নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

“ কাউকে জ্ঞান বিতরণের আগে জেনে নিও যে তার মধ্যে সেই জ্ঞানের পিপাসা আছে কি-না। অন্যথায় এ ধরণের জ্ঞান বিতরণ করা হবে এক ধরণের জবরদস্তি। জন্তুর সাথে জবরদস্তি করা যায়, মানুষের সাথে নয়। হিউম্যান উইল রিভল্ট। ” -আহমদ ছফা ।

আহমেদ রুহুল আমিন

“ মানূষের জীবনকাল মাত্র দুই দিনের যার একদিন যায় স্বপ্ন দেখতে- একদিন যায় স্বপ্ন ভাঙ্গতে ” ।

আহমেদ রুহুল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

।। করোনাকালের দিনলিপি- ১ ।। -"খেকিডাংগীর প.. ম..হিরুল"

১৯ শে মে, ২০২০ রাত ১০:২০

জেলা শহরের কালেক্টরেট ভবনটির পেছনের অংশটি এই করোনাকালে কেমন যেন একটা ভুতুরে পরিবেশ নিয়ে আছে । এমনিতেই এখন লোকজনের আনাগোনা কম থাকায় এবং কালেক্টরেটের ফাঁকা মাঠে আগাছা ও অল্প কিছু ঘাস থাকায় এলাকাটি স্হানীয় কিছু পিছলা টাইপের লোকজনের গরু-ছাগলের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে । ক্রমাগত ছুটি বৃদ্ধি ও লগডাউন তথা জনসমাগমের ছোঁয়া এড়াতে এমনিতেই ইদানিং অফিসে কম যাওয়া হয় । তারপরও আমার ছাপোষা চাকুরীর কাজের তাগিদে যাওয়া । কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় অফিসের দোতলার নীচের সামনের ( যে জায়গাটিতে বিআরটিএ’তে আবেদনকারীদের ভ্যাহিক্যালের প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা হয় ) ফাঁকা জায়গাটি পানিতে কর্দমাক্ত থাকছে সর্বদা । অফিসের বারান্দা বেয়ে দোতলার নীচের বিস্তৃত ফাঁকা অংশটিতে গরুছাগলের বিষ্ঠার বিস্তারে করোনাকালের অফিস ছুটি তথা লগডাউনকে বেশ ভালভাবে জানান দিচ্ছে । আগে এই এলাকাটি ট্রেজারী, রেকর্ডরুম, একাউন্টস অফিস বিশেষ করে বিআরটিএ-র অফিসে সীমাহীন মানুষের পদচারনায় গম গম করতো । এখন তা এক বিরাণভুমিতে পরিণত হয়েছে । দীর্ঘদিন না খাওয়া কয়েকটি কুকুর ঘুমের ভান করে যত্র-তত্র শুয়ে আছে । আগে এই কুকুরগুলোকে কালেক্টরেট এলাকার দৈনিক হোটেল গুলোর উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে বেশ মোটা তাজা দেখাতো, বর্তমানে সেগুলো বন্ধ থাকায় কুকুরগুলো এখন কেমন যেন শুকিয়ে গেছে যা দেখে বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠে । শুধু ট্রেজারী পাহারার কাজে নিয়োজিত পুলিশগার্ডদের থাকার রুমগুলি কিছুটা জীবন কোলাহলের শেষ সত্বাটুকুন আকরে ধরে আছে । গরু-ছাগলের ছড়িয়ে থাকা বিষ্ঠার ফাঁকে অতিসাবধানতা অবলম্বন করে আমার চলার পথের অবলম্বন বাইকটিকে নীচে স্ট্যান্ড ও লক করে সিড়ি বেয়ে দোতলায় অফিসরুমে প্রবেশ করি । বলাবাহুল্য, ইদানিং গূরুত্বপুর্ণ কাজে আমি ও দুইজন অফিস সহায়ক মিলে অফিসে থাকার সময় কিছুটা চাঞ্চল্য ফিরে পাই । আজ অফিস খুলে দিয়ে অফিস সহায়ক দু'জনই জরুরী কাজে বাইরে যাওয়ায় একাই ব্যস্ত থাকি কিন্তু কেন যেন একটু অস্বস্তিভাব নিয়ে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিনা ।
: স্যার ... ও স্যার ....
মাথার উপরে ফ্যানের শব্দ এবং কাজের ব্যস্ততার কারণে প্রথম ডাকেই কিছু শুনতে না পাওয়ায় দ্বিতীয়বার অস্পষ্ট আওয়াজ কানে আসে ।
: কে..রে .., ভিতরে আস...
আগন্তুক কথার উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । এতে মেজাজ ঠিক থাকার কথা নয় । তারপরও কেন যেন ভাবনায় ছেদ পড়ে, ভাবি করোনাকালের এই সময়ে তাকে ভিতরে আসতে বলাটাও ঠিক হচ্ছে কিনা.... !
দরজার পর্দার ফাঁকে লক্ষ্য করি, মাথায় টুপি ও মুখে মাস্কপড়া গায়ে জুব্বা টাইপের আকাশি রংএর ময়লা পাঞ্জাবী ও লুংগীপড়া কচি মায়াবি মুখের দশ-বার বছরের একটি ছেলে দাড়িয়ে । রোজার কারণে কী- না খাওয়ার কারণে চোখে মুখে একধরণের শুকনো অবয়ব বিরাজ করছে । সাধারণত: আগে এই ধরনের ছেলেদের দিয়ে কিছু ধান্দাবাজ হুজুর টাইপের মানুষ রমজান মাসে ভিক্ষাবৃত্তি করাতো । কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন বলে সেই ধারনা থেকে সরে আসতে হলো । ভিতরে আসতে বলায় সে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকে ।
: কি নাম তোমার..বাড়ি কোথায়...?
: প..ম..হিরুল, .....খেকিডাংগী ..

একটা বিষয় দীর্ঘক্ষণ খেয়াল করলাম, ছেলেটি পঞ্চগড়ের স্থানীয় ভাষায় কথা বলছে কিন্তু কথাগুলো অস্পষ্ট । অনেক কষ্টে যা জানতে পারলাম - তার নাম পহিরুল কী মহিরুল যা তিন চারবার বলার পরেও বুঝতে পারলামনা, ওর বাড়ি খেকিডাংগী । জায়গার নাম পরিচিতই মনে হচ্ছে কিন্তু এই মূহুর্তে লোকেশন চিনতে কষ্ট হচ্ছে, সেও ভালভাবে বুঝাতে পারছেনা । পরে অবশ্য মনে পড়েছে একেবারে তেতুলিয়ার বোর্ডার এলাকার ধারেই গ্রামটির অবস্থান । ছেলেটির বাবা নেই, গত বছর তেতুলিয়ার মাগুড়মারীতে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে । বাবা ছিল পাথর শ্রমিক । তারা দুইভাই একবোন সে মেঝ, বোনটি বড় । মা দিন মজুরের কাজ করে । আগে তিনিও পাথর শ্রমিক ছিলেন । কিন্তু ৭/৮ মাস হয় পাথর উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় এখন চা বাগানে কিংবা স্থানীয় কৃষকদের বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে শ্রমিকের কাজ করে । বর্তমানে তেমন কোন কাজ নেই । করোনা তথা লগডাউনের কারণে টুকটাক কাজের সন্ধানও মিলছেনা । ছেলেটি পঞ্চগড় সদরের জগদল ঠুটাপাখুরী হাফেজী মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে, তিন পারার হাফেজ । এই মাদ্রাসাটিতে ওর মতো চরম দরিদ্র বা এতিম ছাত্রদের ( তালিবিলিম) গ্রামের সম্পন্ন গেরস্থ/ব্যবসায়ী মানুষের বাড়িতে খাওয়া- দাওয়া কিংবা তাদের দেওয়া অর্থে জীবন ধারণ চলে ।করোনার কারণে মাদ্রাসাটি বন্ধ থাকায় তারা নিজেরা অন্ন সংস্থানের কষ্টে পড়েছে উপরোন্ত পরিবারের লোকজনকেও কষ্টে ফেলেছে ।

আমার হেরিডিটিক্যালি একটি সমস্যা হলো- আমি মানুষের সমস্যাগুলো গভীরভাবে নিতে পারিনা বা বলা চলে যা বুঝি অনেক দেরীতে বুঝতে পারি । বিশেষ করে, মানবিক সমস্যাগুলো তাৎক্ষনিক বুঝতে না পেরে পরবর্তীতে সে বিষয়ে চিন্তা করলে দারুণ মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাড়ায় । পহিরুল বা মহিরুলের ক্ষেত্রেও তাই হলো ।অন্য সময় হলে, সাতপাঁচ ভেবে পাঁচ টাকা দিয়েই মানবিক দায়িত্ব শেষ করতাম । কিন্তু তার সাথে কথা বলার পর ইফতারীর পেয়াজু-বড়া কেনার মতো তাঁকে বিশ টাকা দিয়েই বিদায় করলাম । টাকা পাওয়ার পর তার মাস্ক পড়া মুখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে বা বুঝতে পারলামনা ।

রোজার কারণে অফিস থেকে দুপুরের পরেই বাসায় চলে আসি । সাধারনত: এই সময়ে বাসায় এসে অজু করে নামাজান্তে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দেই । আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলোনা । বিছানায় শুয়েই কেন যেন সেই ছেলেটির মাস্কপড়া শুকনো মুখটি মনে পড়তে লাগলো বারবার । মনে হচ্ছে, ছেলেটি সম্ভবত: ডিসি অফিসে ত্রাণের খোঁজে এসেছিল । কিন্তু কোন কুলকিনারা করতে না পারার কারণে আমার অফিসে ভুলে ঢুকে পড়ে । আমার উচিৎ ছিল ভালভাবে তাকে সাহায্য করা । এই অবস্থায় তাকে কিছু দিনের চলার মতো অর্থ বা অন্যান্য পণ্যসামগ্রী দিয়ে সাহায্য করার খুব দরকার ছিল । আমি সেটা করতে না পেরে কেমন যেন একটা অপরাধবোধে ভুগতে থাকি । আচ্ছা, তার ছোটভাই ও বড়বোন-মা মিলে চার জনের সংসারে এই করোনাকালে কি পরিমাণ অর্থের সংস্থান লাগে ? গরিবানাহালে প্রতিদিন জনপ্রতি গড়ে একশত টাকা করে লাগলে চারশত টাকা কিংবা চরম গরিবানাহালে জনপ্রতি গড়ে পঞ্চাশ টাকা হলে দুইশত টাকার প্রয়োজন হয় । এই পরিবারগুলো বর্তমানে কিভাবে চলছে ? আমাদের পড়শীদেশ ভারতের পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়ি-ডুয়ার্স এলাকায় চা শ্রমিক বা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সেখানকার সরকার বিনামূল্যে রেশন ব্যবস্থা চালু করেছে অন্ততপক্ষ্যে কেউ যেন না খেয়ে না থাকে, শুধু কাটাতারের বেড়ার পরেই যাদের অবস্থান । মনে মনে ভাবি, ছেলেটির মাদ্রাসায় খোঁজ নিয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে একদিন খেকিডাংগী গিয়ে এই অসহায় পরিবারটির পাশে দাড়ালে আমার এই অপরাধী মনের দৈন্যতা কিছুটা দুর হতো । তবে, সেটা হয়তো এখন এই লগডাউনে সম্ভব হয়ে উঠবেনা ! পরক্ষণেই সেই চিন্তার বিপরীতে নুতন চিন্তার উদ্রেগ ঘটে আর তা হলো- কি লাভ এতে ? জাগতিক বা পারলৌকিক লাভের স্বার্থের দরজায় ততদিনে আরো কোন পহিরুল/....মহিরুলরা এসে কড়া নেড়ে জীবনের সকরুণ গল্প শুনিয়ে মানবিক মনের পাথর আরো বেশী শক্ত করতে শুরু করবে ! আবার ভাবি....যতই ভাবি...ছেলেটির মায়াবী মাস্কের কচি মুখটি ঝাপসা হতে হতে একসময় মিলিয়ে যাবে ! ‘করোনাকাল’ নাকি সহসা যাচ্ছেনা বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা । তবে কি এই দু:সময় মানবিক মূল্যবোধের শিরদাঁড়ায় আঘাত হানতে হানতে আমাদের হৃদয়- মনকে আরো কঠোর করে তুলবে, যা সময়ে সবকিছু স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে হবে... ! .. এই বৈশ্বিক 'করোনাকালে' ততদিনে বাঁচবো'তো...?
( ছবি কার্টেসী : ইন্টারনেট থেকে , প্রথম ছবিটি এডিটকৃত)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে মে, ২০২০ রাত ১১:১০

কল্পদ্রুম বলেছেন: শেষপর্যন্ত পরিবারটিকে সাহায্য করেছেন?

২১ শে মে, ২০২০ রাত ৯:৫৯

আহমেদ রুহুল আমিন বলেছেন: লকডাউনের কারণে সাহায্য করা সম্ভব হয়নি বলেইতো এই লেখার অবতারণা ..।

২| ২০ শে মে, ২০২০ রাত ১:৩১

রাজীব নুর বলেছেন: যেহেতু আমরা মানূষ। তাই আমাদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে অসহায় মানূষকে সহযোগিতা করা।

২১ শে মে, ২০২০ রাত ১০:০০

আহমেদ রুহুল আমিন বলেছেন: এক্সাটলি তাই , মন্তব্য প্রদানের জন্য ।

৩| ২০ শে মে, ২০২০ রাত ৩:০৮

নেওয়াজ আলি বলেছেন: মানবিক মানুষ মানুষের জন্য

২১ শে মে, ২০২০ রাত ১০:০১

আহমেদ রুহুল আমিন বলেছেন: তাই’তো....। ধন্যবাদ ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.