মেয়েটির হাসিটি খুব সুন্দর কিন্তু তার শব্দ করে হাসতে মানা, মেয়েটির কান্নার শব্দটি অত্যন্ত করুণ কিন্তু তার কাঁদতে মানা। মেয়েটির হাঁটুনিতেও একটা আর্ট আছে কিন্তু তার ঘর থেকে বের হতে মানা। মেয়েটি এখন ক্লাস এইটের ছাত্রী, আগামীতে তার জে.এস.সি পরীক্ষা কিন্তু তার স্কুল যেতে মানা। তার সবকিছু যেন আটকা পড়েছে পারিবারিক বেড়াজালে। সে বাসায় বন্দি, তার কাজ শুধু ঘরে বসে অপেক্ষা করা। বিয়ের জন্য অপেক্ষা। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চিরদিনের মতো উৎসর্গ করে সমাজের চিরাচরিত নিয়মে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে স্বামী-সংসার নিয়ে দিন কাটানোর জন্য তার শুধু অপেক্ষা।
কিন্তু সেও সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নয়। সে মোটেই ভেঙ্গে পড়েনি। সে যেন ঘরের মধ্যে বন্দি থেকেও স্বাভাবিক। সে তার এই বন্দি দশা থেকে পালিয়ে, বাল্য বিবাহের অভিশপ্ত জীবন থেকে নিজেকে রক্ষা করে, সমাজের চিরন্তন সংস্কার ভেঙ্গে একদিন অনেক বড় হওয়ার, আকাশ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্নে বিভোর। প্রতিকূল অবস্থা থেকে বড় হয়ে কীভাবে সে একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে সে কৌশলও তার জানা আছে।
মেয়েটির বিয়ের জন্য প্রায়ই কোনো না কোনো প্রস্তাব আসছে। বর মিলছে তো ঘর মিলছে না, ঘর মিলছে তো সবদিক থেকে বর মিলছে না আর এই ঘর ও বরের সমন্বয় করে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তার ঘর থেকে বের হতে মানা।
হাতে গোনা কয়েকজন বান্ধবী ছাড়া তার সঙ্গে দেখা করা নিষেধ। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে কোনো পাত্রের হাতে পাত্রস' করার পরই তার এই চার দেয়ালে বন্দি জীবনের অবসান ঘটবে। তখন মেয়েটি শৃঙ্খলিত হবে আরেক শিকলে। সমাজ-সংস্কারের এক অদৃশ্য শিকলে। ।
সেদিন বিকেলে মালা এলো। মালা মেয়েটির ক্লাস ফ্রেন্ড। দরজা নক করতেই মেয়েটির মা, সাবিনা জিজ্ঞেস করলো, কে?
খালা আম্মা আমি মালা।
মালাকে সাবিনা চেনে, সেই শৈশব থেকেই এ বাড়িতে তার আনাগোনা। তাই এ বাড়িতে এখনো তার আসা-যাওয়ার ওপর কোনো বিধি-নিষেধ জারি হয়নি।
সাবিনা জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো মা?
ভালো খালা আম্মা। আপনি?
হ্যাঁ মা, ভালো আছি। বলে সাবিনা মেয়েটির ঘরের দরজায় গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, মালা এসেছে মা, তুই দেখা কর্বি?
হ্যাঁ মা।
কোনো সমস্যা নেই তো?
মেয়েটি বললো, না মা।
ও কাউকে তোর কথা বলবে না তো?
মেয়েটি না সূচক মাথা নেড়ে জানালো সে কাউকে জানাবে না।
সাবিনা বাইরে এসে মালাকে বললো, এসো মা, আমার সাথে এসো। বলে সাবিনা মেয়েটির ঘরে গেলো, মালাও তার পিছনে পিছনে ভেতরে ঢুকলো।
সাবিনা মালাকে মেয়েটির ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, তোমরা গল্প করো।
সাবিনা চলে যাওয়ার পর মেয়েটি ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলো, কাউকে বলে আসিস্নি তো?
না।
তোকে কেউ দেখেছে?
হ্যাঁ।
কে?
মালা বললো, কে আবার, ঐ যে তোর...
মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো, তাহলে এলি কেনো?
মালা বললো, কয়েক দিন থেকে তুই স্কুলে যাচ্ছিস্ না, তাই তোর সাথে দেখা করতে এলাম।
মেয়েটি বললো, বেশ করেছিস্ কিন্তু যাওয়ার সময় ওরা যদি তোকে দেখে ফেলে? যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে?
মালা বললো, বলবো তুই বাড়ি নেই।
মেয়েটি একটু আশ্বস্ত হলো। তার মুখটা একটু উজ্জ্বল হলো, তোর অনেক বুদ্ধি আছে রে মালা। তোর মতো যদি আমার মাথায় বুদ্ধি থাকতো তাহলে আমাকে আজ ঘরে বন্দি হয়ে বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না।
আমার মাথায় বুদ্ধি? তাহলে তো আমিই ক্লাসে ফার্স্ট হতাম?
হ্যাঁ, মাথায় বুদ্ধি আছে বলে, ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি বলেই তো...বলে মেয়েটির কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
মালা সান্ত্বনার বাণী শোনালো, তুই কিচ্ছু ভাবিস্ না। দেখবি ক’দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হবে নাকি আমিই শেষ হয়ে যাবো সেটা কীভাবে বুঝ্লি?
তোর হয়তো সাময়িক কিছু সমস্যা হয়েছে কিন্তু এটা তো আর বেশিদিন থাকবে না।
মেয়েটি কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললো, আসলে তুই কিছু জানিস্ না বলে সবকিছু সহজ ভাবছিস্।
কেনো? কী হয়েছে?
বুঝছিস্ না?
না তো?
বাবা-মা আমাকে আর স্কুল যেতে দিবে না।
মালা জিজ্ঞেস করলো, তুই কোনো দোষ করিস্নি, তোকে খালা আম্মা স্কুল যেতে দিবে না কেনো?
স্কুলের কথা শুনতেই মেয়েটির দু’চোখ ছল ছল করে উঠলো, কণ্ঠস্বর বুজে এলো। সে না সূচক মাথা নাড়লো।
মালা জিজ্ঞেস করলো, তো?
মেয়েটি শুষ্ক হাসি হেসে বললো, বিয়ে দিবে, বিয়ে।
বিয়ের কথা শুনেই মালা যেন চমকে উঠলো, বিয়ে!
মেয়েটি মাথা একবার উঁচু একবার নিচু করে জানালো তাকে বিয়ে দিবে।
তারমানে তোর আর লেখাপড়া করা হচ্ছে না?
বাবা-মা’র সেরকমই ইচ্ছা।
একটা ছেলে স্কুল যাওয়া-আসার পথে তোকে প্রেমের প্রস্তাব দিলো আর তোর স্কুল যাওয়া বন্ধ? তারপর বিয়ে-
মেয়েটি রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ, যদি কোনো কেলেংকারি হয় তবে তো বাবা-মা’র মান-সম্মান থাকবে না।
ও আর অল্প বয়সে কোনো রাস্তার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলে মান-সম্মান থাকবে?
মেয়েদের তো একদিন বিয়ে দিতেই হবে, আমি লেখাপড়া শিখে তো আর জজ-ব্যারিস্টার হবো না।
কে বলে তুই জজ-ব্যারিস্টার হবি না। আজকাল তো মেয়েরাও জজ-ব্যারিস্টার হচ্ছে, তুই ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল, তুই বড় হবি না তো কে হবে?
ওসব তাত্ত্বিক কথা। ক্লাসে ফার্স্ট হলেই সবাই বড় হয় না। অনেক মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েও কত রকমের কাণ্ড করছে। আমি যে করবো না তারই বা বিচিত্র কী।
সেই ভয়ে এত অল্প বয়সে খালা-খালু তোকে বিয়ে দিয়ে দিবে?
এত অল্প বয়সে কেনো? অনেক মেয়ের তো আমার চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হচ্ছে। কেনো আমাদের সঙ্গে যে মনিকা পড়তো, ঝুমা পড়তো ওদের বিয়ে হয়েছে, না? আমারও তো দু’বোনের বিয়ে হয়েছে অল্প বয়সে। তারা সংসার করছে না?
সবই ঠিক আছে কিন্তু এটা বন্ধ হওয়া উচিত। তুই প্রতিবাদ কর্, বলে মালা মেয়েটির দু’হাত চেপে ধরে বললো, আমি তোর পাশে আছি তুই...
আমিও তাই ভাবছি রে, আমি প্রতিবাদ করবো। জন্ম থেকেই তো কষ্ট করে, নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে, প্রতিবাদ করে এতদূর পর্যন্ত এসেছি এখন যদি আমি হেরে যাই তবে যে আমার সব গেলো। আমার খুব খারাপ লাগছে। ক’দিন থেকে স্কুল যেতে পারছি না দেখে আমার মনে হচ্ছে...বলতে বলতে মেয়েটির কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
কয়েক মুহূর্ত দু’জনের মুখে কোনো কথা নেই।
মেয়েটি আবার বলতে শুরু করলো, মালা আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
মালা কৌতূহলী হয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, বল্?
বলছি, বলে মেয়েটি জানালা ফাঁক করে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে মালাকে ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো। মালা মাথা নেড়ে সায় দিলো। এভাবে কয়েক মিনিট কথা বলার পর মালার মুখ উজ্জ্বল হলো।
মালা মেয়েটির মাথা নেড়ে বললো, সেজন্যই তো বলছিলাম তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। তারপর দু’জনে হেসে উঠলো।
সাবিনা আবার ঘরে ঢুকলো, কী হচ্ছে? এতো হাসাহাসি কীসের?
কিছু না মা।
সবকিছু জেনেও মালা জিজ্ঞেস করলো, খালা আম্মা মালা আর স্কুল যাবে না?
না মা।
কেনো?
ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। বিয়ের পর যদি ওর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন পড়াতে চায় তো স্কুল পাঠাবে।
মালা আর কোনো কথা বললো না।
সাবিনা চলে গেলো। মেয়েটির গালে আদর দিয়ে বললো, তুই কিচ্ছু ভাবিস্ না, আমি তো আছি, তুই যেভাবে বল্লি সেভাবেই হবে। এখনি যেন কাউকে কিছু বলিস্ না। ঠিক...
আচ্ছা। মালা চলে গেলো।
চলবে...