পিলু ক্যাফে। বিক্রিত পণ্য: চা, বিস্কুট, সিংগারা, পেয়াজু এবং জিলাপী। টেবিল সংখ্যা পাচটে, প্রত্যেক টেবিলের সাথে তিনটে করে চেয়ার। টেবিল চেয়ার সবই প্ল্যাস্টিকের। কাউন্টারে একটে নব্বই দশকের টেপরেকর্ডার আছে তাতে এখনো আশির দশকের বাংলা এবং হিন্দি সিনেমার গানের ক্যাসেট বাজে। চায়ের কাস্টমারের অভাব হয় না, আর বিকেলে মৌমাছির সাথে সাথে মানুষের ভিড় লেগে যায় জিলাপীর রস গলধঃকরণে। তবে চৈত্রের কাঠ ফাটা রৌদ্দুর ভেজা দুপুরে চা পানের খদ্দের খুব একটা জোটে না। যারা আসে তারাও এক গেলাস জল পান করে ফুটে নতুবা বসে পাখার বাতাসে শরীর জুড়ায়। কিন্তু জসিম সাহেব খাসা মাল। গরমে শার্ট ভিজে জবজবে হয়ে গেলেও মধ্যাহ্ন চা পানে জিহ্বা পোড়ানো তার চাই। পৃথিবীতে এমন নানা অদ্ভুত শখে শৌখিন মানুষ পাওয়া যায়। আর এইসব শখ মেটানোর জন্য সংগীও পাওয়া যায় না। পিলু কাফেতে আজই প্রথম এসেছেন মি. জসিম। এককোণার একটা ফাকা টেবিল বেছে নিয়েছেন, মাথার উপর বয়সের ভারে ক্লান্ত পাখাটা ধীর গতিতে ঘুরছে। পাখার ব্ল্যাডগুলোতে ময়লার পুরু স্তর। টেবিলের সাথে লাগোয়া জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে গরম বাতাস এসে শরীরে ঝাপটা দেয়। মি. জসিম অপেক্ষা করছেন চায়ের জন্য। তারা জানিয়েছে চা হতে সময় লাগবে। এতে তিনি বিরক্ত নন। চা একটু সময় নিয়ে আসলে তার স্বাদ ভালো হয়। তবে একলা বসে থাকা বিরক্তির। তাই বসে বসে ভাবছেন তিনি, মানুষের মৌলিক কোন আবেগ নেই। মানুষের আবেগ মিশ্র, এই যেমন তার নিজের কথাই ধরা যাক; অপেক্ষা করতে আনন্দ লাগছে কিন্তু একলা অপেক্ষা করতে বিরক্ত লাগছে। তাহলে প্রশ্ন এসে যায় আসলে এমুহুর্তে তিনি কি আনন্দিত না বিরক্ত?
"দাদা নমঃস্কার"
মি. জসিমের চিন্তায় ছেদ পড়লো। তিনি জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখলেন টেবিল ঘেষে এক ভদ্রলোক দাড়িয়ে আছেন। তিনি আগা থেকে গোড়া লোকটাকে দেখলেন। রোগ লিকলিকে শরীর, মাঝারি উচ্চতা, কাঁধ একপাশে ঝুকে আছে। পরনে একটা সবুজ সাদা চেক শার্ট আর নীল জিন্স। দেখে মনে হচ্ছে বয়েস চল্লিশের ঘরে। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তবে তিনি মনে করতে পারছেন না, এই ভদ্রলোকের সাথে কোথায় কবে তার দেখা হয়েছিল। জসিম সাহেব বললেন,
“আদাব, তবে আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না”
“তাতো বটেই চিনতে না পারারই কথা”
ভ্রু কুচকালেন মি. জসিম, মনে মনে ভাবলেন সর্তক হওয়া উচিত কি ধান্দায় এসেছে কে জানে। আড়ষ্টতার সাথে বললেন,
“তা কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”
লোকটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,
“মশাই আপনিতো বড় অদ্ভুত ইনসান দেখি, পরিচয় জানতে চাইবেন বসতে বলবেন, তা না বরং কপাল কুচকে চেয়ে আছেন আমার দিকে! সাহায্য যদি করতেই চান তো আমার সাথে খানিক আড্ডা মারুন তাতেই হবে।”
“ঠিক আছে বসুন”
বললেন মি.জসিম। লোকটা তার বিপরীত দিকের চেয়ারে বসে বেয়ারাকে ডাক দিলেন,
“চা দিস দুটো”
বেয়ারা টেবিলের কাছে না এসেই বললো,
“সময় লাগবে”
মি. জসিম এবার বললেন,
“আমার চায়ের অর্ডার দেয়া হয়েছে।”
লোকটার মুখে এখনো মুচকি হাসি লেগে আছে, তিনি বললেন,
“সমস্যা নেই এরা বুদ্ধিমান বুঝে নেবে।”
“তা আপনার পরিচয়?”
প্রশ্ন করলেন মি. জসিম।
“আমি কালীতলার নরেন্দ্র, আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে নদুদা নামেই চেনে। তা পিলু কাফেতে প্রথমবার দেখলাম আপনাকে। আপনার নাম আমি জানিনে।”
লোকটা উত্তর দিলো। জসিম সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন,
“আমি জসিম, জসিম হাওলাদার। কাজে এসেছিলাম এখানে। দুপুরে চা পানের শখ এখানটাই ভিড় কম দেখে ঢুকে পড়লাম।”
মি. জসিম অযাচিত মধ্যাহ্ন সংগ পেয়ে প্রথমে বিরক্ত হলেও এখন বেশ স্বস্তি পাচ্ছেন। অন্তত চায়ের জন্য একলা তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। নদুদা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন,
“জেমস বন্ড দেখেছেন?”
“নাতো”
সহজ উত্তর মি. জসিমের।
“এক ব্রিটিশ গুপ্তচরের গল্প। তার পরিচয় দেয়ার স্টাইল ঠিক আপনার মত”
নদুদা হাসি মাখা মুখটা তার দিকে ঘোরালেন। মি. জসিম হালকা ঠোটের কোন উচু করে বললেন,
“আমাকে তাই বলে গুপ্তচর ভাববেন না। আমি সাধারণ ব্যাংকার মাত্র”
তার কথা শুনে নদুদার ঠোটের কোনে হাসির রেখা বড় হলো। তিনি এবার শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বললেন,
“চা আসতে বড্ড সময় লাগাচ্ছে। আপনাকে একটা গল্প শোনাই। চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একটা গল্প শুনে ফেলা হবে আপনার। গ্যারান্টি দিচ্ছি দাদা ভালো লাগবেই”
“হুম ঠিক আছে”
মি. জসিম মাথা নেড়ে বললেন। নদুদা এবার সামনে ঝুকে এসে শুরু করলেন।
“বছর ঠিক আমার খেয়াল নেই, তবে বেশ আগের কথা আমি তখন তাগড়া জোয়ান; কালীতলায় একখান বিশাল দীঘি ছিলো। দীঘির চারপাশে ছিলো ঝাউ গাছের বেড়া। এখন নেই দীঘিটা। সেখানে ভরাট করে বিশাল পার্ক করা হয়েছে, কোন বছর ভরাট হয়েছিলো সেটাই খেয়াল পড়ছে না।”
“আচ্ছা সমস্যা নেই,আপনি বলুন”
মি. জসিম হাই তুলতে তুলতে বললেন, আর মনে মনে ভাবছেন দোকানে খদ্দের বলতে তারা দুজন অথচ চা দিতে অত সময় লাগছে কেন। নদুদা একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
“আরে দাদা সালটা এই গল্পে গুরুত্বপূর্ণ। যাক বাদ দেন। তা দীঘি ভরাট করার কারণ ছিলো। দীঘিটাতে প্রতি শুক্রবার ভোরে লাশ ভেসে থাকতো, আমার যদ্দুর মনে পড়ে কালীতলায় আমি বাড়ি নেয়ার মাস দুয়েক পর থেকে লাশগুলো পাওয়া শুরু হলো। নাহ বছরটা আমার মনেই পড়ছে না।”
লাশের কথা শুনে মি. জসিমের ক্লান্ত ভাব ছুটে গেলো। তিনি এবার সোজা হয়ে বসলেন।
“সালটা না বললেও চলবে, আপনি গল্পটা চালিয়ে যান”
নদুদা প্রথমবারের মতো পূর্ণ বিরক্তি প্রকাশ করলেন,
“ঠিক আছে। তা টানা তিন সপ্তাহ লাশ পাওয়া যাওয়ার পর দীঘির চারপাশে পুলিশের টহল বসানো হলো। কিন্তু তারপরের সপ্তাহেও লাশ পাওয়া গেলো। এবার লাশ টুকরো টুকরো করে কাটা। জ্যাক দ্য রিপার এর নাম শুনেছেন?”
মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন মি. জসিম। নদুদা মাথার পেছনে দু হাত দিয়ে আবার চেয়ারে হেলান দিলেন। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে পা নাড়তে নাড়তে বললেন,
“শুনেছি শিকার করার পর এই সিরিয়াল কিলার এন্যাটমিকালি পারফেক্ট ভাবে ভিকটিমকে ব্যবচ্ছেদ করতো। শুনেছিলাম এই নতুন টুকরো লাশটিও এন্যাটমিকালি পারফেক্টভাবে ব্যবচ্ছেদ করা। ভড়কে গেলো পুলিশ। পাহারার পরেও কেমনে এই লাশ এখানে পাওয়া গেলো তারা বুঝতেই পারলো না। এবার গোয়েন্দা বিভাগকে ডাকা হলো। তারা হিসেব মেলাতে না পেরে পাহারা জোরদারের পরামর্শ দিলো। আবার শুক্রবার লাশ মিললো। এবার সবার চক্ষুছড়াক গাছ। লাশ আসছে কোথা থেকে। আগের লাশগুলোর পরিবারের হদিস মিলছে না। কেউ হারিয়ে যাওয়ার রিপোর্ট করেনি। তাইলে কারা এই ভিকটিম। গোয়েন্দাদের মাথা খারাপ। লাশগুলো ময়নাতদন্ত করেও কোন ক্লু পাওয়া যাচ্ছিলো না। তারা বাড়ি ফেরত গেলো। পুলিশ তার পাহারা বহাল রাখলো। টুকরো লাশ পাওয়া বন্ধ হলো না। এ সময় হঠাত খবর এলো, জনতা পার্টির নেতা গুম হয়ে গিয়েছে। মানুষের কানের দিক ঘুরে গেলো। কান পাতলো নেতার দিকে। লাশ মিলছেই কিন্তু লোকজন তাতে আর কান দিলো না। আমার মনে হয় দাদা এই মানুষ প্রজাতি বড় অদ্ভুত। বুঝলেন তার মশলা চাই। আবার এক মশলা হলে হবে না, মশলার অদলবদল হওয়া চাই।”
ফ্যান থেকে চোখ নামিয়ে মি. জসিমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। জসিম সাহেব বললেন,
“তা ঠিক বলেছেন। আচ্ছা নদুদা আপনার কি মনে হচ্ছে না চা দিতে বড় দেরী করেছে এরা?”
নদুদা আবার ফ্যানের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন,
“তা অবশ্য করছে তবে গল্পটা শেষ করার সুযোগ পাবো। যেখানে ছিলাম। জনতা পার্টির নেতা নিখোজ হওয়ার মাসখানেক পর মনে হয় বা আরো পরে, তার লাশটা মিললো দীঘিতে। দেশজুড়ে শুরু হলো তোলপাড়। খুনিকে বের করতেই হবে। ভিকটিমদের পরিচয় মিলতে লাগলো। সব জনতা পার্টির চেলা চামুন্ডা। জনতা পার্টির লোকজন গা ঢাকা দিতে শুরু করলো। সবাই ভাবলো শিকারী মনে হয় এবার গা ঢাকা দেবে। কিন্তু পরের শুক্রবার আবার শরীর পাওয়া গেলো। এবার পাওয়া গেলো এক পুলিশের লাশ। পুলিশ খেপে গেলো। খুনিকে খোজার দৌড়ঝাপ শুরু হলো জোরেসরে। এরপর পাওয়া গেলো বিদেশীর লাশ। আন্তর্জাতিক মহলে তোলপাড়। কুটনৈতিক ইস্যু হয়ে দাড়ালো কালীতলার লাশগুলো। সরকার সাড়াশী অভিযানের ডাক দিলো। সাড়াশী অভিযানের মধ্যেই শুক্রবারে পাওয়া গেলো এবার এক সরকারি চুনোপুটির লাশ। অবস্থা বেগতিক। সরকার পড়লো দোটানায়। নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। সবার মনে প্রশ্ন কে হবে নতুন ভিকটিম। কিছু কন্সপিরেসি থিওরিস্ট রটাতে চাইলো এইটা ভিনগ্রহের প্রাণীর কাজ। মানুষ এই গল্পে মজে গেলো। বিশ্বাস করতে লাগলো ভিন গ্রহের প্রাণীই করেছে। নাহলে খুনীর পরিচয় মিলবে না কেন? বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ আর সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ অভিযানে ধরা পড়লো এক সবুজ রঙা প্রাণী। পেপারে তার ছবিসহ এসেছিলো। বাসায় করাত, চাপাতি, সার্জিক্যাল টুলস ছাড়াও গ্রে’স এনাটমি বই, মানব শরীর সংক্রান্ত বই পাওয়া গিয়েছিলো। অবশ্য নিরাপত্তা বাহিনী তাকে জ্যান্ত ধরতে পারেনি। সে অভিযানে মারা যায়। পরদিন মানে শুক্রবার ভোরে লাশ মেলে নি কোন। তারপর থেকে লাশ আর মেলেনি। আর সরকারি সিদ্ধান্তে অভিযানের দুমাসের মাথায় ভরাট করা হয় দীঘি।”
মি. জসিম কিছু বলেন না। তিনি নির্লিপ্তভাবে বসে আছেন। নদুদা বললেন,
“আপনার কি মনে হয়? আসলেই কি ভিনগ্রহের প্রাণী খুনগলো করছিলো?”
“না, আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় সরকার খুনগুলো ঘটিয়েছে। আর আসল খুনীকে বাচাতে গল্প ফেদেছে।”
নদুদা মুচকি হাসলেন এবার সোজা হয়ে বসলেন,
“আমার কি ধারণা জানেন? আমি মনে করি শিকারী আসলে সাধারণ একজন পাবলিক। তার কোন মোটিভ নেই। তার মোটিভ একটাই নিজের গা বাচানো। সেজন্যই সে টার্গেটগুলো খুব বেছে বেছে নির্বাচন করতো। আর চিন্তা করলে দেখবেন সব সহজ টার্গেট। আর যদি বলেন খুন বন্ধ হলো কেন তাহলে বলবো আমার মতে সে অবসরে যেতে চাইছিলো।”
মি. জসিম মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। নদুদার মুখে সেই মুচকি হাসি ফিরে এলো।
“আচ্ছা জসিম দা আপনি যেনো কোন ব্যাংকে আছেন?”
মি. জসিম ব্যাংকের নাম বললেন। নদুদা টেবিলের উপর ঝুকে বললেন,
“ফেডারেল ব্যাংকের কেলেংকারীর সাথে আপনাদের ব্যাংক জড়িত ছিলো। মানে আপনাদের ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিলো।”
মি. জসিম হেসে বললেন,
“জ্বি। এবং আমিই কেলেংকারীটা ধরেছিলাম।”
নদুদা বললেন,
“তাহলেতো বেশ চমতকার একজন মানুষের সাথে বসে গল্প করলাম।”
জসিম সাহেব এবার বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই বিকেলতো করে দিলে চা কখন দেবে?”
বেয়ারা দূর থেকে উত্তর দিলো,
“এইতো দুই মিনিট”
বেয়ারার দিক থেকে মুখ ঘোরাতে ঘোরাতে ঘাড়ের উপর নিশ্বাস অনুভব করলেন তিনি। একটা কণ্ঠ ফিসফিস করে তার কানে বললো,
“নতুন দীঘি খুজে পেয়েছি”
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৩২