যান্য কাজ। এই কোর্স ফুলটাইম বা করেসপন্ডেন্স, দু’ভাবেই করা যায়।
কাজের ধরন
ফিজ়িওথেরাপি: কোনও চোট-আঘাত, অসুস্থতা বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে যদি শরীরের কোনও অঙ্গের যন্ত্রণা বা অক্ষমতা তৈরি হয়, তা হলে সেই অঙ্গটির কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য বাইরে থেকে যে চিকিত্সা প্রয়োগ করা হয়, তাকে বলে ফিজ়িওথেরাপি। যিনি এই চিকিত্সা করেন তাঁকে ফিজ়িওথেরাপিস্ট বলা হয়। প্রধানত কোনও রোগীর অপারেশনের পরবর্তী সময়ে ফ্র্যাকচার, ডিসলোকেশন, অ্যাম্পিউটেশন, স্নায়ুর দুর্বলতা, বুক বা হার্টের কোনও সমস্যা, ত্বক, পেশি এবং প্লাস্টিক সার্জারির ক্ষেত্রেও এই থেরাপির প্রয়োজন হয়।
ফার্মাসি : যেভাবে আমাদের দেশে এবং শহরে নার্সিং হোম, হাসপাতাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে চলেছে, তা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে ফার্মাসি-সম্পর্কিত জীবিকার চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা ঊর্ধ্বমুখী। এঁদের কাজ হল চিকিত্সকের প্রেসক্রিপশন অনুসারে বিভিন্ন ধরনের ওষুধপত্র তৈরি করা এবং ডিসপেন্সারিতে বিক্রিও করা।
নার্সিং : যে-কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের জেনারেল ওয়ার্ড থেকে শুরু করে অপারেশন থিয়েটার পর্যন্ত, মেডিক্যাল কেয়ারের অপরিহার্য অঙ্গই হল দক্ষ নার্সিং। রোগীর যত্ন নেওয়ার জন্য প্যারামেডিক্যাল কেয়ারের এই দিকটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অকুপেশনাল থেরাপি : এই থেরাপি কীধরনের হবে, তা নির্ভর করে রোগীর উপর। এই থেরাপিতে রোগীর কোনও শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতার চিকিত্সা করে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। এই চিকিত্সার কোনও নির্দিষ্ট মেথড বা পদ্ধতি নেই। রোগীর রোগ বিচার করে তাঁকে কীভাবে সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিক করে তোলা যায়, অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা সেই চেষ্টা করেন।
অডিয়োলজি এবং স্পিচ থেরাপি : শ্রবণক্ষমতার নানারকম দুর্বলতার উপর পড়াশোনাই হল অডিয়োলজি। যেসব মানুষ স্পষ্ট করে কথা বলতে বা অন্যের কথা শুনতে পান না, অডিয়োলজিস্টরা তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন। এঁরা অডিয়োমিটার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কোনও রোগীর কানে শোনার ক্ষমতা এবং কারও ক্ষেত্রে তা কতটা নষ্ট হয়েছে, সেটা নির্ণয় করেন। তেমনই স্পিচ থেরাপিস্টরাও কিছু লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে কথা বলার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন এবং সেগুলো সারানোর উপায় নির্দেশ করে রোগীকে সাহায্য করেন।
মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি টেকনোলজি (এমএলটি): মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্টদের প্রধান কাজই হল মানুষের শরীরের বিভিন্ন ফ্লুইড, টিসু, রক্তের গ্রুপ, মাইক্রোঅর্গানিজ়ম ইত্যাদির কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের মাধ্যমে রোগ নির্ধারণ করা। এরা স্যাম্পলিং, টেস্টিং এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে নানারকম প্যাথলজিকাল নমুনা থেকে রোগ ডায়াগনোসিস করেন।
রেডিয়োলজি এবং এক্স রে টেকনোলজি : রেডিয়োগ্রাফাররা শরীরের কোনও নির্দিষ্ট অংশের এক্স-রে ফিল্ম তৈরি করেন, সেই এক্স রে প্লেট দেখে এক্সপার্ট রেডিয়োলজিস্ট রোগ বা কোনও অস্বাভাবিকতা থাকলে তা শনাক্ত করতে পারেন।
ডেন্টাল হাইজিনিস্ট বা মেকানিক : এঁরা একজন ডেন্টিস্টকে দাঁতের চিকিত্সার কাজে সাহায্য করেন। ডেন্টাল হাইজিনিস্টের প্রধান কাজ হল, দাঁতকে দাঁতের বিভিন্ন রোগ এবং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো। ডেন্টাল মেকানিক কৃত্রিম দাঁত তৈরি করার পাশাপাশি দাঁতকে সোজা করতে, দাঁতের ক্যাভিটি পূরণ করতে, দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করতে এবং মাড়ির বিভিন্ন রোগের চিকিত্সা করতে সাহায্য করেন। এছাড়াও, দাঁতের কীভাবে যত্ন করতে হয়, রোগীদের এঁরাই সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার : রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা রোগীকে স্বাভাবিক শারীরিক এবং মানসিক অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। যে-কোনও হাসপাতাল বা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে, রোগীকে যত্ন নেওয়া হয় এবং তার পুরনো স্বাভাবিক জীবনে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। রিহ্যাবিলিটেশনের কাজে ডাক্তার, নার্স, মনোবিদ, সমাজবিজ্ঞানীদের সঙ্গে প্রায় সমান ভূমিকা নেন রোগীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও।
পেশাদার প্রশিক্ষণ এবং যোগ্যতা
পেশাদারি প্যারামেডিক্যাল কোর্সের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তার মধ্যে ২ বছরের বিষয়ভিত্তিক ডিপ্লোমা কোর্স, তিন-চার বছরের গ্র্যাজুয়েশন, দু’-তিন বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি থেকে পিএইচ ডি পর্যন্ত করা যায়। বিভিন্ন ধরনের কোর্সের জন্য আলাদা-আলাদা যোগ্যতা থাকার দরকার হয়।তার কয়েকটির কথা নীচে উল্লেখ করা হল…
ফার্মাসি : ফার্মাসির প্রধান কোর্সগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হল,
ডি ফার্ম (ডিপ্লোমা ইন ফার্মাসি)
যোগ্যতা : ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি এবং বায়োলজি বা ম্যাথমেটিক্স নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় পাশ
বি ফার্ম (ব্যাচেলর ইন ফার্মাসি)
যোগ্যতা : ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি এবং বায়োলজি বা ম্যাথমেটিক্স নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় অন্তত ৫০ শতাংশ নম্বরসহ পাশ করতে হবে। ফার্মাসিতে ডিপ্লোমা থাকলেও বি ফার্মের জন্য আবেদন করা যায়।
এম ফার্ম (মাস্টার ইন ফার্মাসি)
স্বীকৃত কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান থেকে (অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন বা ফার্মাসি কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া অনুমোদিত) ন্যূনতম ৬০ শতাংশ নম্বর নিয়ে বি ফার্ম পাস করলেই সে এম ফার্ম-এর জন্য আবেদন করতে পারে।
নার্সিং : বি এসসি ইন নার্সিং কোর্সের জন্য ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজিসহ, কোর্সের মেয়াদ ৪ বছর। নার্সিংয়ে বি এসসি পাশ করলে এম এসসি-র জন্য আবেদন করা যায়, কোর্সের মেয়াদ ২ বছর।
জেনারেল নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি (জিএনএম) নিয়ে বি এসসি করার জন্য ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজি নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ (এএনএম) এবং হেল্থ ওয়ার্কার ফিমেল পেশায় আসার জন্য ক্লাস টেন পাশ করলেই চলে। কোর্সের মেয়াদ ১৮ মাস।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৭