আকাশ আর বৃষ্টি নীলাকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী রোডের একটা এ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। নীলা মাথা উঁচু করে তাকাল বেশ উঁচু একটা এ্যাপার্টমেন্ট।
লিফ্ট উঠে গেল পঞ্চম তলায় সবাই নেমে আকাশ কলিং বেল-এ টিপ দিল।
বুয়া দরজা খুলে দিল।
বৃষ্টি নীলাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকল আর আকাশ ভিতরে চলে গেল। নীলা একবার ড্রয়িং রুমটা এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখল। অত্যাধুনিক সাজে সজ্জিত, একটা বেশ বড় আকারের এ্যাকুরিয়ামে অনেকগুলো বিভিন্ন রংয়ের মাছ খেলা করছে, দেয়ালে টাঙ্গানো পোস্টার, কোণায় একটা সুন্দর আকৃতির কর্ণারবিভিন্নরকমের শোপিসে ভর্তি, সিলিং থেকে ঝুলানো একটা ঝাড়বাতিতে যেন আলো খেলা করছে। নীলা এর আগে কখনো এমন অত্যাধুনিক ড্রয়িং রুম দেখেনি। সে মনে মনে কী যেন ভাবছিল। এমন সময় সুলতানা ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন।
নীলা সালাম দিল, আস্সালামুয়ালায়কুম মামী।
সুলতানা সালামের জবাব দিয়ে বললেন, কেমন আছ মা?
জি মামী ভালো, আপনি?
ভালো, আচ্ছা মা তুমি বল তো তোমার বাবার নাম কি?
নীলা তার বাবার নাম বলল।
তুমি কি জানো তোমার বাবা রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছে কি না?
জি মামী বাবা রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছে।
আমি তোমার বাবাকে চিনেছি, আমরা একসঙ্গে পড়তাম। কেন জানি তোমাকে দেখে আমার পরিচিত মনে হয়েছে, তুমি ঠিক তোমার বাবার মতো হয়েছ।
নীলা কোন কথা বলল না।
তোমার বাবা এখন কি করে?
ব্যাংকে চাকরি করে।
কথা হয়েছে দু'য়েকদিনে?
জি, কাল রাতেই কথা হয়েছে।
তুমি একটু বস মা, আমি তোমার মামাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলি, বলে সুলতানা মোবাইল করলেন, এই তোমার কি আসতে দেরি হবে?
হ্যাঁ।
কতক্ষণ?
আধ ঘন্টা।
সুলতানা মোবাইল রেখে দিলেন।
বৃষ্টি এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এবার বলল, মামী নীলা কিন্তু খুব ভালো ছবি আঁকে।
কই আগে বলিস্নি তো।
মামী নীলা তো আকাশের একটা ছবি এঁকে দিয়েছে, আকাশ বলেনি?
না তো, তুইও তো বলিস্নি।
তুমি বস, আমি নিয়ে আসছি, বলে বৃষ্টি চলে গেল এবং পাশের রুম থেকে আকাশের ছবিটা নিয়ে এসে সুলতানার হাতে দিল।
সুলতানা ছবিটার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বাঃ একেবারে জীবন্ত ছবি, তুমি তো খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পার মা।
নীলা কিছুটা লজ্জা পেল। সে মাথা নত করে বসে রইল।
সুলতানা আবার বলতে শুরু করলেন, পারবে না, ট্যালেন্ট মেয়ে। আমি দেখেই বুঝেছি, কথায় বলে না যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।
আকাশ বলল, মা তুমি নীলাকে দেখে আর কী কী বুঝলে?
দেখ্ আকাশ খোঁটা দিয়ে কথা বল্বি না। সবাই তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন টেস্ট দিয়েছিলি তোরা দু’জনে চান্স পাস্নি আর নীলা চান্স পেয়েছে। আবার ভালো ছবিও আঁকে। তোরা দু’জনে কী পারিস্ বল?
আকাশ এবং বৃষ্টি দু’জনে মাথা নত করে বসে রইল।
সুলতানা আবার বলতে শুরু করলেন, যেমন বাপ তেমন মেয়ে। তোমার বাবা খুব ট্যালেন্ট স্টুডেন্ট ছিল। আমরা একসঙ্গে পড়তাম, কিন্তু ও যেন ছিল আমাদের শিক্ষকের মতো। আজ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি তোমার বাবার যোগ্য মেয়ে হয়েছ।
নীলা কিছু বলল না, মাথা নত করে বসে রইল।
তোমরা বস মা আমি তোমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করি, বলে সুলতানা চলে যাচ্ছিলেন।
নীলা বাধা দিয়ে বলল, এখন কিছু খাব না মামী, একেবারে ভাত খাব।
তাহলে দেখি তোমার মামা আসছে কি না? বলে সুলতানা আবার মোবাইল করলেন, এই তুমি আসছ?
হ্যাঁ আমি লিফ্টের কাছে।
তোমরা বস মা আমি খাবার রেডি করি।
সুলতানা চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশের বাবা বাসায় ঢুকলেন। সুলতানা ডাইনিং রুম থেকে ডাক দিলেন, মা বৃষ্টি তোরা সবাই খেতে আয়।
নীলা ডাইনিং এ ঢুকেই এক পুলিশ অফিসারকে দেখতে পেল। নীলা তাঁর বুকে লাগানো নেম প্লেটে দেখল নাম লিখা আছে সিরাজ।
সুলতানা পরিচয় করে দিলেন, ও হলো নীলা যার কথা তোমাকে বলেছিলাম, নীলা তোমার মামা।
নীলা সালাম দিল।
সিরাজ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললেন, কেমন আছ তুমি?
জি মামা ভালো, আপনি?
ভালো, সুলতানা খেতে দাও খেতে খেতে গল্প করা যাবে।
সিরাজ সাহেব হাত ধুয়ে খেতে বসেছেন।
এমন সময় ওয়্যারলেস্ সেট বেজে উঠল।
জি স্যার আমি এক্ষুনি আসছি, কই সুলতানা তুমি মেহমানকে আপ্যায়ন কর আমি আসছি, বলে সিরাজ সাহেব চলে গেলেন।
নীলা অবাক হয়ে বলল, মামী, মামা চলে গেল!
সুলতানা খুব স্বাভাবিকভাবেবললেন, এটা নতুন কিছু না, আমার বিয়ের পর থেকেই দেখছি। তোমার মামা পুলিশের চাকরি করে সবসময় ব্যস্ততা, কাজ আর কাজ, দিন নেই রাত নেই শুধু ডিউটি আর ডিউটি। তোমরা খাও মা, তোমারমামা কখন ফিরে আসবে ঠিক নেই।
তাই বলে খাবার টেবিল থেকে উঠে যেতে হবে!
তোমার মামা বলে এটাই তো পুলিশের চাকরি। তারপরও পুলিশের দুর্নামের শেষ নেই। আমার আজও মনে আছে আকাশের প্রথম জন্মদিনটা পালনের জন্য অনেক অতিথিকে দাওয়াত করেছিলাম, অনেক আয়োজন করেছিলাম। তোমার মামা সেদিন ছুটির জন্য এপ্লিকেশন করেছিল কিন্তু ছুটি পায়নি। তারপরও অনেক ব্যস্ততার মাঝে সবকিছু আয়োজন করেছিল। দুপুরে ভাত খেয়ে যাবার সময় বলে গেল সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চলে আসবে। মেহমানরা এলো কিন্তু তোমার মামা এলো না। আমি একাই আকাশের জন্মদিন পালন করলাম। সেদিন রাতে আমি খুব কেঁদেছিলাম, আমার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। রাত বারোটার সময় খবর এসেছিল তোমার মামা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে।
হাসপাতালে মানে? নীলা অবাক বিস্ময়ের সাথে বলল।
হাসপাতালে মানে কোথায় যেন আসামি ধরতে গেছিল, আসামিরা ছিল খুবই দুর্ধর্ষ। তারা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশ ভ্যান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, আসামিরা পালিয়ে যেতে পারেনি ঠিকই কিন্তু তোমার মামার বাম হাতে একটা গুলি লেগেছিল। তারপর থেকে তোমার মামার বাসায় যাওয়া আসা আর জীবনের ঝুঁকিটাকে আমি খুব স্বাভাবিকভাবেনিয়েছি। ধরেই নিয়েছি পুলিশের বউ হলে এটা মেনে নিতেই হবে।
মামী, মামা বোধ হয় খুব সিনসিয়ার পুলিশ অফিসার?
সে তো বটেই। ও চাকরিতে খুব সিনসিয়ার। একজন ভালো পুলিশ অফিসার হিসাবে ডিপার্টমেন্টে ওর সুনাম আছে। তাই আমিও চাই আমি একটু সেক্রিফাইজ করলে যদি ও আরো বেশি সার্ভিস দিতে পারে তবে অসুবিধা কি? আমার না হয় একটু কষ্ট হবে। এই আর কি, যাক তোমার মামার কথা বলে আর কাজ নেই। বৃষ্টি এই ক’দিনে দেখেছে আর আকাশ তো পুলিশের চাকরির কথা শুনতেই পারে না।
আকাশ বলল, আমার কিন্তু সাংবাদিকতার চাকরিও পছন্দ না মা। জীবন তো যন্ত্র না যে দিন রাত শুধু কাজ আর কাজ নিয়ে কাটাতে হবে।
বৃষ্টি বলল, তোর পছন্দ কি না তার ওপর তো কারো প্রফেশন নির্ভর করে না।
হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। মা তুমি কিন্তু ভুক্তভোগী, তুমি নিশ্চয়ই চাও না তোমার ছেলে, ভাইঝি কিংবা তোমার ছেলের বউ তেমন ব্যস্ত আর ঝুঁকিপূর্ণ প্রফেশনে কাজ করুক?
সুলতানা নীলার প্লেটে মাংস বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, কেন মা তুমি কি সাংবাদিক হতে চাও না কি?
নীলা মৃদু হেসে বলল, জি মামী।
এখনকার মেয়েরাও তো সব প্রফেশনে কাজ করছে, অসুবিধা কি?
আকাশ বলল, মা তুমি কিন্তু যুক্তি নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছ।
সুলতানা কিছু বললেন না।
মোহনা হল-এ ফিরল হাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। নীলা তো একেবারে অবাক, কিরে ক’দিন থেকেই না শুনছি টাকা নাই। বাড়ীতে টাকার জন্য মোবাইল করলি, বাড়ী থেকে টাকা এসেছে নাকি?
না রে বাড়ী থেকে টাকা আসেনি, হৃদয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম না, ও একরকম জোর করে শপিং করতে নিয়ে গেল। তারপর মার্কেটে গিয়ে এটা-সেটা করে কিনতে কিনতে অনেক কেনাকাটা হয়ে গেল। আমি এত করে নিষেধ করলাম ও আমার কোন নিষেধ মানতেই নারাজ। একটা একটা করে থ্রি-পিস্ আমার গায়ে এলিয়ে ধরে বলল, এটা তোমাকে খুব সুন্দর মানাবে, সেটা তোমাকে সুন্দর মানাবে। তারপর শেষে একটা জামদানি শাড়ি আরো কত কস্মেটিকস্ কিনে দিল।
টাকা দেয়নি?
হ্যাঁ টাকাও দিয়েছে। তবে কৌশলে।
কি রকম?
আমাকে বলল, বন্যা তোমার ব্যাগটা দাও তো একটু দেখি।
আমি ব্যাগটা দিলাম।
তারপর ব্যাগের মধ্যে একটা খাম ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, তোমার মোবাইলে আমি একটা ম্যাসেজ পাঠাচ্ছি, তুমি চলে যাবার পর ম্যাসেজের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী কাজ করবে।
আমি বললাম, করব।
বলল না এভাবে বললে হবে না, তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, প্রোমিজ!
আমি প্রোমিজ করলাম।
নীলা কৌতুহলী হয়ে বলল, তারপর-
তারপর আমার মোবাইলে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়ে বলল, চল তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।
আমাকে টি.এস.সি’তে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
তুই ম্যাসেজটা ওপেন করিস্নি?
হ্যাঁ করেছি এবং সেভাবে কাজ করেছি।
কি করলি?
আমি হল-এর গেট-এ ঢুকলাম তারপর ম্যাসেজটা ওপেন করলাম, প্রথমে লিখা ছিল, Don’t Open It, When Any Body Follow You পড়ার পর আমি চারিদিকে একবার তাকালাম কেউ আমাকে ফলো করছে নাকি। দেখলাম কেউ নাই তারপর অনেকটা স্পেস দেয়া আছে এটা করেছে মনে হয় কৌতুহল বাড়িয়ে দেয়ার জন্য যেন পড়ার আগে একটু অন্যরকম লাগে। তারপর Don’t Open It, When Any Body Looking You আমি আবার চারিদিকে একবার তাকালাম কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে নাকি? দেখলাম কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না আরো কিছুটা এগিয়ে পড়লাম তারপর লিখা আছে Don’t Open It, When Any Body Dout You. আমি একবার মনে মনে ভেবে নিলাম কেউ আমার গতিবিধি সন্দেহ করছে নাকি? না আমাকে কেউ সন্দেহ করেছে বলে আমার মনে হয়নি।
তারপর-
তারপর লিখেছে Don’t Open It, When You Are Doing.
আমি তখন দাঁড়িয়ে গেলাম, ভাবছিলাম ম্যাসেজটা এ পর্যন্তই শেষ হবে।
আরো আছে নাকি?
হ্যাঁ অনেকটা স্পেস দিয়ে লিখেছে Don’t Open It, When You Are Boring.
আমি মোটেই বোর ফিল করছিলাম না। আমি আরো কিছুটা ওপেন করলাম।
তারপর লিখেছে Open It Now Or You Will Loss Something.
তারপর খুললি?
হ্যাঁ দেখলাম খামের ভিতর পাঁচ হাজার টাকা।
খুব ইন্টারেস্টিং মানুষ তো।
ইন্টারেস্টিং তো বটেই তবে-
তবে কি?
বয়সটা একটু বেশি।
বেশি কত?
মনে হয় ত্রিশ এক্সিড করেছে, তবে বয়স বোঝা যায় না।
তোর পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ-অপছন্দের কথা জিজ্ঞেস করছিস্ কেন? একদিনের দেখাতেই পছন্দ-অপছন্দের কথা বলা যায়?
বাঃ রে একজনের সঙ্গে মেলামেশা করবি, প্রেম করবি আর আমি তোকে পছন্দ-অপছন্দের কথা জিজ্ঞেস করতে পারব না?
আমি তো তোকে বলিনি আমি হৃদয়ের সঙ্গে প্রেম করছি বা আমি হৃদয়কে ভালবাসি।
তো।
হৃদয় আমার ফ্রেন্ড। একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি, এনজয় করছি ব্যাস, এর বেশি কিছু না। আমি হৃদয়ের সঙ্গে প্রেমও করছি না, বিয়েও করছি না। তবে এভাবে যদি দু’জনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে যায় তবে বাকী সব পরের বিষয়। আমি আপাতত ডিপলি কিছু ভাবছি না।
নীলা একটা তিরস্কারের হাসি হেসে বলল, তাই নাকি?
চলবে...
আমার এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:দুর্নীতিবাজের ডায়েরি-০১
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ক্লিক করুন:আমার ঠিকানা