প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যা একটা শিশুর বা মানুষের জীবনে জীবনভর প্রভাব ফেলে থাকে তার উপর ভিত্তি করে আমার একটা সিরিজ লেখার প্রয়াস ছিলো, আছে।
এইটা সে সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব।
প্রথম পর্বে বলেছিলাম যে এদেশে যেসব শিক্ষাব্যবস্হা বিদ্যমান, তার একটা অংশ হলো ইংরেজী মাধ্যম স্কুল।
ইংরেজী মাধ্যম স্কুল নিয়ে কিছু আলোচনা আগের পর্বে ছিলো।
আগের পর্বটা আছে এখানে
ইচ্ছে ছিলো ইংরেজী মাধ্যম নিয়ে আরো অন্তত একটি পর্ব আসুক, কিন্তু আবার ভাবছি নিজের সময় স্বল্পতার ব্যাপারটা।
আজকে আমি তাই সরাসরি সরকারী স্কুলের প্রসঙ্গেই যেতে চাই।
সরকারী স্কুল আছে দু ধরনের এক হলো প্রাইমারী স্কুল, আরেকটা হলো হাই স্কুল।
প্রাইমারী স্কুল শ্রেণীবিন্যাস হলো ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ।
হাই স্কুল হলো ক্লাস থ্রী থেকে টেন পর্যন্ত।
আসুন একটু প্রাইমারী স্কুল, এর ভেতরের পরিস্হিতি, শিক্ষকদের পরিস্হিতি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
দেশের একটা বিরাট সাধারন শ্রেণীগোস্ঠী প্রাইমারী স্কুলেই নিজের শিক্ষা জীবন শুরু করে।তাই খুবই গুরুত্বপূর্ন হলো এ শিক্ষাকালটা। সরকারী স্কুলযেহেতু তাই সরকারী অনুদানেই এ স্কুল চলে থাকে।
বাংলাদেশ সরকারের টার্গেট বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রামে অন্তত একটা করে সরকারী প্রাইমারী স্কুল রাখা। যাতে কেউ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়।একসময় আমাদের দেশের মানুষ ব হু পথ পাড়ী দিয়ে পায়ে হেটে স্কুলে গেছে। এ সমস্যাটা এখণও অনেক জায়গায় রয়েছে।
সরকারী স্কুলে আমাদের দেশে সাধারনত বেতন নেয়া হয়না, বই ফ্রি।এটা সত্যি এ গরীব দেশে অনেক ভালো একটা দিক।
তবে সরকার পারেনি এখনও নানাবিধ সুবিধা বাচ্চাদের কাছে পৌছে দিতে, ক্লাসরুম স্বল্পতা, অনেক ক্ষেত্রে জীর্ন শীর্ন ভবন, শিক্ষক স্বল্পতা, ভালো শিক্ষকের অভাব, ভালো ছাত্রদের রয়েছে এ চাকরিতে চরম অনীহা,কারন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের নাকি সমাজে তেমন মান সম্মান নেই।
প্রথম কারন বোধহয় স্বল্প বেতন।
দ্বিতীয় কারন আমাদের সমাজ শিক্ষকদের সম্মান করতে শিখেনি।
তৃতীয় কারন, কিছু স্বার্থান্বেষী শিক্ষকদের জন্য আজকে বৃহৎ একটা শিক্ষক সুবিধা বঞ্চিত।এবং তাঁদের প্রাপ্য সম্মান হতে বঞ্চিত।
চতুর্থত, এবং প্রধানত[sb,বিগত কোন সরকারেরই শিক্ষা ব্যব্স্হায় অর্থ বরাদ্দ করে চললেও শিক্ষার আধুনিকায়ন নিয়ে চিন্তিত কিনা সেব্যাপারে আমি সন্দিহান!
যে ক্লাসরুমে ৫০ টা ধারনক্ষমতার বিপরীতে ১৫০ জন বসে সেখানে পড়াশোনার কতটুকু পরিবেশ আছে, তা নিয়ে আমি সত্যি সন্দিহান।
যে ছেলে সকালে এক মুঠো ভাত খেয়ে স্কুলে আসতে পারেনা, তার স্কুলে এসে পড়াশোনা করতে পারার মানসিক শক্তি নিয়ে সন্দিহান আমি।
আমাদের দেশের অনেক গ্রামে, থানা পর্যায়ে বা জেলা পর্যায়ে অনেক অবস্হা সম্পন্ন ব্যক্তি স্কুল, কলেজের জন্য একসময় জমি দান করেছেন, দিয়েছেন অনেক আর্থিক সাহায্য।
ভাবনার সুযোগ থেকে যায়, এতগুলো প্লট যদি সরকার বিনামূল্যে না পেতো তাহলে কতো যে হিমশিম খেতো!
যাইহোক, প্রাইমারী স্কুলে আমার মায়ের চাকরি প্রাপ্তি এবং তার পরবর্তী কিছু ঘটনা শেয়ার করি।
একসময় আম্মুর চিন্তা ছিলো যে সে চাকরি করবেনা, কিন্তু পরবর্তীতে সে চায় কোন কাজের সাথে যুক্ত হতে। সিভিল সার্ভিসের বয়স সীমা শেষ। তাই প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার পদে আবেদন করে।
পরীক্ষায় সারা দেশে প্রথম হয় আমার আম্মু।
চাকরি করবে বলেই ইচ্ছা ছিলো আম্মুর। কিন্তু আশেপাশের সবাই এতো বেশী নেগেটিভ কথা বলতে শুরু করে যে জয়েন করার এক মাসের মধ্যেই চাকরি সে ছাড়তে বাধ্য হয়।
আব্বু আম্মুকে বলে বসে তোমার কারনে আমি পারছিনা মানুষকে মুখ দেখাতে!
এখন আমি বুঝতে পারি অনেকেই হয়ত ছিঃ ছিঃ করে আমার বাবাকেও অতিষ্ট করেছিল!
অনেকেই আম্মুকে বলছিল ভাবী আপনার কি টাকা, খাওয়ার অভাব যে এই নিচু চাকরী টা আপনি করবেন?
অনেকে আবার বলছিল যে মেয়ে আইন ও বিচার অনার্স, মাস্টার্স সে কেনো এই প্রাইমারী স্কুলের চাকরি করবে?
মোটামুটি মানসিকভাবে অতিষ্ট হয়েই আম্মু চাকরি ছেড়ে দিলো।
একটা স্কুল হয়ত একজন ভালো শিক্ষককে হারালো।
এমনই হয়।
এমনই হচ্ছে।
আমার প্রশ্ন,আমার কথা আর কত আমরা এভাবে ভালো ছাত্রদের ভালো শিক্ষক হিসেবে হারাবো?
আমাদের সরকারগুলো কবে শিক্ষকদের দীনহীন অবস্হার দিকে নজর দিবেন?
আমরা কবে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারবো?
আমরা কবে থেকে মনে করবোনা যে শিক্ষকতা একটা নিচু পেশা?
যাইহোক, দুইটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আজকের পর্ব শেষ করবো।
এক, আম্মুর একমাসের শিক্ষক হিসেবে অভিজ্ঞতা।
আম্মু যেহেতু প্রধান শিক্ষক ছিলো, তাই আম্মু ক্লাস নেয়ার পাশাপাশি পুরা স্কুল মেইনটেইনের দায়িত্বেও ছিল। যে স্কুলে জয়েন করেছিল সেখানে আম্মু স হ শিক্ষক ছিলো মোট তিনজন।
বাকি দুইজন ছিলেন স হকারী শিক্ষক। এমনিতেই শিক্ষক অপ্রতুলতার কারনে, গোটা স্কুলে হইচই লেগেই থাকতো, তা বাদেও দেখা যেতো বাকি দুইজন শিক্ষক প্রায়ই ক্লাস নিচ্ছেননা। সরকারী প্রতিষ্ঠান দেখার বলার তো কেউ নেই! আম্মু স্কুলে যাবার পর তাদের জোর করে ক্লাসে দিয়ে পাঠাতেন।
আম্মু বলতো যে, বুঝি তাঁরা হয়ত বিরক্ত হন। বিরক্ত হলেও অথরিটি স্ট্রিক্ট হলে ক্লাস চলে ঠিকি। কিন্তু বাংলাদেশের বেশীরভাগ স্কুলে কেনো কোন প্রতিস্থানেই বোধহয় অথরিটি স্ট্রিক্টনেস নিজেরাই মেনে চলতে চায়না।
দুই, এক সরকারী গার্লস হাই স্কুলের ঘটনা
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক ছোটবোন শেয়ার করে তার এক চরম বিড়ম্বনার কথা। শুনে অসম্ভব মেজাজ খারাপ হলেও কিছু করার থাকেনা আমার।
মেয়েটা তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। এসময় ছেলে বা মেয়ে সবারই শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটে, এটা আমরা সবাই জানি।
আমরা জানি, এসময় একটা মেয়ে পদার্পন করে তার নারীত্বের জীবনে।
কিন্তু এতটুকু বয়সে একটা মেয়ে কতটুকুই বা জীবন সম্পর্কে জানে বা কতটুকুই বা সাবধানী সবাই হতে পারে!
মেয়েটি অনুভব করে তার কোন শারিরীক সমস্যা হচ্ছে। মেয়েটা প্রথমে তার ক্লাস টিচারের কাছে যায়, ক্লাস টিচার প্রধান শিক্ষিকার কাছে নিয়ে গলে প্রধান শিক্ষিকা মেয়েটিকে চরম গালমন্দ করে, বলে আগে থেকে বুঝিসনা? স্কুলে আসিস কেনো কিছু আগে থেকে বুঝিসনা তো?
যা বাড়ীতে যা!
মেয়েটি শারীরিক অসুস্হতার পাশাপাশি মানসিক এরেকটা ধাক্কা নিয়ে বাড়ীর পথে পা বাড়ায়।
অথচ প্রধান শিক্ষিকা তো এমনও বলতে পারতেন, মা তোমার সমস্যা হয়েছে যেহেতু, এখুনি বাড়ী যাও। আমার কোন স হ শিক্ষিকাকেও সাথে দিচ্ছি তোমার।
কি পারতোনা?
বাবা মা মেয়েকে মেয়েদের আলাদা স্কুলে দেন, মেয়ে হিসেবে বাড়তি কিছু সুবিধা পেতে। কিন্তু এই কি ব্যব হার পাওয়ার ছিল একটি মেয়ের তার প্রধান শিক্ষিকার কাছে?
প্রধান শিক্ষিকা কি একজন নারী হয়ে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে পারে এই ব্যব হার করতে?
এরকম প্রধান শিক্ষিকাদেরই বলছি, আপনাদের জন্যই সব শিক্ষকদের খারাপ ব্যবহারের দায় বহন করতে হয়।
আপনাদের কারনেই অনেক সময় এদেশের শিক্ষা পদ্ধতির উপর থেকে অভিভাবকদের আস্হা হারিয়ে যায়।
সরকারী স্কুল গুলোতে না আছে একটা অতি প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো হাতের কাছে পাওয়ার মত ক্যান্টিন, না আছে ব্যবহার করার মত ওয়াসরুম, যেটা আসল, লেখাপড়ার পরিবেশই নেই!
আরো একটা আলোচনা করার মত আসল জিনিস বাদ গেলো তা হলো স্কুলের শিক্ষকদের কোচিং দৌড়াত্ব্য, এর ভালো মন্দ দিক এবং উচিৎ, অনুচিতের বিষয়টি।
আপাতত তোলা থাকলো, আজ এ পর্যন্তই।