গাযওয়া মুরাইসি ও বনু মুস্তালিক গোত্র:
বনু মুস্তালিক ছিল খুজায়া আযদিয়া ইয়ামানিয়া গ্রোত্রের একটি শাখা। মক্কার অন্যান্য গোত্রের মত রাসূল ﷺ তাদের নিকটেও ইসলামের দাওয়াত পৌছে দেন। ৩য় হিজরীর ওহুদ যুদ্ধের ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। ৩০০০ সৈন্যের শক্তিশালী কুরাইশ ও তার মিত্র বাহিনী মাত্র ৭০০ সৈন্যের ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। অসম এই যুদ্ধে তারা মুসলিমদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় ও রাসূল ﷺ কে মারাত্নকভাবে আহত, রক্তাক্ত করে। রাসূল (সাঃ) এর দাঁত ভেঙ্গে যায় ও শিরস্ত্রাণের কিছু অংশ তার মাথায় গেঁথে যায়, বহু সাহাবী আহত হন। এই যুদ্ধে কুরাইশদের বড় শক্তি ছিল বনু মুস্তালিক গোত্র। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং বিভিন্ন দলকে একত্রিত করে।যুদ্ধে তারা দূর্বল মুসলিমদের সাথে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করে। ব্যাপক প্রাণনাশ ও ক্ষয় ক্ষতি নিয়ে মুসলিমগণ মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ক্ষতের দাগ না শুকাতেই ৫ম হিজরীতে রাসূল ﷺ সংবাদ পেলেন, বনু মুস্তলিক সর্দার হারিস ইবনে আবূ দারার অস্ত্রশস্ত্র ও লোকবল ও পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহকে একত্রিত করে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। উদ্বিগ্ন হয়ে ঘটনার সত্যতা যাঁচাইয়ের জন্য রাসূল ﷺ একজন সাহাবীকে গুপ্তচর হিসাবে পাঠান। গুপ্তচর ঘটনার সত্যতা নিয়ে ফেরত আসেন এবং জানান তারা মদিনা আক্রমণের ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অতীতের ওহুদ যুদ্ধের দুঃখস্মৃতি ও অভিজ্ঞতা বলে, ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী নিয়ে তাদেরকে মদিনায় ঢুকতে বাঁধা দেয়া ও সম্মুখযুদ্ধের ফলাফল হতে পারে আরেকটি ওহুদ যুদ্ধের পরিণাম। এই ভুলের ক্ষমা নেই কারণ তারা মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে মাটি চাঁপা দিতে পারলেই মদিনায় প্রবেশ করবে এবং অসহায় নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধকে নির্বিচারে হত্যা করবে, লুন্ঠন করবে ও জীবিতদের দাস দাসী বানিয়ে নিয়ে যাবে। তাই রাসূল ﷺ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ঠিক করলেন বনু মুস্তালিক গোত্রের উপর গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করবেন। ৫ম হিজরীর শাবান মাসের কোন এক সোমবারে ৭০০ পতাতিক ও ৩০ জন অশ্বারোহীর একটি ছোট বাহিনীকে নিয়ে তিনি রওনা দিলেন বনু মুস্তালিক পানে। গোপনে মুসলিম সেনাবাহিনী সুবিধাজনক জায়গায় তাদের অবস্হান গ্রহণ করে এবং বনু মুস্তালিক গোত্রের উপর অতর্কিত গেলিরা আক্রমণ চালায় যখন তাদের পশুগুলি পানি পান করছিল। হটাৎ এমন অভিনব আক্রমণে বনু মুস্তালিক দিশেহারা হয়ে যায়। অস্ত্র হাতে তাদের যোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ হানতে এগিয়ে আসে এবং যুদ্ধে দশজন নিহত হয়। কাজেই এই দশজন মোটেও সিভিলিয়ান ছিলনা, তারা ছিল যোদ্ধা। মুসলিমগণ তাদের ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন এবং তাদের নারী-পুরুষদের বন্দী করেন। বন্দী, নিহতের সংখ্যা, গণীমত ইত্যাদি ব্যাপারে ইবনে ইসহাক ব্যতীত অন্যদের যেসব বর্ণনা রয়েছে, তার প্রায় অধিকাংশই ভুল বর্ণনা। তার মতে, যুদ্ধের পর বনু মুস্তালিকের ১০০ জন লোককে মুক্তি দেয়া হয় যারা যুদ্ধে বন্দী হয়েছিলেন। ৫ম হিজরীর ২৯ রমজান মুসলিমগণ মদিনায় ফেরত আসেন।
জুওয়ায়রিয়া বিনতে হারিস (রাঃ):
এই যুদ্ধে মুসলিমদের হাতে বনু মুস্তালিকের যেসকল নর-নারী বন্দী হন, তাদের মাঝে জুওয়ায়রিয়া বিনতে হারিস (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। জুওয়ায়রিয়া বিনতে হারিস (রাঃ) ছিলেন বনু মুস্তালিক গোত্রের সর্দার হারিস ইবনে আবূ দারার এর কণ্যা। মুসাফী ইবনে সাফওয়ান ছিল তার পূর্ব স্বামী যে বনু মুস্তালিকের পক্ষে যুদ্ধরত অবস্হায় নিহত হয়। এ যুদ্ধে জুওয়ায়রিয়া (রাঃ) বন্দি হয়ে সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে সাম্মাত আনসারী (রাঃ) এর দাসীতে পরিণত হন।
ইসলামী আইন যুদ্ধবন্দী নর-নারীকে মুকাতাবা চুক্তির অপশন দেয়। যুদ্ধে বন্দী হবার পর তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয় মুকাতাবা চুক্তি অনুযায়ী সে তার অধিকার অর্জনকারী মালিকের সাথে আলাপ আলোচনা করে উভয়ে সম্মত একটি মুক্তিমূল্য নির্ধারণ করবে এবং দাস/দাসী সেই মুক্তিমূল্য ধীরে ধীরে বা একসাথে পরিশোধ করে নিজেকে মুক্ত করে নিবে।
জুওয়ায়রিয়া বিনতে হারিস (রাঃ) সাবিত (রাঃ) এর সাথে নয় উকিয়া স্বর্ণের বিনিময়ে দাসীত্ব থেকে মুক্তির চুক্তি করেন এবং তিনি স্বীয় মুক্তিপণের ব্যাপারে সাহায্য লাভের আশায় স্বয়ং রাসূল (স) এর নিকট উপস্হিত হন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ ! আমি মুস্তালিক অধিপতি হারিসের কণ্যা জুওয়ায়রিয়া। আমি বিপদে পরেছি, যা দুর করা আপনার জন্য কঠিন নয়। আপনি আমাকে আমার মুক্তিমূল্য পরিশোধে সাহায্য করুন। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, হে জুওয়ায়রিয়া! এটা কি উত্তম নয় যে, আমি আপনার মুক্তিমূল্য পরিশোধ করে দেই এবং আমি আপনাকে বিয়ে করি? জুওয়ায়রিয়া (রাঃ) জবাবে বললেন, হ্যা! এটাই উত্তম।রাসূল ﷺ সাবিত (রাঃ) এর নয় উকিয়া স্বর্ণ পরিশোধ করে দিলেন এবং উম্মুল মুমিনীন হিসেবে নিজ গৃহে জুওয়ায়রিয়া (রাঃ) কে জায়গা দিলেন। যখন এই খবর মুসলিমদের কাছে পৌছালো যে রাসূল (সাঃ) জুওয়ায়রিয়া (রাঃ) কে বিবাহ করেছেন, তখন মুসলিমরা অনুশোচনা করে বলতে লাগল, এরা তো এখন আমাদের আত্নীয়, এরা রাসূলের শ্বশুরপক্ষের লোক, এদের কিভাবে আটক রাখা যায়? তারা বিনাশর্তে সকলকে মুক্তি দেন এবং তাদের ফীরে যাবার বন্দোবস্ত করে দিলেন। মুক্তিপ্রাপ্ত লোকজন যখন বনু মুস্তালিক গোত্রে ফীরে গেল তখন তারা গোত্রপতি হারিস ও অন্যান্য মানুষজনের কাছে জুওয়ায়রিয়া (রাঃ) এর সাথে রাসূল ﷺ এর বিবাহ এবং তাদের প্রতি মুসলিমদের মহানুভবতার কথা বলতে লাগলেন।এমন দৃষ্টান্ত আরবে ছিল অবিশ্বাস্য ও বিরল। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পরে গোটা গোত্রের মাঝে। গোত্রপতি হারিস সহ গোটা গোত্রটিই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে যায়। ফলে কুরাইশরা হারায় তাদের একটি বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু গোত্র এবং মুসলিমরা পায় নতুন একটি ভ্রাতৃপ্রতিম গোত্র। এটাই ছিল প্রকৃত ইতিহাস যাকে হাজার মিথ্যাচার দিয়ে মাটিচাঁপা দেয়া যায়না।
চলবে______________________( ইনশাআল্লাহ)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:৩৪