আজকে আপনাদের একটা গল্প শোনাবো।। একটা জীবনের গল্প।। একটা পরিবারের গল্প।। শুনলে মনে হবে হয়তো কোনো সিনেমার কাহিনী।। কিন্তু কথা দিচ্ছি, শুধু যা সত্য তাই বলবো।। একবিন্দু বাড়িয়ে বলবো না।।
একদিন দুপুরে চাঙ্খারপুল মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি রিকশার জন্য।। নীলক্ষেতে যাবো।। ৩টার মধ্যে পৌঁছতে হবে, কিন্তু ঘটনাস্থলেই ২.৫০ বাজে।। রাস্তায় রিকশা অনেক কম।। শেষে একজন বুড়ো রিকশাওয়ালা পেলাম।। আমি সচারচর বুড়ো মানুষের রিকশায় উঠি না।। আর উঠলেও ন্যায্য বাড়ার চেয়ে খানিকটা বেশি দেয়ার চেষ্টা করি।। আজকে তাড়া থাকায় রিকশায় চেপে বসলাম।। ভাড়া ঠিক করা হয় নি।। ভাবলাম গিয়ে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিবো।। তখনো খেয়াল করি নি যে উনার রিকশার পিছনে একটা কাপড়ের ব্যানারে কিছু একটা লেখা আছে।। এমনিতেই দৌড়ের উপর আছি!! এতকিছু খেয়াল করার মানসিকতা ছিলো না।। হয়তো খেয়াল করতাম না যদি উনার পিঠেও প্রায় একই একটা লেখাসহ কাগজ সাঁটানো না থাকতো।।
কি লেখা ছিলো সেই কাগজে??
S.S.C - 2008, G.P.A - 5 (A+)
H.S.C - 2010, G.P.A - 5 (A+)
আমার মেয়েটি ডাক্তারি পড়তে সরকারী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে ।
বর্তমানে অধ্যয়নরত ।
বই কিনার জন্য সাহায্য করুন ।
আমি বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা ।
আল্লাহ মেহেরবান । (ছবি তুলে রেখেছিলাম।। হুবুহু তাই লিখে দিলাম।।)
ভার্সিটিতে ৪-৫ বছর ধরে পড়ার কারণে এমন অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি।। প্রায় প্রতিদিনই অনেকে আসেন রোগের জন্য টাকা তুলতে।। কেউ মায়ের জন্য, কেউ বাবার জন্য, কেউ বা ভাইবোনের জন্য।। যতটা পারি সাহায্য করি।। খালি হাতে ফিরিয়ে দেই না কাউকেই।। আজকে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "চাচা, বাড়ি কই আপনার??"
"শ্যামলী।।"
"আপনার মেয়ে কোন মেডিকেলে চান্স পাইছে??"
"সিলেটে গো বাজান।।"
"সেখানে কই থাকে?? হলে??"
"হ বাজান।।"
"ওহ, খরচাপাতি কেমনে চালায়??"
"আমি কিছু কিছু পাঠাই।। কিন্তু নিজে খাইয়া পরিবার খাওয়াইয়া তেমন থাকে না।। তাও যতটা পারি পাঠায় দেই।। আর মাইয়া নিজেও টিউশনি করে দুয়েকটা।। নিজের হাত খরচ চালায়।। মেডিকেল থেইকা তারে ফ্রি বই দেয়।। কিন্তু সব তো দিতে পারে না।। যেইগুলান না দিতে পারে তা কিনতে হয়।। মাইয়াডা মন খারাপ করে পড়তে না পাইরা।।"
শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম।। এরপর জিজ্ঞেস করলাম, "চাচা, আপনার মেয়েরে কোনো সাহায্য পাঠাতে চাইলে কেমনে যোগাযোগ করা যায়?? আপনার কোনো মোবাইল আছে বা আপনার আসে পাশের কারো??"
তিনি একটু ভেবে বললেন, "আমরার ঘরে কারো মোবাইল নাই বাজান।। তবে আল্লাহ চাইলে আমারে পাইবেন ভার্সিটি এলাকায়।। তখন সাহায্য চাইলে দিতে পারেন।। আমি কাউরে জোর করি না বাজান।। কেউ দিলে নেই, নইলে একটা কথাও বাড়তি কই না।।"
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।। আজকে আর সেই মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যেতে ইচ্ছে হলো না।। চাচাকে বললাম রিকশা থামাতে।। তখন টি এস সির কাছাকাছি এসেছি।। মানিব্যাগে টাকা ছিলো না বেশি।। যা ছিলো তা থেকে নিজের বাসায় ফেরার টাকাটা রাখলাম।। বাকি টাকা মুঠো করে উনার হাতে গুঁজে দিলাম।। উনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।। এরপর বললেন, "বাজান আল্লাহ তোমারে বাঁচায় রাখুক।। তোমার দিলটা অনেক সাফ।। ইনশাল্লাহ আল্লাহ তোমার সাহায্য করবে।।"
আমি কিছু না বলে ঘুরে অন্যদিকে হেঁটে চলে গেলাম।। নিজেকে কন্ট্রোল করার অসাধারণ ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।। ইমোশন, খারাপ লাগা, এই ব্যাপারগুলো আমাকে স্পর্শ করতে পারে ন।। কিন্তু কেন যেন সেদিন পারি নি।। চোখের কোণে চিকচিক করতে থাকা পানি কেউ দেখে ফেলার আগেই পরিচিত স্থান থেকে হনহন করে হেঁটে চললাম উল্টো পথে।। অনেক রাত পর্যন্ত একাএকাই হাঁটলাম সেদিন।। উপলদ্ধি করলাম, আমরা পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেয়েও অনেকে ভালো রেসাল্ট করতে ব্যর্থ হই।। চান্স পাই না কোন ভালো ভার্সিটি বা মেডিকেলে, সেখানে একটি মেয়ে, যাকে শুধুমাত্র সাহায্য করে যাচ্ছে তার বাবা, যিনি ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালান, সেই মেয়েটি অনেকের স্বপ্নের সরকারী মেডিকেলে পড়াশোনা করছে।। কি বিচিত্র এই জগত।। কি বিচিত্র সৃষ্টিকর্তার খেলা।।
চাচাকে এরপরেও কয়েকবার দেখেছি টি এস সি তে এবং কার্জনের আশেপাশে।। আর কোনোদিন কথা হয় নি।। প্রতিবারই উনার রিকশায় কেউ না কেউ ছিলেন।। হয়তো সবাই উনাকে এখনো সাহায্য করে যাচ্ছেন, হয়তো তার মেয়েটির পড়ালেখা এখন আরো ভালোভাবে চলছে।।
আপনাদের কাছে একটা আবেদন রইলো।। হয়তো চলতি পথে কখনো উনার সাথে দেখা হতে পারে।। হয়তো উনার রিকশায় কোথাও যেতেও পারেন।। যদি পারেন উনাকে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করবেন।। আমাদের যদি একটা ছোটবোন থাকতো তাহলে কি আমরা তাকে পড়ালেখার জন্য সাহায্য করতাম না?? চাইতাম না বোনটাকে তার প্রিয় কিছু বই কিনে দিতে??
মোবাইল শেয়ার লিঙ্কঃ http://on.fb.me/u8oa1z94
Courtesy:লেখাটা আমার নাহ ফেইসবুক থেকে নেওয়া,আমি শুধু মাত্র আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১২ রাত ১:১৭