সিরাজ সাহেব চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর হাতের কাছে টেবিলের ওপর রাখা ওয়্যারলেস সেটটা অনবরত বিড়বিড় করে যেন কথা বলেই চলেছে। মাঝে মাঝে সিরাজ সাহেব মাঠ পর্যায়ে ডিউটিরত পুলিশ অফিসারদের নির্দেশ দিচ্ছেন। থানার ভিতর থেকে একজন পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এলো।
সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী বলে?
স্যার ওতো বলছে ও চাঁদা চায়নি, ওর কাছে কোনও পিস্তল নেই।
ও বলল আর হয়ে গেল, ঠিকমতো পেদানি দিলে ঠিকই স্বীকার করবে। যাও মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা কর। পুলিশ অফিসার হয়েছ আর আসামির মুখ থেকে কথা বের করতে শেখনি।
জি স্যার, বলে পুলিশ অফিসার চলে গেল।
সিরাজ সাহেব আবার কাজ শুরু করলেন।
এমনসময় এক ভদ্রলোক সিরাজ সাহেবের চেম্বারেঢুকে সালাম দিলেন। সিরাজ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি?
আমার নাম সোলায়মান আলী চৌধুরী, আমি শিবলি’র বাবা।
সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী করেন আপনি?
আমি একজন ব্যবসায়ী।
আপনি নিজে ব্যবসা করেন, নিজে একজন স্বচ্ছলমানুষ অথচ আপনার ছেলে একজন চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, ছিঃ।
সোলায়মান সাহেব বললেন, না ওসি সাহেব আমার ছেলে চাঁদাবাজ না, সন্ত্রাসী না। ও কোন ষড়যন্ত্রের শিকার।
হ্যাঁ সব গার্জিয়ানরাই তাই বলে। আসলে আপনারা ছেলেদের কোন খবর রাখেন না, তাই ছেলে কোন অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও তাকে নির্দোষ বলে দাবি করেন।
বিশ্বাস করুন ওসি সাহেব আমি আমার ছেলের খবর রাখি, ও ভালো ছাত্র, সব সময় লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওর কোন বন্ধু-বান্ধবও নেই। আপনি ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ।
আপনি বললেই তো আর ছেড়ে দেয়া যায় না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে এখন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, জিজ্ঞাসাবাদে সন্তোষজনক জবাব পাওয়া গেলে আগামীকাল কোর্টে চালান দেয়া হবে। আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করলে কোর্ট থেকে রিমান্ডে নিয়ে আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সোলায়মান সাহেবের কানে শিবলির চিৎকার ভেসে এলো, না না আমি চাঁদা চাইনি, আমার কাছে কোন পিস্তলও নেই। এর চেয়ে আমি বেশি কিছু জানি না।
সোলায়মান সাহেবের বুক কেঁপে উঠল। তাঁর দু'চোখ সজল হয়ে উঠল। তিনি বিনীত কন্ঠে বললেন, ওসি সাহেব আমি কি একবার শিবলির সঙ্গে দেখা করতে পারি?
অবশ্যই, আপনি বসুন, আমি ব্যবস্থা করছি, বলে তিনি স্যান্ট্রিকে ডাক দিলেন।
স্যান্ট্রি এসে সামনে দাঁড়াল।
সিরাজ সাহেব বললেন, ইলিয়াসকে ডাক দাও তো, বল শিবলির বাবা এসেছে। শিবলির সঙ্গে দেখা করতে চায়।
জি স্যার, বলে স্যান্ট্রি চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ অফিসার ইলিয়াস সাহেব সিরাজ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াল।
সোলায়মান সাহেব ভিতরে চলে গেলেন।
সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর?
দেখি স্যার আমি চেষ্টা করছি।
শিবলির বাবা ব্যবসায়ী, ধনী মানুষ। ছেলেকে দেখে তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করতে পারে। দেখ চেষ্টা কর, কি করতে পার?
জি স্যার আমি দেখছি।
যদি তোমার সঙ্গে আন্ডাস্ট্যান্ডিং হয়ে যায় তবে ফিফটি ফোর-এ চালান দিবে আর যদি আন্ডারস্ট্যান্ডিং না হয় তবে চাঁদাবাজী মামলা’য় কোর্টে চালান দিয়ে আবার রিমান্ড চাইবে।
জি স্যার।
বাবাকে দেখে শিবলি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল, বাবা তুমি আমাকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও, ওরা আমাকে অনেক মেরেছে, রাতে এখানে থাকলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে বাবা।
শিবলি সোলায়মান সাহেবের একমাত্র সন্তান। শৈশব থেকে তিনি তাঁকে অত্যন্ত আদর যত্ন করে লালন-পালন করেছেন। কোনদিন ছেলেকে ছেড়ে একটা রাতও বাইরে কাটান নি। শিবলিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে শিবলির মা প্রায় উদ্মাদ হয়ে গেছেন।
শিবলির কান্নাজড়িত কণ্ঠশুনে সোলায়মান সাহেব আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না, আমি আলাপ করছি বাবা, আমি তোকে নিয়ে যাব, তোকে না নিয়ে গেলে তোর মা যে মারা যাবে, বলে সোলায়মান সাহেব শিবলির চোখের পানি মুছে দিয়ে বেরিয়ে এলেন।
সোলায়মান সাহেব আবার সিরাজ সাহেবের সামনে বসলেন, ওসি সাহেব আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
বলুন।
শিবলি আমার একমাত্র সন্তান, ওকে নিয়ে আসার পর থেকে ওর মা পাগলের মতো হাউ মাউ করে কাঁদছে, আজেবাজে কথা বলছে।
দেখুন শিবলির মা হাউমাউ করে কাঁদছে সেজন্য তো আমি ওকে ছেড়ে দিতে পারি না, আপনি শিক্ষিত মানুষ জানেনই তো আইনের কাছে আবেগের কোন স্থান নেই।
ওসি সাহেব কোনভাবে শিবলিকে আমার জামিনে দেওয়া যায় না? আপনারা তদন্ত করে দেখুন ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমি ওকে আবার থানায় পৌঁছে দিব।
সিরাজ সাহেব বললেন, জিজ্ঞাসাবাদে ও কি বলেছে তা তদন্তকারী কর্মকর্তাই জানেন, আপনি বরং ইলিয়াস সাহেবের সঙ্গে আলাপ করুন।
সোলায়মান সাহেব উঠে আবার ইলিয়াস সাহেবের কাছে গেলেন। তিনি গিয়ে দেখলেন, ইলিয়াস সাহেব একটা লাঠি হাতে শিবলির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সোলায়মান সাহেব রুদ্ধ কন্ঠে ডাক দিলেন, ইলিয়াস সাহেব একবার আমার কথা শুনুন।
ইলিয়াস সাহেব বেরিয়ে এলো।
দু’জনে ফিস্ফিস করে অনেকক্ষণ কথা বললেন। তারপর ইলিয়াস সাহেব বলল, আপনি শিবলির সঙ্গে কথা বলুন আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলছি।
সুলতানা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, দু’হাত উজাড় করে দান খয়রাত করেন, গ্রাম থেকে কোন আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় এলে তাঁর বাসায় উঠেন, তিনি একজন পরোপকারী মহিলা। তিনি যে মাসে কত টাকা খরচ করেন তা তিনি নিজেই জানেন না। কিন্তু তিনি কোনদিন স্বামীরকাছ থেকে জানতে চাননি, তুমি কত বেতন পাও? কিংবা আজ তো মাসের পঁচিশ তারিখ তুমি এত টাকা পেলে কোথায়? বরং সিরাজ সাহেব তাঁকে যখন টাকা দেন তখন তিনি খুশিতে স্বামীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যান।
ঢাকা মেট্রোপলিটনের একটি থানায় সিরাজ সাহেবের পোস্টিং হওয়ার পর তাঁরা প্রথমে স্টাফ কোয়ার্টারে উঠেছিলেন। কিন্তু স্টাফ কোয়ার্টারগুলোর ডিজাইন এবং চাকচিক্য পছন্দ না হওয়ায় সুলতানা সিরাজ সাহেবের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন ঢাকায় একটা এ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য। সিরাজ সাহেব এক রকম জিদ করে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধেশ্বরী রোডে একটা এ্যাপার্টমেন্ট কিনে সেখানে বাসা স্থানান্তর করেন।
সিদ্ধেশ্বরী রোডের বাসায় কয়েক বছর কেটে গেল। ইদানিং সুলতানা ইনিয়ে বিনিয়ে সিরাজ সাহেবকে ধরেছেন একটা প্রাইভেট কার কেনার জন্য কিন্তু সিরাজ সাহেবের একই কথা তিনি প্রাইভেট কার কিনবেন না। তাতে একদিকে যেমন খরচ বেড়ে যাবে অন্যদিকে তাঁর আয় ব্যয়ের সঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিবে।
সুলতানা এসব কিছু মানতে নারাজ তাঁর কথা কত গভর্নমেন্ট অফিসারই তো ঢাকায় স্বনামে বেনামে গাড়ি-বাড়ি করছে, ব্যাংক ব্যালেন্স করছে কারো কিছু হচ্ছে না আর তুমি শুধু একটা প্রাইভেট কার কিনবে তাতেই নানান প্রশ্ন। তার চেয়ে সোজা কথা বল তুমি আমাকে গাড়ি কিনে দিবে না।
সুলতানার এ’কথার উত্তরে সিরাজ সাহেব আর কোন কিছু বলেন না। সিরাজ সাহেবের নীরবতায় সুলতানা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, ঠিক আছে তুমি গাড়ি কিনলে যখন সরকার তোমার কাছে আয়-ব্যয়ের হিসাব চাইবে, তোমার জেল হবে বলে ভয় পাচ্ছ তবে আমার নামে কিনে দাও তখন জেল জরিমানা যা-ই হোক না কেন আমার হবে আমি বলব আমার বাবার বাড়ি থেকে আমার জমি বিক্রি করে গাড়ি কিনেছি।
পুলিশের চাকরি। সীমাহনি ডিউটি, দিন নেই, রাত নেই শুধু অপরাধীর পিছনে পিছনে ছুটে চলা। তারওপর আছে ভি.আই.পি ডিউটি, বিশেষ অভিযান, আরো কত ডিউটি। অনেক সময় সিরাজ সাহেবের মনে হয় এটা একটা জীবন না, যেন যন্ত্র। শুধু ছুটে চলা তারওপর কত জবাবদিহিতা। ব্যস্ততারকারণে চাকরি জীবনে সিরাজ সাহেব বেশিরভাগ দিনই বাসার বাইরে ভাত খান। আবার কখনো সুযোগ পেলেই বাসায় ছুটে আসেন।
দুপুরে সিরাজ সাহেব যখন বাসায় এলেন সুলতানা তখন নামাজ পড়ছিলেন। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে বুয়া দরজা খুলে দিল।
সিরাজ সাহেব সোজা বেড রুমে চলে গেলেন, বুয়া তোমার খালা কী করছে?
নামাজ পড়ছে খালুজান।
কয়েকমিনিট পর সুলতানা নামাজ শেষ করে তাসবিহ জপ করতে করতে বেড রুমে ঢুকলেন।
সিরাজ সাহেব সুলতানার হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে বললেন, সুলতানা এই ব্যাগটা রাখ।
সুলতানা ব্যাগটা খুলে টাকার বান্ডিল দেখে বললেন, কত আছে?
তিন লাখ।
সুলতানা তাঁর হাত থেকে তাসবিহটা টেবিলের ওপর রেখে টাকার ব্যাগটা স্টিল আলমিরায় রেখে বললেন, তুমি কিন্তু আর আমাকে না কর না।
কী না করব না।
আমার গাড়ি কেনাটা, তুমি আজ তাড়াতাড়ি বাসায় এসো একসঙ্গে গাড়ি কিনতে যাব।
সিরাজ সাহেব রাগান্বতিস্বরেবললেন, আমি তোমার গাড়ি কেনার সঙ্গে একমত না, তুমি যদি একান্তই গাড়ি কিনতে চাও তবে তুমি একাই যেও এবং তোমার নামে কিনো, আমি তোমার সাথে-পিছে নাই।
সুলতানার চোখে-মুখে যেন আলোর আভা ফুটে উঠল, তুমি যখন বলছ তবে তাই হবে, এখন আসো ভাত খাবে।
চলবে...
আমার এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:দুর্নীতিবাজের ডায়েরি-০১
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ক্লিক করুন:আমার ঠিকানা