আকাশ আগে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠত, কোনদিন তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয়নি। কিন্তু কয়েকদিন থেকে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হচ্ছে। তাছাড়া ইদানিং সে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করেছে। এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে তার বাবা সিরাজ সাহেব একদিন তার মা সুলতানাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার সুলতানা? আকাশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠছে? হঠাৎ করে আবার বাথরুম সিঙ্গার হয়ে গেল? ব্যাপার কি?
সুলতানা বললেন, কী জানি? বয়স হয়েছে তাই হয়ত এমন বদলে গেল আমার ছেলেটা। যাক্গে আমি দেখি ও ঘুম থেকে উঠল নাকি? বলে সুলতানা আকাশের রুমে ঢুকলেন।
আকাশ তখনো ঘুম থেকে উঠেনি, সুলতানা তার বিছানার কোণায় বসে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আকাশ ঘুমের মধ্যে আপন মনে হেসে উঠল।
সুলতানা আকাশের বাহুতে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকলেন, আকাশ, আকাশ।
আকাশ চম্কে উঠল, কে, মা?
কি রে হাসছিস্ কেন?
আকাশ বিছানায় উঠে বসল, দিলে তো সুন্দরস্বপ্নটা ভেঙ্গে?
এমন কি হলো যে হঠাৎ করে সুন্দরস্বপ্নদেখতে শুরু করলি?
এমনসময় সিরাজ সাহেব ডাক দিলেন, সুলতানা আমি গেলাম।
সুলতানা বাইরে গেলেন। সিরাজ সাহেবকে বিদায় দিয়ে সুলতানা আকাশ আর বৃষ্টির জন্য নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে ডাক দিলেন, আকাশ, বৃষ্টি নাস্তা রেডি খেতে আয়।
বৃষ্টি নাস্তা খেতে এলো, আকাশ টয়লেটে ঢুকল। যতক্ষণ টয়লেটে থাকল ততক্ষণ তার গানের সুর ভেসে এলো। কয়েকমিনিট পর টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে নাস্তার টেবিলে বসল।
সুলতানা স্নেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে হঠাৎ করে আবার বাথরুম সিঙ্গার হয়ে গেলি যে, ব্যাপারটা কি?
আকাশ বলল, মা আমি এখন বড় হয়েছি, আমি এখন দেরি করে ঘুম থেকে উঠব, বাথরুমে গান গাইব, কী কী করব সব কি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে?
বড় হয়েছিস্ না? বলে সুলতানা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা তো আগে খুব ঝগড়া করতিস্, একেবারে সরকারী দল আর বিরোধী দলের মতো, হঠাৎ করে আবার মিলে গেলি যে, দু’দল এক হয়ে গেলি নাকি? সরকারী দল আর বিরোধী দল এক হয়ে গেলে তো দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সেজন্য যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা প্রয়োজন, তুই বল্ তো মা কি হয়েছে?
বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে দুষ্টামির ভঙ্গীতে বলল, আকাশ ভাইয়া বলব?
সুলতানা শাসনের সুরে বললেন, এই বৃষ্টি তুই তো ওকে তুই বলে ডাকতিস্, এখন আবার ভাইয়া বলিস্ নাকি?
জি মামী, হাজার হলেও আকাশ ভাইয়া আমার চেয়ে ঊনত্রিশ দিনে বড় না? তাই আমি ওকে এখন ভাইয়া বলে ডাকি।
কবে থেকে?
তা প্রায় সাতদিন থেকে।
কেন সাতদিন আগে কি হয়েছে যে তুই ওকে খুব শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিস্?
বৃষ্টি কিছুটা ভাব নিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি কিছু মনে করো না, আমি কিন্তু আর মামীর কথার উত্তর না দিয়ে পারছি না। আর তুমি তো জানো আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না, আবার কোন কথা মনের মধ্যে চেপেও রাখতে পারি না। পেট ব্যথা করে।
সুলতানা অভয় দিয়ে বললেন, আমি বলছি তুই বল্ মা।
ভাইয়া বলব?
আকাশ কোন কথা না বলে নীরবে মাথা নত করে নাস্তা খেতে লাগল।
বল্ মা।
মামী আকাশ না একটা মেয়েকে পছন্দ করে।
একটা মেয়েকে পছন্দ করে সেজন্য এত পরিবর্তন? মেয়েটা কি খুব সুন্দরী? শিক্ষিত? ভদ্র? ভালো ফ্যামিলির মেয়ে?
জি ভালো।
কি ভালো? শুধু দেখতে সুন্দরী হলেই তো আর ভালো বলা যায় না।
মামী সব ভালো।
সুলতানা রেগে গেলেন, এভাবে কেটে কেটে কথা বলছিস্ কেন? বড়দের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে হয় না। সবকিছু স্পষ্ট করে বল্?
সরি মামী এবার সোজা করে বলছি। মেয়েটার নাম নীলা, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এবার জার্নালিজমে ভর্তি হয়েছে। বাড়ী ধামইরহাট।
মেয়ের বংশ বুনিয়াদ ভালো?
জি মামী। উঁচু বংশের মেয়ে, বনেদী পরিবার। মেয়েটা খুব ব্রিলিয়ান্ট, আমরা একসঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য এডমিশন টেস্ট দিয়েছিলাম, আমি আর এই গাধাটা চান্স পাইনি আর ও চান্স পেয়েছে।
আকাশ বলল, আমি গাধা তাই আমি চান্স পাইনি। আমি যদি চান্স না পেলে গাধা হই তাহলে তুই কী?
বৃষ্টি নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেল।
সুলতানা আদরের সুরে বললেন, তোরা আমাকে সবকিছু বল্বি তো। মেয়েটাকে তো একদিন বাসায় নিয়ে এলে পারতিস্।
আকাশ এবার মুখ তুলে বলল, মা তাহলে আজই বাসায় নিয়ে আসি?
সুলতানা ধমকের সুরে বললেন, তুই চুপ কর্। মাকে এখন পর্যন্ত চিন্লি না। খবরটা আমাকে বৃষ্টির কাছ থেকে জানতে হলো। তুই একদিন গিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আসিস্ মা।
বৃষ্টি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, ভাইয়া আমাদের জন্য কোন স্নেহ, ভালোবাসা, সম্মান বোধ হয় আর পাওনা নেই।
আকাশ চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, চল্।
বৃষ্টি তার রুমে যাচ্ছিল আকাশ ডাক দিল, বৃষ্টি আমার রুমে আয় তোর সাথে আমার কথা আছে।
বৃষ্টি আকাশের সঙ্গে তার রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল, কি বল্?
সিগনাল তো গ্রীণ, চল্ না আজ একবার নীলার সঙ্গে দেখা করে আসি?
আজই কথা হলো, আজ না, কাল যাব, ক্লাস শেষ করে চলে যাব।
আকাশ একটা নিঃশ্বাস মোচন করল।
বৃষ্টি বলল, কেন খুব দেখতে ইচ্ছে করছে?
আকাশ খুব সাদাসিধে এবং সরল হাসি হেসে মাথা বাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ।
আহ্ চুক্, চুক্।
পরদিন আকাশ আর বৃষ্টি ক্লাস শেষ করে টি.এস.সি’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছিল। এমনসময় পল্লব সামনে এসে দাঁড়াল, বৃষ্টি কোথাও যাচ্ছিস্?
হ্যাঁ।
পল্লব ফ্যাল্ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
বৃষ্টি একরকম ধমকের সুরে বলল, এভাবে তাকিয়ে আছিস্ কেন? তোকে না কতদিন বলেছি আমার দিকে এভাবে তাকাবি না। কেন কিছু বল্বি?
পল্লব কিছু বলল না, তবে তার চাহনি বলছে সে কিছু বলতে চায়।
বৃষ্টি তার মুখের ভাব দেখে বুঝল। সে বলল, আমরা টি.এস.সি'তে যাব। তুই আমাদের সঙ্গে যাবি?
পল্লব মাথা নেড়ে সায় দিল।
বৃষ্টি বলল, তাহলে চল্।
তিনজন একটা সি.এন.জি'তে চেপে টি.এস.সি’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
টি.এস.সি'তে পৌঁছে সি.এন.জি থেকে নেমে বৃষ্টি আকাশকে বলল, আকাশ তুই যা। আমরা সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে আছি। তোর কথা বলা শেষ হলে একটা মিস্ কল দিস্ আমি চলে আসব, বলে বৃষ্টি আর পল্লব সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানের দিকে রওয়ানা হচ্ছিল।
আকাশ ডাক দিল, বৃষ্টি এভাবে স্বার্থপরের মতো আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
স্বার্থপরের মতো কেন? তুই স্লিপ দিয়ে ওয়েটিং রুমে ওয়েট করবি, নীলা চলে আসবে।
বৃষ্টি তুই তো জানিস্, কারো জন্য একা ওয়েট করতে আমার খুব খারাপ লাগে। তাছাড়া মেয়েদের হল। আমি ছেলেমানুষ, তুই না থাকলে আমি খুব আন ইজি ফিল করব।
হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না। চল্, বলে সবাই হল-এর দিকে পা বাড়াল।
হল-এর গেটে স্লিপ দিয়ে ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ সবাই বসল। তারপর নীলা বেরিয়ে এসে এক টুকরা মিষ্টি হাসি হেসে বলল, সরি, বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত।
আর দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই। তোরা থাক্ গল্প কর্ আমরা আসছি।
নীলা কিছুটা বিস্ময়ের সুরে বলল, আমরা মানে? আর আবার কে? তোর সঙ্গে আর কেউ আছে নাকি?
পল্লব নিজের পরিচয় দিল, আমি পল্লব, বৃষ্টিসহ এক সঙ্গে পড়ি।
নীলা বলল, নাইস টু মিট ইউ।
নীলা তোরা গল্প কর আমরা আসছি, বলে বৃষ্টি আর পল্লব হাঁটতে হাঁটতে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানের দিকে গেল।
আকাশ নীলার আঁকা ছবিটা দেখে তো একেবারে অবাক, তুমি এতো সুন্দর ছবি আঁকতে পার? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি। আচ্ছা আমি জানতাম কোন আর্টিস্ট কারো ছবি আঁকলে তাকে সামনে বসিয়ে রাখে কিন্তু তুমি তো আমাকে শুধু একবার দেখেছ তাতেই আমার ছবি এঁকে ফেললে, স্ট্রেইঞ্জ।
ছবিটা কি প্রফেশনাল আর্টিস্টদের আঁকা ছবির মতো হয়েছে? নীলা জিজ্ঞেস করল।
না, তা হবে কেন? তারচেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। আসলে প্রফেশনাল আর্টিস্টরা তো ছবি আঁকে জীবিকার প্রয়োজনে, সেখানে হাতের সঙ্গে, দেহের সঙ্গে, মনের সম্পর্ক থাকে খুব সামান্য। আর তোমার আঁকা ছবি দেখে মনে হচ্ছে ছবি আঁকার সময় তোমার দেহের সঙ্গে মনের অদ্ভুত সমন্বয় ঘটেছিল। তা না হলে ছবিটা এত জীবন্ত হতো না।
আমাকে খুশি করার জন্য বলছ?
মোটেই না, আমি তোমাকে খুশি করার জন্য বলব কেন? ও নীলা তোমার জন্য একটা সুখবর আছে।
কী সুখবর?
মা তোমাকে দেখতে চেয়েছে।
কেন? আমাকে দেখতে চাইলেন কেন? তিনি তো আমাকে চিনেন না।
চিনে না কথায় কথায় জেনে ফেলেছে এবং তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। তুমি না হয় আজ আমাদের সঙ্গে চল।
আজ না আরেকদিন যাব।
সরু ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পল্লব এদিক সেদিক তাকাল। কিন্তু খুব একটা ফাঁকা জায়গা পেল না। নিরিবিলি একান্ত আপনজনকে মনের কথা বলার জন্য কপোত-কপোতীরা আজকাল এই উদ্যানকে বেছে নেয়। তাই সবসময় কপোত-কপোতীদের দখলে থাকে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যান। পল্লব একটা গাছের দিকে তাকিয়ে দেখল মোটামোটি ফাঁকা। কাছাকাছি আর কেউ নেই। সে বৃষ্টিকে হাত দেখিয়ে ইশারা করল। তারপর দু’জনে গাছের নীচে গিয়ে বসল।
বৃষ্টি জিজ্ঞেস করল, কি বল্বি? বল্।
পল্লব আম্তা আম্তা করে বলল, না মানে আমি বলছিলাম কি, মানে।
মানে মানে করছিস্ কেন? বলে ফেল্।
না মানে আজ তোকে খুব ফিল করছিলাম।
কেন হঠাৎ আমাকে ফিল করার কী হলো?
তুই হয়ত জানিস্ না আমি মনে মনে তোকে ভালোবেসে ফেলেছি।
শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলতে পারলি?
পল্লব বোকার মতো হেসে বলল, বৃষ্টি তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
এটা সবাই জানে, আকাশ যদি জানে তুই আমাকে ভালোবাসিসতবে কি করবে একবার ভেবেছিস্?
বৃষ্টির কথা শুনে পল্লবের মুখ শুকিয়ে গেল, কেন আমি তোকে ভালোবাসি একথা আকাশ জানলে রেগে যাবে কেন? আকাশ কি তোর সঙ্গে প্রেম করে নাকি?
বৃষ্টি একটা হাসি হেসে বলল, ছিঃ আমি আকাশের সঙ্গে প্রেম করব কেন? আকাশ আমার কাজিন না?
এমনসময় বৃষ্টির মোবাইলে রিং বেজে উঠল।
বৃষ্টি মোবাইল বের করে দেখল, আকাশ মিস্ কল দিয়েছে।
বৃষ্টি বলল, পল্লব চল্ উঠি। আকাশ মিস্ কল দিয়েছে।
দু’জনে উঠে পড়ল।
চলবে....
এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:দুর্নীতিবাজের ডায়েরি-০১
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ক্লিক করুন:আমার ঠিকানা
আমার লেখা উপন্যাস গডফাদার পড়তে লাইক দিন:গডফাদার