রুখাসানা বেগম তখন সবেমাত্র ধামইরহাট উপজেলার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল আগ্রাদ্বিগুন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাস করেছেন। তখনো এরকম একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাল্য বিবাহ এবং বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে তেমন জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। তাই রুখসানাকে এস.এস.সি পাস করার পর কলেজে ভর্তি করে দেয়ার পাশাপাশি তার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। অভিভাবকদের ইচ্ছা এইচ.এস.সি পাস করার আগে যদি ভালো পাত্র পাওয়া না যায় তবে লেখাপড়া চালিয়ে যাবে আর যদি ভালো পাত্র পাওয়া যায় তবে বিয়ে দেয়া হবে।
রুখসানার গায়ের রং ফর্সা, যেন দুধে আলতা, লম্বাকালো কেশ, মুখের গড়ন গোলগাল, নাকটা বাঁশির মতো, চোখ দু'টো মায়াবী, কথাবার্তা এবং চালচলনে একটা বিশেষ ধরণের আর্ট আছে যা সহজে যে কারো দৃষ্টি কাড়ে।
রুখসানার বিয়ের জন্য পাত্র পেতে বেশি দেরি হয়নি, পাত্রের বাড়ি ধামইরহাট। পাত্র পক্ষের অভিভাবকরা মেয়েকে দেখে পছন্দ করেছিলেন। পাত্র নিজেও গোপনে তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় মেয়েকে দেখে পছন্দ করেছিল। মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে পাত্রের সামান্য কিছু আপত্তি থাকলেও মেয়ের সৌন্দর্য্যের কাছে তার লেখাপড়ার ব্যাপারটা গৌণ হয়ে গিয়েছিল। পাত্র মহাশয় রুখসানার রুপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই তিনিও শিক্ষার বিষয়টিকে মেনে নিয়েছিলেন।
পাত্রের নাম আতিয়ার রহমান, মধ্যবিত্ত পরিবারের, বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। তখন তিনি ব্যাংকে অফিসার পদে চাকরিতে জয়েন করেছিলেন। ব্যাংকের চাকরি, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। অফিস থেকে ফিরে আর কোন কাজে আতিয়ার সাহেব মনোযোগ দিতে পারতেন না। স্বল্পশিক্ষিত হলেও সংসারের সমস্ত দায়িত্ব রুখসানা সুচারুরূপে পালন করতেন। নীলা ভালো রেজাল্ট করে এবছর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ছোট ছেলে প্রান্ত এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। সেও লেখাপড়ায় ভালো তাকে নিয়ে স্কুলের শিক্ষকরা গর্ববোধ করেন।
আতিয়ার সাহেবের সঙ্গে রুখসানার সম্পর্কটা বেশ মধুর। আর সে কারণেই বোধ হয় প্রায় দিনই একজন আরেকজনকে খোঁটা মেরে কথা বলে দীর্ঘ দিনের ভালোবাসার ভিত্তিটাকে মজবুত করেন।
আতিয়ার সাহেবের পোস্টিং এখন জয়পুরহাটে। ধামইরহাট থেকে জয়পুরহাটের দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার। তিনি প্রতিদিন মোটর সাইকেল নিয়েই জয়পুরহাটে যাতায়াত করেন। বেশিরভাগ দিনেই তিনি সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বাসায় ফিরেন। আজ রাত প্রায় আটটা অতিক্রম করেছে তবুও তিনি বাসায় না ফেরায় রুখসানা কিছুটা চিন্তিত হলেন। ভালোবাসার চমৎকার সম্পর্কের কারণেই বুঝি এমন হয় একজনের সামান্যক্ষণের অনুপস্থিতিও যেন অন্যজনকে চিন্তিত করে তোলে।
আতিয়ার সাহেব বাসায় ফিরলেন তখন রাত সাড়ে ন’টা বাজে। তিনি মোটর সাইকেল রেখে হাত মুখ ধুয়ে তাঁর রুমে গেলেন। রুখসানা তাঁর পিছনে পিছনে রুমে ঢুকলেন, আজ এত দেরি হলো যে?
আচ্ছা রুখসানা প্রান্ত রুমে আছে?
আছে।
আতিয়ার সাহেব আর কিছু বললেন না। আতিয়ার সাহেব জানেন কোন প্রশ্নের উত্তরে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া বা নীরব থাকাটা রুখসানা একেবারে পছন্দ করেন না। তাই তিনি রুখসানাকে ক্ষেপানোর জন্য তাঁর কথার কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেলেন।
রুখসানা রাগান্বিতকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তোমাকে কী জিজ্ঞেস করলাম?
আতিয়ার সাহেব বললেন, কী? কী যেন জিজ্ঞেস করলে?
আজ এত দেরি হলো কেন?
ব্যাংকে কাজ ছিল তাই দেরি হলো।
এত রাত পর্যন্ত ব্যাংকে কাজ থাকে না? তুমি আমাকে বুঝালে আর আমি মেনে নিলাম।
তা তুমি মেনে নিবে কেন? তোমার যা বিদ্যার দৌড় তাতে চাকরিরতে ব্যস্ততা সম্পর্কে তোমার ধারণা থাকার কথা না।
রুখসানা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, আমার বিদ্যার দৌড় কম, না? কিন্তু আমি কার জন্য লেখাপড়া শেষ করার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছি? তোমার মতো একটা ব্যাংকের কেরানির সাথে বিয়ে না হলে আমিও ঠিকই লেখাপড়া শিখে বড় হতে পারতাম। তখন আমি এই ধামইরহাটে পড়ে থাকতাম না, হয়ত ঢাকা শহরে থাকতাম, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম।
তা যখন পারনি, পরের পায়ে ভর করে যখন দাঁড়িয়ে আছ তখন এত কথা জিজ্ঞেস কর কেন?
কি আমি পরের পায়ে ভর করে আছি?
একথা তো আমি বলিনি তুমি নিজেই বলছ।
এমনসময় দরজা নক করার শব্দ পেয়ে প্রান্ত দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল, আপা তুই?
হ্যাঁ চলে এলাম।
রুখসানা আঁচলে চোখ-মুখ মুছে বেরিয়ে এলো, মা তুই, আয় মা বস্।
নীলা তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে মা?
কিছু না।
কিছু তো নিশ্চয়ই হয়েছে, মা এখন আমি বড় হয়েছি, আমি সব বুঝতে পারি। তোমরা ঝগড়া করেছ।
তোর বাবা আজ দেরিতে ব্যাংক থেকে এসেছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম দেরি হলো কেন? তাতে তোর বাবা একেবারে আমাকে যাচ্ছেতাই বলল।
মা বাবা তোমাকে আজকেও তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কথা বলেছে?
আতিয়ার সাহেব বেরিয়ে এলেন, তুই হঠাৎ করে আসলি কেন মা? কোন সমস্যা? আসতে এত রাত হলো কেন? রাস্তায় কোন সমস্যা হয়নি তো? কার সঙ্গে আসলি?
কোন সমস্যা না বাবা, আমি আর বৃষ্টি একসঙ্গে আসলাম। আমার কথা আমি না হয় পরে বলছি তার আগে তো দেখি তোমাদের বিচার করতে হচ্ছে।
আমাদের বিচার করতে হচ্ছে মানে? আমরা আবার কী করলাম?
বাবা তোমরা আজকেও ঝগড়া করেছ?
ঝগড়া না রে মা আসলে তোর মা কখনো কখনো এমন সব কথা বলে যে আর মাথা ঠিক থাকে না। সামনে আমার জুন ক্লোজিং, আমার ওপর দিয়ে কাজের খুব চাপ যাচ্ছে। তাই আজকে আসতে দেরি হয়েছে। বাসায় আসতেই তোর মা জেরা করতে শুরু করেছে। আসতে দেরি হলো কেন?
তোমার হঠাৎ করে অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে মা তো সেকথা জিজ্ঞেস করতেই পারে, তাই বলে তুমি মাকে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে খোঁটা দিবে?
রুখসানা বললেন, সেকথা তো তোর বাবা আমাকে বললেই পারতো যে আমার কাজ ছিল তাই আসতে দেরি হলো। তা না বলে আমাকে আজে বাজে সব কি কথা বলল।
বাবা তোমাকে না আমি কতদিন বলেছি মা’র লেখাপড়া নিয়ে তুমি কোন কথা বলবে না।
আতিয়ার সাহেব হেসে ফেললেন, তুই যা মা হাত মুখ ধুয়ে আয়, রুখসানা আমাদের খাবার ব্যবস্থা কর।
রুখসানা খাবার রেডি করতে চলে গেলেন।
নীলা বলল, বাবা তোমার মোবাইলটা একটু আমাকে দাও তো।
আতিয়ার সাহেব তাঁর মোবাইলটা নীলার হাতে দিলেন।
নীলা জিজ্ঞেস করল, বাবা ব্যালেন্স আছে তো?
আছে, আজকেই রিচার্জ করেছি।
চলবে...
আমার এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:দুর্নীতিবাজের ডায়েরি-০১
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ক্লিক করুন:আমার ঠিকানা