সাদা খাম চিঠিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাগিব।ডাকপিয়নটা মাত্র দিয়ে গেল।কে হতে পারে সেটাই ভাবছে দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।কবে লাস্ট চিঠি পেয়েছে মনে করতে বেশ কতক্ষণ ভাবতে হল ওকে।সে চিঠিটাও সাদা খাম ছিল।বিথি না তো?কিন্তু কয়েকবছর হল ও আর চিঠি দেয়না।বিথি ক্লাস নাইন থেকে ওর পেনফ্রেন্ড।দুই বছরের পরিচয়ে অনেক ভাল ফ্রেন্ড হয়ে উঠেছিল ওরা -ভাবছে রাগিব।কয়েকবার দেখাও হয়েছে।দেখা হবার কথা ভাবতেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগলো।কেউ নেই জেনেও চারপাশে একবার তাকায় রাগিব।ও অনেক চুপচাপ আর লাজুক টাইপের।যতদিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল,বিথিকে নিয়ে আলাদা কিছু মনে হয়নি ওর।কিন্তু প্রথম দেখা হবার পরই রাগিব নিজের ভেতরে অন্য কিছু টের পেল।এর পরেও আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে ওদের।বুকের ভেতরের কাঁপুনিটা একটু একটু করে বেড়েছে শুধু।কিন্তু মুখ পর্যন্ত আর উঠে আসেনি।ও কি কিছু টের পেয়েছিল?? শেষবার যখন দেখা হল তার পর থেকেই আর চিঠি দেয়না ও।কখনো মোবাইল নম্বরটাও চাওয়া হয়নি।চিঠি দেয়া নেয়ার আনন্দটা দুজনের কেউই নষ্ট করতে চায়নি।কয়েকবছর আগের কথা ভেবে মনটা এতদিন পরেও খারাপ হয়ে গেল ওর।দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে ফিরে এল।
হ্যা,বিথিই তো।চিঠিখুলে প্রথমেই চিঠির শেষে চোখ গেল ওর।প্রথম থেকে পড়া শুরু করলো এরপর।লেখার ধরণটা একটু অন্যরকম লাগছে।একটু যেন বেশি জড়ানো আর অক্ষরগুলো ছোট হয়ে এসেছে।দুই বছরতো একদম কম সময় নয়।কত মানুষও এর চে অল্প সময়ে বদলে যায়...।ভাবনা ঝেড়ে আবার পড়তে শুরু করলো চিঠিটা...
ভরা দুপুরে ছাঁদে উঠে এসেছে রাগিব।প্রচন্ড আনন্দ কিংবা খুব বেশি দুঃখ- দু সময়েই রাগিবের সবার আগে ছাঁদ এ আসার কথা মনে হয়।আজ প্রচন্ড আনন্দে ভাসছে ও।কতক্ষণ আগে পাওয়া চিঠিটা এর মধ্যে অন্তত বার দশেক পড়া হয়ে গেছে।এখনো বুকপকেটে রাখা আছে।চিঠির কথাগুলো এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছেনা।কথাগুলো আরো আগে কেন বলেনি ও??রেলিং এ হাত ধরে আবেশে চোখ বুজলো রাগিব।আশুলিয়া।পড়ন্ত বিকেল।ওরা দুজন হাঁটছে,অনেকক্ষণ ধরে।মুখে কোন কথা নেই।বিকেলটাও চুপচাপ।হঠাৎ হাতটা চেপে ধরলো ও।চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালো ওর দিকে।
-কি?...
লালচে আলোতে অনেক সুন্দর লাগছে ওকে।হাসিতে আরো একটু বেড়ে গেল যেন...
-কিছুনা।
একসাথে হেসে উঠে আবার হাঁটা শুরু করলো দুজন।হাতটা এখনো ধরা।সোজা উত্তরে চলে যাওয়া পথটার শেষ না দেখে দুজনের কেউই আজ থামবেনা।
...চোখ খুলে দেখলো পাশের ছাঁদের কাজের মেয়েটা কাপড় নাড়তে নাড়তে ওর দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে আছে।এমন রোদে চোখ বুজে রেলিং ধরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে নাকি।অন্যদিন হলে নিজের ভেতর আরো গুটিয়ে আসতো ও।আজ তেমনটি হলোনা।আজকের দিনটাতো আর অন্যদিনের মত নয়।বুকপকেটে হাত চেপে চিঠিটার অস্তিত্ব আরেকবার অনুভব করলো ও।নাহ,স্বপ্ন দেখেনি এতক্ষণ।চিঠির কথাগুলোও স্বপ্ন নয়।দুবছর পর আবার দেখা হতে যাচ্ছে ওদের।তবে এবার আর শুধু বন্ধু হিসেবে নয়। ...রোদের ঝাঁঝটা আরেকটু বেড়েছে যেন।চারপাশে আর কেউ নেই এই ভরা দুপুরে।সবগুলো ছাঁদ খাঁ খাঁ করছে।রাগিবের তবু কিছু মনে হচ্ছেনা।ও ভাবছে অন্য কিছু।একটা পড়ন্ত বিকেল।দুটো মানুষ।হাতে চেপে ধরা একটি হাত।সোজা উত্তরে চলে যাওয়া একটি পথ...
**
নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই এসে বসে আছে রাগিব।একা।বন্ধুরা সবাই বিথির কথা জানে।কিন্তু ওর প্রতি দুর্বলতার কথা রাগিব কাউকে বলেনি ।মাঝে মাঝে বন্ধুদের কেউ কেউ এটা নিয়ে ফান করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে ও।বিথির চিঠি দেয়ার কথা কিংবা আজ এখানে আসার কথাও কাউকে জানায়নি ও।আজ দেখা হোক।তারপর সবাইকে ব্যাপারটা বলে দেবে ও...
রাগিবের একটু নার্ভাস লাগছে।একটু কি??কিছুক্ষণ পর পর রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে।অল্প নার্ভাস হলে ওর কখনো এমন হয়না।তার চে অন্য কিছু নিয়ে ভাবি-ভাবলো রাগিব।আচ্ছা, ও আজ কি পড়ে আসবে??আগের মতই সালোয়ার কামিজ,নাকি শাড়ি? এক চিঠিতে ও লিখেছিল বিশেষ দিনগুলোতে অনেক যত্ন করে শাড়ী পড়ে ও।আজ কি সেরকম বিশেষ দিন নয়?যদি শাড়িই পড়ে আসে তাহলে কোন রঙা শাড়ি পড়ে আসবে ও?কপালে কি নীল রঙা টিপ থাকবে?কিংবা হাতে কাঁচের চূড়ি?... এত কিছু ভাবার পর হঠাৎ রাগিব খেয়াল করলো এখনো ও বিথিকে নিয়েই ভাবছে। কেমন লজ্জা লাগতে লাগলো ওর।
... সময় হয়ে গেছে।রেস্টুরেন্ট এর দরজার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাগিব।যেকোন সময় চলে আসবে ও।কারো জন্য আগে এভাবে কখনো অপেক্ষা করেনি।তবে আজ করতে খারাপ লাগছেনা।...বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে গেল।এখনো আসছেনা কেন? কিছুক্ষণ পর পর হাতটা সামনে এনে ঘড়ি দেখছে রাগিব।এবার চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাতেই হঠাৎ হার্টবিটটা বেড়ে গেল ওর।কাঁচের দরজা ঠেলে ওর দিকেই সোজা এগিয়ে আসছে।রাগিব সম্মোহিতের মত ওর আসা দেখতে লাগলো।একসময় একেবারে কাছে চলে এল।কোন কথা না বলে সামনের চেয়ার টেনে বসে পড়লো রাশেদ।রাগিব তাকিয়ে দেখে পেছন পেছন দরজা ঠেলে তুহিন,মহিব,রায়হানরাও ঢুকছে।সবাই ওর কলেজ ফ্রেন্ড।প্রথম মুখ খুললো রাশেদ।
-"দোস্ত,মাইন্ড খাইসনা।প্ল্যানটা প্রথম আমার মাথায় আসছে।ওদেরকে বলতেই ওরা একপায়ে খাড়া।আর চিঠি লেখাইছি মহিব রে দিয়া।"
-"কিরে চিঠি লেখাটা কেমন হইসে রে??সত্যি করে বল তোর কি মনে হয়নাই এইডা বিথি লিখসে??" বলা শেষ করেই সবগুলো দাঁত বের করা টিপিক্যাল হাসিটা ছাড়লো মহিব।
আর সবাই ততক্ষণে চারপাশে চেয়ার টেনে বসে পড়েছে।রাগিবকে মস্ত বড় ভেড়া বানানোর বিজয় আনন্দে একেকজন মহা খুশি।সবার মুখেই একান ওকান বিস্তৃত হাসি।
-"কি দোস্ত,বেশি মাইন্ড করলি নাকি??" ইমন জিজ্ঞেস করে।
-"বেশি মাইন্ড করে থাকলে আমরা স্যরি।" পাশ থেকে রায়হান বললো।মুখের হাসিটা অবশ্য তা বলছেনা।
ওদের কথায় জোর করে মুখে হাসি ধরে রাখে রাগিব।ধাক্কা সামলে এমন বোকা বানানোর তারিফ করতে করতে রাশেদটার পিঠও চাপড়ে দেয় এক ফাঁকে।দেখে কে বলবে হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্ন কাঁচটুকু এইমাত্র টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়লো।
...সোজা উত্তরে চলে যাওয়া পথটাতে হঠাৎ ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো।হাতটা ছেড়ে দিয়েছে সেই কখন...