দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছর পর, যৌবনের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়সের দিকে উকি দেয়া স্বাধীন বাঙলার তৃতীয় প্রজন্ম আপনা হতেই দায়িত্ব পায় স্বাধীনতাত্তোর হিসেব নিকেশ কষার। এমন গুরুদায়িত্বভারে নুজ্ব্য যুবাকে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় সকল প্রাপ্তির নথিপত্র খুজে বের করতে। দু’য়ে দু’য়ে চার মেলে, কিন্তু কি বিচিত্র - প্রাপ্তির হিসেব মেলেনো যায় না। বাসন্তী বাতাসে তাই চায়ের কাপে দু চুমুক দিয়ে, গালমন্দটাই করতে ইচ্ছে করে বেশি। তবু বিক্ষিপ্ত গালমন্দে না গিয়ে সরাসরি সোজা সাপ্টা প্রাপ্তির চুলচেরা বিশ্লেষণটা কষ্ট সাধ্য হলেও, বাংলাদেশের সেটা আমাদের কাছে প্রাপ্য। আমাদের দাদা-নানারা যুদ্ধ করলো আর আমরা উত্তরসূরী হয়ে কিছু বক্তব্যইতো পেশ করার প্রয়াস জ্ঞাপন করি।
যে মশালের আগুনে ৭১-এ দাহ হয়েছিলো অবাঙালী শাসকের দল সে মশালে আগুন লেগেছিলো সেই ৫২’তে। বাঙালী জাতি নিজ সংস্কৃতির মুক্তি লক্ষ্যে ত্যাগ স্বীকারে একমাত্র নির্দশন। কিন্তু, হায়! নিজ হাতে নিজের সংস্কৃতির গলাটিপে দিয়েছি আমরা। আমাদের সৃজনশীল চর্চার মাঝে একটা কৃত্রিমতার ছোয়া বিরাজ করে। সংকর উপাদানের মিশেলে অপসাংস্কৃতিক হেঁশেলে যেন পাক হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প। মজার বিষয় হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সাংস্কৃতিক সৃষ্টিগুলো এখন শ্রেণীর বা বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমজনতার জন্য কোন সাহিত্য নেই, কোন চলচ্চিত্র নেই, কোন সংগীত নেই, আমাদের নতুন প্রজন্ম আদতে কিছুই পাচ্ছে না। আমাদের মামা-চাচারা কিশোর বয়সে আমাদের নিয়ে একত্রে বসে বাংলা নাটক দেখাতেন, বাংলা ব্যান্ডের গান শোনাতেন আর আমরা এখন আমাদের ভাতিজা-ভাগিনাদের শোনাই গুচি গ্যাং আর দেখাই হিন্দি সিরিয়াল। এখানেই শেষ নয় ভালগার কন্টেন্ট-এর পরিমান এতটাই বেড়েছে যে এখন একসাথে বসে বিনোদন নেয়াটা স্মৃতিরোমন্থন মাত্র। সস্তা বিনোদনের সহজলভ্যতায় গণমাধ্যমের গুণগতমান আরো একদশক আগে কমে গিয়েছে। এছাড়াও মিডিয়াগুলোর রাজনৈতিক মেরুকরণ আর অরাজনৈতিক মিডিয়াগুলোর হলুদ সাংবাদিকতা মানুষকে দেশীয় গণমাধ্যমবিমুখী করে দিয়েছে। পরিবর্তন হবে, সামাজিক আচার রীতি বিবর্তিত হবে এটাই নিয়ম। কিন্তু পরিস্থিতি যা দাড়িয়েছে আজ থেকে আরো পাঁচ দশক পর বাঙলা সংস্কৃতির নিদর্শন প্রদর্শিত হবে জাদুঘরে। টিকেট কেটে বাঙালী নিজেই যাবে এসব জাদুঘরে নিজেদের খুজে বেড়াতে। আর এখনতো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমরা বাঙালীরাই নিজেদের কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছি। এখন আর কেউ তাই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে না, কেউ এখন ক্ষমতাসীনদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সাহস দেখায় না। মানুষ দেখেও না দেখার ভান করে চুপ করে থাকছে। যে দেশের মানুষ নিজের ভাষার জন্য প্রাণ দিলো সে দেশের মানুষের এখন মনের কথা খুইলা কওয়ার অধিকার নাই। এই আইনের ধ্বংসাত্মক হাতির মাহুত সরকার একা নয়। এর জন্যে সমানভাবে দায়ী আমাদের শস্যদানা পুষ্ট কট্টরপন্থী রাজনৈতিক, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো। এই দেশে সেকেলে ধর্মীয় রাজনীতির চর্চা এখনো চলে এটা একটু অবাক হওয়ার মতই। বৃটিশ রাজ যে ধর্মীয় বিদ্বেষের বীজ এই গোটা উপমহাদেশে বপন করে গিয়েছে, তা এখন মহীরুহ। এই মহীরুহ এর যে ফল দেশে দাংগা ফ্যাসাদ বহাল রেখেছে, না চাইতেও বলতে হয় তারা বাঙালী। কাদের দোষ দেবেন? মুসলিমদের? দোষ দেয়া যায়, কারণ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র আমাদের। কিন্তু একজন ছাত্র ক্লাসে দুষ্টোমি করলো দেখে শিক্ষকের গোটা ক্লাসকে দোষারোপ করটা অন্যায় ক্ষমতা প্রদর্শন, বরং দুষ্ট ছাত্রের যথার্থ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়াটা তার কর্তব্য।
আমাদের এই রাষ্ট্রে বর্তমানে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট প্রহসন হলো আইনপ্রয়োগকারী বাহীনির কার্যক্রম। কখন কাকে ধরে নিয়ে যায়, কখন কার নামে কি মামলা হয়, কখন কার মৃত্যুদন্ড হয় কোনো ঠিকঠিকানা নাই। এমনকি কোন অপরাধের জামিন হবে আর কোন অপরাধের জামিন নামঞ্জুর হবে এটাও বলা মুশকিল। আমাদের স্বাধীনতার পর আইন, বিধিনিষেধ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণীত হলেও; কোন আইন কার জন্য প্রযোজ্য এ সংক্রান্ত কোন নীতিমালা আমরা পাইনি। অবস্থা বর্তমানে এমন যে এই যুগের কাজী নজরুল ইসলাম কে ধরে গুম করা হতো, নয়তো ক্রসফায়ারে দেয়া হতো আর নাইলে রিমান্ডে নিতে নিতে এক্কেবারে পগার পার করে দেয়া হতো। আমাদের বিচার আমাদের আইন সাধারণ জনগণের জন্য নয়, ক্ষমতাবানদের জন্য। এই দেশে ন্যায়বিচার চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়, যা আমজনতার ক্রয় সীমার উর্ধ্বে।
এই দেশে একটা দুর্ঘটনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কাছাকাছি যেকোন হাসপাতালে নিলে হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিতে চায় না। এটা কেন? কোন হাসপাতালের সামনে কিন্তু সিটিজেন চার্টারে লেখা নাই, এখানে দুর্ঘটনাকবলিত রোগীর চিকিৎসা হয় না, রোগীকে নির্দিষ্ট চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান। মানুষজন সরকারী হাসপাতালে যেতে চায় না, এর কারণ কি? একমাত্র নিরুপায় লোকজনের ভিড় পাবেন সরকারী চিকিতসাকেন্দ্রগুলোতে। এর উপর নির্ধারিত ফি প্রদান করে পাবেন না চিকিৎসা। চিকিৎসকগুলো যে রামগুড়ুরের ছানা তা কিন্তু নয়। দেখবেন এই সব হাসপাতালের ডাক্তার আপনাকে রেফার করবে কোনো না কোনো ক্লিনিক কিংবা প্রাইভেট চেম্বারে (লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে)। একটা বেড নিবেন রোগীর জন্য? দালাল না ধরলে পাবেন না। এ যেন এক অলিখিত নিয়ম, না মানলে পড়ে পড়ে মরে পচে যান, তাকাবেও না। আরেকটা ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়, কোনো কারণে চিকিৎসা ভূলে বা এমনি রোগী হাসপাতালে মারা গেলে লোকজন হাসপাতাল ভাংচুর করা শুরু করেন। এতে ক্ষতিটা কার হয়? আবার এই ভাংচুর না করে যাবে কই? বিচার দেবে? বিচার ব্যবস্থার তলদেশতো এমনিতেই ফুটো। তবু এতো ভুল চিকিৎসা হবে কেন? সরকারী হাসপাতালগুলোতে এত কোটি টাকার মেশিনপাতি কেনার পরেও এখনো টেস্ট করতে ক্লিনিকে কেন পাঠায়? এইদিকে দেশের বড় বড় নেতারা, গুণীমানী ব্যক্তিবর্গ দেশের বাইরে কিংবা প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নেন কেন? টাকার গরম হবে নিশ্চয়।
দালাল প্রথা সরকারী অফিসে দরবারেও প্রচলিত। এত এত টাকা বেতন পায় এই কর্মকর্তা কর্মচারীরা এত এত সুযোগ সুবিধা তারপরো হাত পেতে বসে থাকে। ইদানিংকালে সরকার এদের বেতন বাড়িয়েছে বহুগুণ। একজন সরকারী কর্মচারীর সমপদে একজন বেসরকারী কর্মচারীর বেতন অর্ধেকপ্রায়। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন নির্ধারিত সর্বনিম্ন বেতন কাঠামো নাই, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা মানে না, কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত কর্মসম্পাদনে কোন পে আউট নাই, বছর শেষে প্রফিট বোনাস নাই। যারা দেয় তাদের কর্মচারীরা কোম্পানির টাকা মারার ধান্দায় থাকে। সবাই নিজের আখের গোছাতে গিয়ে সকলেই ভুক্তভোগী। তবু আশার আলো আমাদের দেশটা নাকি মধ্য আয়ের। পার ক্যাপিটা ইনকাম মাসে প্রায় ১২০০০ টাকা। কিন্তু আবার এই টাকায় একটা মানুষ শহরে ব্যাচেলর বাসা ছাড়া থাকতে পারে না। এরপর বছর বছর যোগ হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। ইমব্যালান্সটা কিন্তু একটু মনোযোগ দিলেই বুঝে যাবেন। পাল্লার দুইদিক, একদিকে লোক কম কিন্তু ক্যাপিটাল বেশি আর আরেক দিকে আপামর আমজনতা কিন্তু অতি সামান্য নুন পান্তার টাকা। এইদিকে গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে আমরা এত গর্বিত, একবার কি ভেবেছি এই কোটি টাকার রপ্তানির পেছনে কত কোটি টাকার আমদানী আমাদের করতে হয়? ৪৭-এ দেশভাগ পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি ছিলো পাট। সেই পাটশিল্পকে আমরা তিলে তিলে মেরে ফেলেছি। নিকট ভবিষ্যতে আমাদের সংস্কৃতির সাথে পাটের দেখা মিলবে জাদুঘরে।
গণমাধ্যমের বাহিরে যোগাযোগের জন্যে দেশে নানা রাস্তাঘাট, সেতু হয়েছে, হচ্ছে। ট্যাক্স দিয়েছি দিচ্ছি, টোল দিচ্ছি। তারপর এই কাজে আমাদের নেতারা টাকা মেরে দিচ্ছেন। কেউ কাচামাল খারাপ দিয়ে টাকা মারছে , কেউ অন্য কাউকে কাজ বেচে দিয়ে টাকা খাচ্ছে, কেউ কাজ না করে কাজের টাকা তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে। তারপর সেই রাস্তায় যখন কোন মন্ত্রী এমপি যায় তখন সেই রাস্তা জনগণের জন্য বন্ধ। নিরাপত্তার খাতিরে করা লাগে ঠিক আছে। তো তেনাদের দিনের ব্যস্ততম সময়তেই কেন শহরের এ মাথা ও মাথা করা লাগে? রেলে প্রতিবছর ব্ল্যাকে যেনো টিকেট না যায় সেজন্য নেয়া হয় নানা ব্যবস্থা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস অভিনব সব প্রক্রিয়ায় টিকেট সেই ব্ল্যাকেই বিক্রয় হয় আর নাহলে ভেতরে পরিচিত লোক দিয়ে নির্দিষ্ট দামে কেনা লাগে। রেলের ভেতর পানি বিক্রি হয় বোতলের গায়ের দামের চেয়ে বেশি, খাবারের দাম আলাদা আর বলতে। সড়কপথে যেখানে গাড়ি থামে বিরতির জন্য সেখানে অতিরিক্ত দামে খাবার খাওয়া লাগে। এক রমজানের মাসের গল্প, ঢাকা থেকে নোয়াখালী যাবো, পথে ইফতারের সময় হলে আমাদের বাস কুমিল্লার একটা রেস্তোরায় দাড়ালো। খুব যে বিশাল হইচই মার্কা রেস্তোরা ছিলো না, সাদামাটা সিমছাম। আমাদের বাসের মত গোটা দশেক বাস দাড়িয়েছে। ভেতরে ঢুকে দেখি একটা টেবিলে ছয়টা করে চেয়ার লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। যে যেখানে জায়গা পেলো বসে গেলো। প্লেটে করে ইফতার হাজির। সবার সামনে একই ইফতার। তিন টেবিল চামচ ছোলাবুট, একটা পেয়াজু, একটা বেগুনী, একটা খেজুর, একটা জিলেপী আর সাথে একটা ছোট্ট ফ্রুটো। আমি ফ্রুটোর বোতল খুলি নি বাসা থেকে আনা শরবত ছিল সাথে। খাবার শেষে বিল চাইলাম। একজন ওয়েটার, তার হাতে লোকল বাসের কন্ডাকটরের মত একগুচ্ছ টাকা এগিয়ে এসে বললো ১০০ টাকা প্রতি প্লেট আর ফ্রুটো ৩০ টাকা। আমার পাশে বসেছিলেন একজন গ্রাম্য বৃদ্ধ ও তার দুই পরিবারের সদস্য, তারা ভেবলার মত চেয়ে রইলো ওয়েটারের দিকে। কিচ্ছু করার নেই, আমি ১০০ টাকা দিয়ে উঠে চলে আসতে বাধ্য হলাম বাস ছেড়ে দেবার তাড়ায়। আসার আগে দেখলাম বৃদ্ধ তার সাথে কি বোঝাপড়া করছেন আর সে ক্ষিপ্ত হয়ে বাতাসে হাত নাড়ছে। রোজার মাসে বাঙালী আরো চরম পর্যায়ে হেনেস্তা হয়। কয়েক বছর পর এ মৌসুমে শুধু ধনীরাই সিয়াম সাধন করবেন আর আমরা সাধারণ জনগণ খেতে না পেয়ে ভিক্ষা খুজবো।
বছর বছর ট্যাক্স বাড়ে তবু জনগণ সুষ্ঠ সরকারী সেবা পায় না কেন? আচ্ছা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করি তার অধিকাংশ কিন্তু আমদানীকৃত দ্রব্য। আমরা আমাদের দেশজ পণ্য ব্যবহার করি না কারণ, আমরা জানি এই পণ্যের মান ভালো নয়, পণ্য দীর্ঘস্থায়ী নয় নতুবা আমাদের দেশে এই পণ্য তৈয়ার হয় না। খাদ্যদ্রব্যের কথা বলবেন? পেয়াজ বিদেশী, ডাউল বিদেশী, গরু বিদেশ থেকে আমদানী হয়, আদা বিদেশী, ভোজ্য তৈলের কাঁচামাল বিদেশী। মোট কথা দেশে যা কিছু হয় তা দিয়ে শুকনো ভাত খাওয়া লাগবে। ইদানিংকালে দেশী কাজগুলো বিদেশে রপ্তানী হয়ে যাচ্ছে, আমদানী হচ্ছে লোকবল। হওয়ার যথাযথ কারণ আছে, আমাদের দেশে প্রশিক্ষিত লোকের অভাব, যারা আছে তাদের উপর আমরা ভরসা পাই না, দেশি লোক না জানি কেমন বাজে কাজ করে। তাইলে বেহুদা এদের শিক্ষার পেছনে সরকার সময় এবং পয়সা খরচ করবে কেন? সরকারের করা দরকার করছে; আদতে যুক্তি সংগত কোন বিনিয়োগ পরিকল্পনা বলতে কোন কিছু নাই। এত বছর পর বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় পর্যায়ে আইসিটি-এর মত যুগোপযোগী শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়ার পরেও, অধিকাংশ বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাবের অভাব রয়ে গেছে। বড় কথা উপযুক্ত শিক্ষকইতো নাই। এমনো মহাবিদ্যালয় আছে যেখানে আইসিটি ক্লাস নেন ইংরেজী শিক্ষক। শিক্ষকদের ব্যাপারে অভিযোগ আছে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে পরিশ্রম করেন বেশি। একজন শিক্ষক যে বেতন পান সেই বেতনে আর যাইহোক সংসার চলে না। সেই শিক্ষকের দোষ কি তিনি যদি বাইরে ৮-১০টা ছাত্র পড়ান? বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্র একটু অন্যরকম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চাকরি মেলে না, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সিট স্বল্প আবার এমন কিছু বিভাগ আছে যেগুলোতে পড়লে শেষমেশ চাকরি মিলবে না। বেসরকারিতে পড়েও চাকরি হবে না শুধু বাপের লাখ দশেক টাকা খরচ। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে চাকরি হবে ভবিষ্যত ভালো, যেসব বিভাগে পড়লে চাকরি হবে ভবিষ্যত ভালো সেগুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলো বাতিল করলেই হতো। দরকার কি এত শিক্ষিত বেকার প্রতিবছর প্রডিউস করার। একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমাদের দেখতে হবে; সেশনজট। সেশনজটের গেড়কেলে ইদানিং কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে। এরপর ছাত্ররাজনীতির অপছায়া। ছাত্ররাজনীতি একসময় এদেশের প্রেস্টিজিয়াস ঐতিহাসিক সৈনিক থেকে ঘৃণিত অপবাদে পরিণিত হচ্ছে।
আমাদের দেশের রাজনীতি জনগণ থেকে কেমনে কেমনে যেনো ক্ষমতাবানদের আর ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের হয়ে গেলো। আমাদের সরকারের পরিবর্তনের পর প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তিত হন, বিরোধী দল পরিবর্তিত হন। দেশ যেমন ছিলো তেমনি থাকে। আমাদের রাজনীতি লোভের, হিংসার আর অহংকারের। বৃহত্তর স্বার্থ বলতে রাজনীতিকরা বুঝে, অদূর ভবিষ্যতে বৃহত্তর মুনাফা পকেটস্থ হবে। এইদেশে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যায় দেশটা যেন তার হয়ে যায়। প্রতি পাঁচ বছরে দেশটা যেন ঠিকায় যায়। আর সেই ঠিকা থেকে লাভ ক্ষমতাসীনদেরই হয়। বিরোধীদলের বিরোধীতার নামে হারামীপনা দেখে জনগণ মজা নেয়। কোন দলই তার বাইরের আর কোন মতাদর্শের কাউকে দেখতে পারেনা, এ যেনো কবিরা গুনা, নিষিদ্ধ পাপ, ট্যাবু। সামাজিক গণমাধ্যমকে পৃথিবীর মানুষ নিজের মতামত প্রকাশের নিরাপদতম মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত করে। সেখানেও কারো মতাদর্শের বিপক্ষে গেলে আপনার নামে এত মানুষের মাঝে গোটা দশেক কতল পারোয়না ঘোষণার প্রজ্ঞাপন পাবেন, আর কপাল ফেরে সেই পারোয়ানা কার্যকর হয়ে যেতেও পারে। গণতান্ত্রিক চর্চা বলতে কিচ্ছু নাই। এই দেশের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে মূর্খ করে রাখা হয়েছে; এদের যদি সুষ্ঠ নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে দেয়া হয় এরা যোগ্য ব্যক্তিটিকে নির্বাচিত করতে পারবেন না। জাতীয়তাবোধের অ আ ক খ আমাদের জানা নেই। এটাতো অতিসাধারণ কথা আপনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের হয়ে থাকুন, জাতিগত উতকর্ষ আপনার নিকট সর্বদা সবার আগে। এই কারণে যখন কোন বিদেশী গণমাধ্যম আমাদের দেশের নামে কুৎসা রটায় আমরা পক্ষ নিই বিদেশী গণমাধ্যমের।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায় আমাদের সবকিছু কেমন যেনো অন্তঃসম্পর্কিত। আমাদের একথা অকপটে স্বীকার করতে হবে, যা কিছু দিয়ে হতাম মোরা বিশ্বে অনন্য, একমাত্র; তিলে তিলে তা করেছি নিধন, হচ্ছি সর্বস্বান্ত। আমাদের মারাত্মক হুজুগ। হুজুগের লেভেলটা এরূপ যে, কাল যদি কেউ বলে কাচা মল খেলে তার আর হার্টের ব্যারাম হইবো না, তাইলে আবাল বৃদ্ধি বনিতা, সাক্ষর নিরক্ষর নির্দ্বিধায় কাচা মল খাওনের লাইন লাগাইবো আর একদল উচ্চ দামে সেটা সিন্ডিকেট বানায়া বেচবো। ভাবতে খুব অবাক লাগে, কাটা কল্লা ব্রিজের নির্মাণ কাজে লাগে, এটা মানুষের মাথায় ঢুকলো কেমনে! জহির রায়হান যদি বেচে থাকতেন তাইলে মনে হয় “সময়ের প্রয়োজনে”- ছোট গল্পের নাম বদলে রাখতেন “হুজুগে”। আধুনিক বাঙালীর রসবোধের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে, তাই ইদানিং হালকা রসের কথা বলতে গেলে সেখানেও আইএসও স্ট্যান্ডার্ডে মেপে মেপে বলা লাগে।
পরিশেষে, মনুষত্বহীন মানুষের খোলশে বাঙালী তকমা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো পোটলা হয়ে গিয়েছি আমরা। যে নিপীড়ন অবাঙালী শাসকেরা শতাব্দী থেকে শতাব্দী করেছিলো তা এখন নিজের স্বজাতি ভাই করে। কথা কইতে দেয় না, খাইতে দেয় না, হাটবার জায়গা দেয় না, পড়তে দেয় না, কাটা ঘায়ে ব্যান্ডেজ লাগাতে দেয় না, মাথার উপর ছাতা ধরতে দেয় না। বাঙালী হিসেবে আমি গর্বিত নই পাঁচ দশকে দাঁড়িয়ে আমার লজ্জা হয় নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে। আমি গর্বিত হওয়ার মতো কিছু নাই; এই দেশের সকল প্রাপ্তি হয়তোবা কোনো ব্যক্তির, নয়তো কোনো দলের, নয়তো কোনো পরিবারের। এই দেশে ক্ষমতায় পরিচিত কোনো লোক আপনার নাই, এদিক ঐদিক টাকা ফেলার সামর্থ্য নাই তাইলে সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা, রাষ্ট্রীয় অধিকার আপনার জন্য একদম নিষিদ্ধ। এই স্বাধীনতা দিয়ে কি করবো আমরা এইটাই এখনো বুঝে উঠতে পারি নাই। স্বাধীনতার পঞ্চাশটি বছরে প্রাপ্তি হচ্ছে একগাদা প্রশ্ন, যার উত্তর মেলে না। অতি শীঘ্র এই স্বাধীনতা দিয়ে করবো কি সেটা ফিগার আউট করতে হবে। বাঙালীর জাতিগত উতকর্ষের মনোভাব প্রদর্শন চর্চা করতে হবে। সবাইকে নিয়ে একসাথে সামনে এগুতে হবে। না’হলে দেখা যাবে এইভাবে চলে যাবে স্বাধীনতার এক শতাব্দী, আর সেদিন প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে আবার ক্ষোভ আর ক্লেশ ঝাড়ার জন্য বাঙালী সত্ত্বাটাই থাকবে না। ভালো থাকুক আমার সোনার বাংলা, সবুজ-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২১ সকাল ১০:৫৭