আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৩৫
গঙ্গার প্রাচীনতম প্রবাহঃ
পঞ্চদশ শতকের (বিপ্রদাসের) আগে ভাগীরথী আংশিক হলেও এই সরস্বতীর খাত দিয়েই সমুদ্রে প্রবাহিত হতো। আনুমানিক ১১৭৫ খ্রিষ্টাব্দে, কলিকাতার দক্ষিণে উলুবেড়িয়া-গঙ্গাসাগর খাতে ভাগীরথী প্রবাহিত হতো, এমন লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। পুরাণে, বিশেষত মৎস্য ও বায়ুপুরাণে উল্লিখিত আছে যে, তাম্রলিপ্ত দেশের ভিতর দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হতো; এবং সম্ভবত সমুদ্রসন্নিকট গঙ্গার তীরেই ছিল তাম্রলিপ্তির সুবৃহৎ বাণিজ্যকেন্দ্র। এ সম্বন্ধে মৎস্যপুরাণের উক্তিকে পৌরাণিক উক্তির প্রতিনিধি বলে ধরা যেতে পারে। হিমালয়-উৎসারিত পূর্ব-দক্ষিণবাহী সাতটি প্রবাহকে এই পুরাণে গঙ্গা বলা হয়েছে; এই সাতটির মধ্যবর্তী প্রবাহটির ভগীরথ নামকরণ প্রসঙ্গে ভাগীরথী-কর্তৃক গঙ্গা আনয়নের সুবিদিত কাহিনীটিই এখানে বিবৃত করা হয়েছে। এই পুরাণে সুস্পষ্ট উলেখ আছে, কুরু, ভরত, পঞ্চাল, কৌশিক ও মগধ দেশ পার হয়ে বৈন্ধ্যশৈলশ্রেণীগাত্রে (রাজমহল-সাঁওতালভূমি-ছোটনাগপুর-মানভূম-ধলভূম শৈলমূলে) প্রবাহিত হয়ে ব্রাহ্মোত্তর (উত্তর রাঢ়), বঙ্গ এবং তাম্রলিপ্ত (সুম্ম) দেশের ভিতর দিয়ে ভাগীরথী প্রবাহিত হতো। এটি প্রাচীন বাংলায় ভাগীরথীর প্রবাহপথের এক সংক্ষিপ্ত সুন্দর সুস্পষ্ট বিবরণ। উত্তর, দক্ষিণ বিহারের ভিতর দিয়ে রাজমহলের নিকট বাংলাদেশে প্রবেশ করে রাজমহল-সাঁওতালভূমি-ছোটনাগপুর-মানভূম-ধলভূমের শৈলভূমিরেখা ধরে অগভীর ঝিল ও নিন্মজলাভূমি সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই ভূমিরেখাই ভাগীরথীর সম্ভাব্য প্রাচীনতম খাত। যাই হোক, পুরাণ-বর্ণনা হতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, ভাগীরথীই ছিল গঙ্গার মূল প্রবাহ। এই প্রবাহ উত্তর-রাঢ় দেশের ভিতর দিয়ে দক্ষিণবাহী এবং তার পূর্বে বঙ্গ, পশ্চিমে তাম্রলিপ্ত, এই ইঙ্গিতও মৎস্যপুরাণে পাওয়া যাচ্ছে। ভগীরথ-কর্তৃক গঙ্গা আনয়নের গল্প রামায়ণেও আছে এবং সেখানেও গঙ্গা বলতে রাজমহল গঙ্গাসাগর প্রবাহকেই বুঝাচ্ছে। যুধিষ্ঠির গঙ্গাসাগর-সংগমে তীর্থস্নান করতে এসেছিলেন এবং সেখান হতে গিয়েছিলেন কলিঙ্গদেশে। রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহই যে যথার্থত ভাগীরথী এটিই রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের ইঙ্গিত এবং এই প্রবাহের সঙ্গেই সুদূর অতীতের সূর্যবংশীয় ভগীরথ রাজার স্মৃতি বিজড়িত। কোনো কোনো ঐতিহাসিক পদ্মা প্রবাহ অপেক্ষা ভাগীরথী প্রবাহকে অনেক প্রাচীন বলে মনে করেন। জাও ডি ব্যারোসের (১৫৫০) এবং ফান ডেন ব্রোকের নকশায় (১৬৬০) পুরাণোক্ত প্রাচীন প্রবাহপথের সঙ্গে মিল আছে বলে নীহাররঞ্জন রায় উলেখ করেছেন। এই দুই নকশার তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে, সপ্তদশ শতকে জাহানাবাদের নিকটে এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দামোদরের একটি প্রবাহ উত্তর-পূর্ববাহিনী হয়ে দক্ষিণে গঙ্গায় এবং আরএকটি প্রবাহ দক্ষিণবাহিনী হয়ে নারায়ণগড়ের নিকট রূপনারায়ণ-পত্রঘাটার সঙ্গে মিলিত হয়ে তম্বোলি বা তমলুকের পাশ দিয়ে গিয়ে সমুদ্রে পড়ছে। আর মধ্য ভূখণ্ডে ত্রিবেণী-সপ্তগ্রামের নিকট হতে আর একটি প্রবাহ (অর্থাৎ সরস্বতী) ভাগীরথী হতে পৃক হয়ে পশ্চিম দিকে দক্ষিণবাহিনী হয়ে কলিকাতা-বেতড়ের দক্ষিণে পূনর্বার ভাগীরথীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
সরস্বতীঃ
এক শতাব্দী আগে, ষোড়শ শতকের জাও ডি ব্যারোসের নকশায় দেখা যায়, সরস্বতীর একেবারে ভিনড়বতর প্রবাহপথ। সপ্তগ্রামের নিকটেই সরস্বতীর উৎপত্তি, কিন্তু সপ্তগ্রাম হতে সরস্বতী সোজা পশ্চিমবাহিনী হয়ে যুক্ত হচ্ছে দামোদর-প্রবাহের সঙ্গে, বাঁকা দামোদর সংগমের নিকটেই। এই বাঁকা দামোদরের কথা বলেছেন সপ্তদশ শতকের (১৬৪০) কবি ক্ষেমানন্দ তাঁর মনসামঙ্গল কাব্যে। দামোদর বর্ধমানের দক্ষিণে দক্ষিণবাহী হয়ে আবার সরস্বতীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত হওয়ার ইঙ্গিত জাও ডি ব্যারোসের নকশাতেও আছে। এই প্রবাহপথই গঙ্গা-ভাগীরথীর প্রাচীনতর প্রবাহপথ এবং সরস্বতীর পথের নিন্মাংশ মাত্র। তাম্রলিপ্ত হতে এই নদীপথে বাণিজ্যপোতগুলি পাটলিপুত্র-বারাণসী পর্যন্ত যাতায়াত করত এবং এই নদীতেই পশ্চিমদিকে ছোটনাগপুর-মানভূমের পাহাড় হতে উৎসারিত হয়ে স্বতন্ত্র অজয়, দামোদর, রূপনারায়ণ প্রভৃতি নদ তাদের জলস্রোত ঢেলে দিত।
অজয়, দামোদর, রূপনারায়ণঃ
ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, রূপনারায়ণ, শিলাই, দ্বারকেশ্বর প্রভৃতি নদ-নদী ভাগীরথীতে জলধারা ঢেলে দিচ্ছে, কিন্তু এদের ভাগীরথী সংগমস্থান ভাগীরথীপ্রবাহপথের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পূর্বদিকে সরে এবং এদের বিশেষভাবে দামোদর এবং রূপনারায়ণের প্রবাহপথও নিমড়বপ্রবাহে ক্রমশ অধিকতর দক্ষিণবাহী হয়েছে। বর্ধমানের দক্ষিণে দামোদরের প্রবাহপথের পরিবর্তন খুব বেশি হয়েছে। ফান ডেন ব্রোকের নকশায় (১৬৬০) দেখা যায়, বর্ধমানের দক্ষিণ-পথে দামোদরের একটি শাখা সোজা উত্তর-পূর্ববাহী হয়ে আম্বোনা কালনার কাছে ভাগীরথীতে পড়ছে। ক্ষমানন্দ বা ক্ষেমানন্দ দাসের (কেতকাদাসের) মনসামঙ্গলে (১৬৪০ আনুমানিক) এই শাখাটিকেই বলা হয়েছে ‘বাঁকা দামোদর’; এই বাঁকা নদীর তীরে তীরে গোবিন্দপুর, গঙ্গাপুর, দেবপুর, নোয়াদা বা নর্মদাঘাট, কেজুয়া, আদমপুর, গোদাঘাট, কুকুরঘাটা, হাসনাহার্টি, নারিকেল ডাঙ্গা, বৈদ্যপুর ও গহরপুর; গহরপুরের পরেই বাঁকা দামোদর ‘গঙ্গার জলে মিলে গেল’ বলে উলেখ করা হয়েছে। দামোদরের দক্ষিণবাহী প্রবাহ পথেই এক সময় সরস্বতীর প্রবাহপথ ছিল, জাও ডি ব্যারোসের নকশার ইঙ্গিত তাই। পরে সরস্বতী এই পথ পরিত্যগ করে সোজা দক্ষিণবাহী হয়ে রূপনারায়ণ-পত্রঘাটার প্রবাহপথে কিছুদিন প্রবাহিত হতো। বস্তুত রূপনারায়ণের নিন্মপ্রবাহ একদা সরস্বতীরই প্রবাহপথ ছিল। যাই হোক, অষ্টম শতকের পরেই সরস্বতী ভাগীরথীর এই প্রাচীন প্রবাহপথের মুখ এবং নিন্মতম প্রবাহ শুকিয়ে যায় এবং তার ফলেই তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্য ক্ত হয়। অষ্টম হতে চতুর্দশ শতকের মধ্যে কোনো একসময় সরস্বতী তার প্রাচীন পথ পরিত্যাগ করে বর্তমানে খাত প্রবর্তন করে থাকবে এবং সেই খাতেও কিছুদিন ভাগীরথীর প্রবল স্রোত চলাচল করে থাকবে। বিপ্রদাসের চাঁদ সদাগর ত্রিবেণীর পরেই সরস্বতীতীরে সপ্তগ্রামের সুদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সপ্তগ্রাম সমৃদ্ধিশালী বন্দর-নগর, তার বর্ণনাই তা প্রমাণ করছে। কিন্তু সপ্তগ্রাম ছেড়ে চাঁদ সওদাগর সরস্বতীর পথে আর অগ্রসর হচ্ছেন না; তিনি বর্তমান ভাগীরথীর প্রবাহে ফিরে আসছেন; কারণ, সপ্তগ্রামের পরেই উল্লেখ পাচ্ছি কুমারহাট এবং হুগলির। মনে হয় ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দেই সরস্বতীর পথে বেশিদূর আর অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না এবং সেই পথে বৃহৎ বাণিজ্যতরী চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রেডইরক সাহেব বলেছেন, বাতোর বা বেতড়ের উত্তরে সরস্বতীর প্রবাহ অত্যন্ত অগভীর হয়ে পড়েছে, সেজন্য ছোট ছোট জাহাজও যাওয়া আসা করতে পারে না।
নিশ্চয়ই এই কারণে পর্তুগীজেরা ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে সপ্তগ্রামের পরিবর্তে হুগলিতেই তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।
৬৭ নীহাররঞ্জন রায়- বাঙালির ইতিহাস।
আগামী পর্বেঃ ঊদ্ভিদ, বন ও বন্য প্রানী।
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৩৪