জীবন মানে কি? জন্ম থেকে মৃত্যুর দিকে এক এক করে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। আর এইটুকু সময়ই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, নানা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। আমরা মহাকালের তিনটা সময়ের বলয়ে ঘোরপাক খাচ্ছি। অতীতের ফেলে আসা দিন গুলি আমাদের পিছু টানে, আবার অনাগত ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পরি। সৃষ্টি কর্তা যে আমাদের সুন্দর বর্তমান কাল উপহার দিয়েছেন, তা একটুও চিন্তা করে দেখি না। আমরা কেউ আপনজন বা প্রিয়জন হারাতে চাই না। আপনজন বা প্রিয়জন হারিয়েও মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। আমাদের পেটে ভুখ লাগে, আমরা প্রকৃতির ডাকে সারা দেই, জীবন চলে যায় জীবনের নিয়মে। অনেক সময় আমাদের অনেক দূঃচিন্তা আমাদের মনের চিলে কোঠায় বাসা বাঁধে। আমরা ভেবে অস্থির হই মা-বাবা হারালে ছেলে-মেয়েরা কি নিয়ে বাঁচবো, অথবা ছেলে-মেয়েরা চলে গেলে মা-বাবাদের অবলম্বনই বা কি রইল? আবার কেউ প্রিয়জনকে হারিয়ে বা খুব আপন মানুষের কাছ থেকে আঘাত পেয়ে হতাশার মধ্যে ডুবে যায়, বেছে নেয় অন্য পথ।
কিছু ঘটনা আছে যা আমাদের জীবনে প্রতিদিনই ঘটে। যেমন গতকাল রাত ৯ টার দিকে একটা ফোন পেলাম। একজন মা-কে বাঁচাতে ৫ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। নইলে বাঁচানো যাবে না রোগীকে। হয়তো এই রকম রোগীর মধ্যে কেউ না কেউ বেঁচে যায়, আবার কেউ না কেউ- না ফেরার দেশে চলে।
ছেলেটির বয়স কতবাই হবে, চার কি সারে চার। কতটুকুই তার স্মরণ শক্তি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রোদ মাখা সুন্দর দিনটা আস্তে আস্তে কালো আঁধারের অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। ছেলেটি হসপিটালের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম বিক্রেতার দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে আইসক্রিম খাবে। এই দিকে হসপিটালের আইসিউতে তা মা। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁকে বাঁচানোর জন্য। ছেলেটিকের মাথায় তখনো সেই দুঃচিন্তা নামক ঐ আবেগটি জড়ো হতে পারেনি, যে কিছু ক্ষণের মধ্যে সে একজন আপন মানুষ হারাতে যাচ্ছে। দূর হতে দূরসম্পর্কের এক ফুপি তা লক্ষ্য করলো, ছেলেটির প্রতি মায়া হলো, মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, আইসক্রিম খাবে তুমি? আইসক্রিমের গাড়ির দিকে দৌড়ে গেল। ছেলেটির মুখের হাঁসি, ফুঁপির চোখের কোনে জল জমে গেল।
সময়তো থেমে নেই, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো। মানুষের জীবনওতো এইরকম আলো নিভে গিয়ে আঁধারের পথে হাঁটা শুরু হয়। তারপর বাড়ির উঠোনে, অনেক মানুষের ভীড়, লাশের চারদিকে নিকট আত্মীয় স্বজনদের ভীড়, কান্নাকাটি। শুধু ছেলেটির চোখে তখনও কান্না নেই। হয়তো বিধাতা তার মায়ের মৃত্যুর পর যে আবেগ থাকার কথা সেই আবেগ মৃত্যুর সাথে তার আবেগগুলো কেড়ে নিয়েছে। সে শুধু দেখছে কাঠের একটি ছোট্ট খাট আর তার উপর সাদা কাপড়ে মোড়ানো একজন মানুষ শুয়ে আছেন।
এই ভাবে রাত শেষ হয়ে ভোর চলে আসে। এই বার লাশ দাফনের পালা। তখন বর্ষাকাল। নদী-নালা পেড়িয়ে বর্ষার পানি বাড়ির পাশের ডোবা, জমি, মাঠ-ঘাটও ডুবিয়ে দিয়েছে। পানি চারদিকে থৈ থৈ করছে। সেই বর্ষার মৌসুমে বাড়ি থেকে কবরস্থান যেতে নৌকার প্রয়োজন হতো। লাশটি নৌকায় উঠানো হলো। ছেলেটি তখনোও লাশের পাশে বসে আছে। নৌকাটি একটু একটু করে কবরস্থানের দিকে এগুচ্ছে। সবার মাথায় সাদা টুপি, সাদা পাঞ্জাবি। অনেকের চেহাড়ায় প্রকৃতির দেওয়া কোমলতা-মলীনতা ফুটে উঠেছে। সবার মুখে মুখে কালেমা শাহাদাত। আশরাফুল মাখলুকাতের চলে যাওয়া প্রকৃতিও তখন নিরবে নিভৃতে অবলকন করছে।
পরিশেষে পথে পরে থাকা পাথর সরানো, সৎ কর্ম বলে পরিগণিত হয়। তাইলে মানুষের জীবন চলার পথে পাথর (বাঁধা) না হয়ে দাঁড়াই। আসুন কারো জীবনে দুঃখ-কষ্টের, এমনকি দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কারণ না হই। কারো চলার পথে বাঁধা হয়ে না দাঁড়াই। সবার সাথে সুন্দর ভাবে সৃষ্টি কর্তার প্রেজেন্ট করা প্রেজেন্ট কালকে উপভোগ করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৪