আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৫২
পশ্চিমবঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক অনুসন্ধানঃ
রাঢ় অঞ্চল
বর্ধমান জেলার এগারো মাইল ও মেদিনীপুর জেলার তারাফেনী রিজার্ভয়ার ব্রীজ-এ প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম কাঠের তৈরি প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত নিন্মপুরোপলীয় প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে হাতকুঠার, ক্লীভার, নোড়া, বিভিন্ন প্রকার -স্ক্রেপার, রিটাচড্ বেড, ফ্লেক, কোর ইত্যাদি। নিন্ম পুরোপলীয় শিল্পের ভূতাত্ত্বিক স্তরায়নের অবস্থান হচ্ছে নিন্ম গ্র্যাভেল বেডে অথবা সেকেন্ডারি ল্যাটেরাইট/ ডেট্রিটাল ল্যাটেরাইট কঙ্গলোমারেটে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতড়বস্থলগুলির মধ্যে আছে এগারো মাইল (বর্ধমান), পরীহাটি, মোহনপুর, সাতবটী, তারাফেনী রিজার্ভয়ার ব্রীজ (মেদিনীপুর), নাকবিন্ধী, পতিনা, জিবধারীপুর (বীরভূম), জগন্নাথপুর, গাঙ্গানীর মঠ প্রভৃতি। বাকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম মধ্যপুরোপলীয় যুগের মোট ৪১টি প্রত্নস্থলের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে পশ্চিমবঙ্গে। এদের মধ্যে ১৯টির অবস্থান বাঁকুড়ায়, ১৩টির মোদিনীপুরে এবং বীরভূম ও বর্ধমান জেলায় চারটি করে। প্রতড়ববস্তুর মধ্যে রয়েছে স্ক্রেপার,পয়েন্ট এবং বোরার ইত্যাদি। অধিকাংশই মূলত কোয়ার্টজ বা কোয়ার্টজাইট তৈরি। গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলগুলির মধ্যে আছে কানাপাহাড়, দাভা (পুরুলিয়া), বাঁকুড়া জেলার ধানকুড়া এবং মেদিনীপুর জেলার পরীহাটি, মোহনপুর, সাতবটি ইত্যাদি। আপার বা উচ্চপুরোপলীয় যুগের ১০টি প্রত্নস্থলের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে পশ্চিমবঙ্গে। এদের মধ্যে পাঁচটি মেদিনীপুর, চারটি বাঁকুড়া এবং একটি বর্ধমান জেলায়। পশ্চিমবঙ্গে প্রাপ্ত উচ্চ ট্যাঙ্গড পয়েন্ট, ব্যাকড বেড, বিউরিন, স্পিয়ার হেড ইত্যাদি এবং এগুলি সবুজ কোয়াটজাইট, চার্ট, কোয়টেজ, বেলে পাথর ইত্যাদি দ্বারা তৈরি বলে প্রমাণিত; মোদিনীপুরে, ৩৬টি বীরভূমে এবং মুর্শিদাবাদ ও চব্বিশ পরগনা জেলায় একটি করে। এ যাবত প্রাপ্ত প্রতড়ববস্তুর মধ্যে আছে লূনেট, পয়েন্ট, রোবার, স্ক্যাপার, বিউরিন কোর ইত্যাদি যা মূলত চার্ট, ক্যালসেডোনি, কোয়ার্টজ, কোয়ার্টজাইট, প্রস্তুরীভূত জীবাশ্মকাঠ ইত্যাদিতে প্রস্তুরীতকৃত। পুরোপুরিভাবে এ অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক স্তরবিন্যাস ও প্রতড়বতাত্ত্বিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায়নি বলে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলির কাল নিরূপণ করা এখনও সম্ভব হয়নি।
প্রান্তিক মালভূমি এলাকা মোট ৮৪ নবোপলীয় প্রত্নস্থল রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এদের প্রকৃতি ও বিন্যাস পর্যবেক্ষণে বিপরীত ধারার দু’ধরনের নবোপলীয় সংস্কৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এরা হলো, হিমালয় পাহাড়শ্রেণী এলাকা (কালিম্পঙ ও তসংলগ্ন সিকিম) এবং প্রান্তিক মালভূমি বা প্লেট্যু ফ্রিঞ্জ এলাকা (মদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান ও বীরভূম জেলা সংলগ্ন) প্লেট্যু ফ্রিঞ্জএলাকায় নবোপলীয় প্রত্নস্থলগুলির অবস্থান নদীতীরবর্তী অঞ্চলে, অথচ হিমালয় পাহাড়শ্রেণীতে এদের পাওয়া যায় পাহাড়ঢালে। প্লেট্যু ফ্রিঞ্জ এলাকায় প্রাপ্ত নবোপলীয় হাতিয়ারের সাথে সুস্পষ্টভাবেই ভিন্ন সিরামিক শিল্পের (ধুসর ও ঈষৎ লাল মৃৎপাত্র, যাতে কখনও কখনও কর্ড ছাপ দেখা যায়) পরিচয় দৃশ্যমান, অথচ হিমালয় নবোপলীয় সংস্কৃতিতে কোনো সিরামিকস পাওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের ওয়েস্টার্ন প্লেইনে যে নবোপলীয় সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়, তার সাথে পরবর্তী ক্যালকোলিথিক সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান। প্লেট্যু ফ্রিঞ্জ এলাকায় প্রাপ্ত নবোপলীয় প্রত্নবস্থলগুলির নামকরণ করা হয়েছে সংলগ্ন নদীর উপর ভিত্তি করে, যেমন সুবর্ণরেখা কমপ্লেক্স (২৩টি অবস্থান: ভেদুআহরি, পাণ্ডাপাতা, তিলকামতি, ঘোড়াপিঞ্চা, কালাইয়াশাল প্রভৃতি), কসাই কমপ্লেক্স (২২টি অবস্থান, অর্গাদা, পলাশডাঙা, লালজল, কাত্তারা, ১ এবং ২, লালঘর ইত্যাদি) এবং গন্ধেশ্বরী কমপ্লেক্স (১৪টি অবস্থান, বনশূরিয়া, শিমুলবাড়িয়া, পরেশনাথ প্রভৃতি); সুবর্ণরেখা কমপ্লেক্সে প্রাপ্ত হাতিয়ারের মধ্যে রয়েছে সেল্ট, বাটালি, স্প্লেইড কুঠার, সোল্ডারড কুঠার, ছেনি ইত্যাদি। কসাই কমপ্লেক্স মূলত বিভিন্ন রকম সেল্টস পাওয়া গেছে। এছাড়া রয়েছে বিবিধ রিং স্টোন, বাটালি প্রভৃতি। গন্ধেশ্বরী কমপ্লেক্স রাউন্ডেড বাট সেল্ট এর প্রাচুর্য দেখা যায়, কিন্তু সোল্ডারড কুঠার একটিও পাওয়া যায় নি। এতদঞ্চলে বর্ধমানের ভারতপুর ও পাণ্ডু রাজার ঢিবি, বাঁকুড়ার দিহার ও মেদিনীপুরের তমলুকে নবোপলীয় বস্তুসমূহ ক্যালকোলিথিক বস্তুর সাথে বেইস লেভেল-এ অথবা পৃষ্ঠে বিদ্যমান, যা এ অঞ্চলে একটি ভিন্ন নিও-ক্যালকোলিথিক পর্যায়ের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়।
পাণ্ডু রাজার ঢিবিঃ
পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে উৎখননের ফলে চারটি ভিন্ন ভিন্ন যুগের সাংস্কৃতিক বস্তুসমূহ উন্মোচিত হয়। প্রথম দুটি যুগ নিও-ক্যালকোলিথিক সংস্কৃতির আওতাভূক্ত, তৃতীয় যুগটি লৌহযুগের সংস্কৃতির অন্তর্গত এবং চতুর্থযুগটি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সংস্কৃতির সমন্বয়। ১৯৭৫ সালে তমলুক উৎখননে অবমুক্ত পোড়া কয়লা ডিপোজিটে পাওয়া ক্যালকোলিথিক বস্তুসমুহ, যেমন বিশিষ্ট আকারের কালো এবং লাল মৃৎপাত্র, ক্ষুদ্রাকৃতি নবোপলীয় সেল্ট এবং বিভিন্ন হাড়ের তৈরি হাতিয়ার। ক্যালকোলিথিক সংস্কৃতির যুগের পর নবোপলীয় হাতিয়ারসহ লৌহব্যবহারকারী প্রাচীন মানব সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়। এ সংস্কৃতিতে কালো এবং লাল মৃৎপাত্রের ব্যবহার অব্যাহত থাকে। এ স্তরের উপরের দিকের স্তর থেকে ব্লাক পিপ্ড মৃৎপাত্রসহ নর্দার ব্লাক পলিস্ড মৃৎপাত্র (NBPW) উদ্ধার করা হয়।
বাংলাদেশে মানব বসতির দ্বিতীয় পর্যায় দ্বিতীয় পর্যায়ে এই অঞ্চলে কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রাকৃতিক চিত্র, এর নদীপ্রণালী বসতির ক্রমবিকাশ ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কৃষিকাজের জন্য উর্বর উপত্যকাসমূহ বরাবর মানব বসতির প্রধান গুচ্ছসমূহ বিদ্যমান ছিল। প্রাচীন যুগে গাঙ্গেয় সমতলভূমির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদী উপত্যকাগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা বসতির নিদর্শন রয়েছে। ১২৯ নদীর উঁচু পাড় বা প্রাকৃতিক বাঁধ (Natural level) বরাবর নদী উপত্যকাগুলোতে প্রতিনিয়ত মৃত্তিকার নবায়নের ফলে এসকল এলাকা কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে উর্বর হওয়ায় মানব বসতি নদীর প্রাকৃতিক বাঁধ বা উঁচু পাড়কে অনুসরণ করেছিল। তদুপরি, অতীতে নদীগুলো ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। গঙ্গা বা গণ্ডারিক ও তাম্রলিপ্তির মতো কতগুলো বিখ্যাত বাণিজ্যিক বন্দর নগরীর অবস্থান ছিল যথাক্রমে গঙ্গা বা ভাগীরথীর তীরে। নদীর গতিপথের হঠাৎ পরিবর্তন এবং নদীর শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে যাওয়ার ফলে বহু বসতি লয়প্রাপ্ত হয়েছে।
আগামী পর্বেঃ আদি মানুষের বিস্তার
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৫১