১ ।
কি এক আজব এলাকায় বসবাস করছি, আমি আর আমার ২ বছরের ছেলে আকিব। যাকে দেখছি সেই অপরিচিত। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সবাই চাইনিজ। আমাদের দেশে এত চাইনিজ কেন বুঝে উঠতে পারছি না। সবাই এক একটা গ্রুপে বিভক্ত। সবার হাতে ধারালো অস্র, কারো হাতে ছুরি, কারো হাতে তলোয়ার। এক পক্ষ তার প্রতিপক্ষকে যেখানে পাচ্ছে সেখানেই আঘাত করে রক্তাক্ত করছে। কেউ মারা যাচ্ছে আবার কেউ পালাচ্ছে। আমাদের দেশের বাড়ির উঠানে আমি আমার ছেলের সাথে খেলা করছি। হঠাৎ করে একটি ১০/১২ বছরের মেয়ে আমাকে একটি সাইকেল দিয়ে বলল যে, আপনাকে আমাদের বড় ভাই দেখা করতে বলেছেন। এই সাইকেলে করে আপনি চলে যান। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে মেরে ফেলার জন্য এই নাটক সাজিয়েছেন সেই বড় ভাই। ওনার সাথে নাকি আমি কবে, কখন খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। সেই আক্রোশ থেকেই উনি আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছেন। আমি মেয়েটিকে বললাম ঠিক আছে আমি যাব তুমি এখন চলে যেত পার। আমি নিশ্চিত হলাম যদি আমি ধরা দেই তারা আমাকে মেরে ফেলবে। তাই আপাতত এখন সাইকেলে করে পালাই। আবার পরক্ষণে চিন্তা করলাম, না, সাইকেল নিয়ে পালানো ঠিক হবে না। হয়ত এই সাইকেলের মাধ্যমে তারা আমার গতি বিধি জেনে যাবে। পরে আমি আমার ছেলেকে নিয় অন্য এক এলাকায় আশ্রয় নিলাম। বুঝতে পারছি না কি করব? হঠাৎ মাথায় একটা প্ল্যান আসল আমিও আমার বন্ধুদের নিয়ে একটা গ্রুপ করব। লড়াই করে মরব। কিন্তু এখানেতো আমি কাউকে চিনতে পারছি না। আমার পরিচিত কেউ নেই এখানে। এমনকি আমার ছেলের মাকেও আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
সামনে একটু এগোলাম। দেখলাম একটি ছেলে একটি রক্তাক্ত মেয়েকে ধরে বাসায় ফিরছে। কাউকে ছাড় দিচ্ছে না এখন মেয়েদেরকেও আঘাত করছে। আমাকে ছেলেটি বলল ভাই এই দেশ থেকে চলে যান। না হলে আর বাঁচতে পারবেন না। এখন গভীর রাত, ভোরের অপেক্ষায় আছি। ভোর হলে আমার ছেলেটিকে আমি এক স্কুলে দিয়ে আসবো। শুনেছি ঐ স্কুলে নাকি থাকা নিরাপদ। অন্ততঃ আমার ছেলেটি এই বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। হঠাৎ করে আমার ছেলের কান্নায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি খুব ঘামতেছিলাম তখন। আল্লাহ্কে অসংখ্যবার ধন্যবাদ দিলাম ।
২।
দুই দিন যাবত আমার ছেলের শরীরটা একটু গরম। গায়ে একটু জ্বর চেপেছে, ওর মা রাতে আর সকাল ২ বেলায় ওকে এরই মধ্যে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। আমি গত রাতে অফিস করে বাসায় ফিরছি, লম্বা একটা ঘুম দিয়ে বিকেল ৫ টায় উঠলাম । ভাবছি, আজ ছেলেকে নিয়ে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াবো। তাই বিকেল ৬ টার দিকে আমি আকিব কে ওর মায়ের অফিস, গুলশান ২ থেকে নিয়ে আসলাম। ভাবছি মগবাজার যাব আর রাজিব আর অপুর সাথে দেখা করব। কিন্তু কিছুই হল না।
ছেলের বিরক্তির কারনে সোজা মধ্যবাড্ডা খোকা ভাইয়ের ঔষুধের দোকানে চলে গেলাম। উনি চা খাচ্ছেন। আমাকেও দিলেন। আর আকিবকে তারই পছন্দের একটা ফিজ আপ কিনে দিলাম। শুক্রবার বলে টুটুল ভাই তার দোকান খুলে নাই। আমি অবসর সময় প্রায়ই ওনাদের দোকানে আড্ডা দেই। আকিবের আম্মুর বাসায় ফিরতে ফিরতে সারে আট কি নয়টা তো বাজবে! ঘড়িতে এখন ৭ টা ৩০ । আর এক ঘণ্টা বিভিন্ন বাহানায় তাকে রাখতে হবে।
হঠাৎ করে আমার শরীরটা যেন কেমন লাগতেছিল। আমার ঘাড়টা ক্রমস ভারী হয়ে যাচ্ছে, ডান দিকে আর বাঁকাতে পারছিলাম না। আমার শরীরের তাপমাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে তা অনুভব করলাম। তাই আর দেরি না করে বাসায় ফিরে গেলাম। ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভি অন করে শুয়ে পড়লাম। ছেলেটা হিসু করে দিল আবার। তাই ওকে জামা-প্যান্ট খুলে ছেরে দিলাম। মনের আনন্দে আমাদের ফ্লাট থেকে পাশের ফ্লাটে আসা-যাওয়া করছে আর এটা ওটা ফেলছে। আমি যে ওকে একটু ধরব তাও একটু শক্তি পাচ্ছিলাম না। আমার বউ কে এস.এম.এস করে দিলাম। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে তাই তারাতারি পারলে বাসায় ফিরো। তখন ঘড়িতে ৭ টা ৪৫ হবে। ৮ টা ৩০ এর দিকে বউ বাসায় আসলো। বললাম ছেলেকে খাইয়ে মুড দিয়ে আমার ঘাড়টা মালিশ করে দাও। যত মালিশ করছে তত আমার ঘাড়টা ভারি হয়ে যাচ্ছে। বিছানা থেকে ঘাড়টা উপড়ে উঠাতেই পারছিলাম না। খুব ভয় পাচ্ছিলাম। তারপরও একটু আশা ছিল ঘুমাতে পারলে হয়তো ভাল হয়ে যাব। যা হোক অনেক কষ্টে ঘুমালাম।
৩।
দুই দিন পর । আমার আজ অফিস নেই। যাকে বলে ডে-অফ। আমার বউ সাধারনত ছেলেকে নিয়েই অফিসে যায়। ওকে দেখাশুনার জন্য ৯/১০ বছরের একটি মেয়েও রেখেছে, নাম তাহমিনা । ইদানীং আমার ছেলেটি তার মায়ের সাথে অফিসে যেতে চায় না। বাবার সাথে থাকবে। তাই কি আর করা আমার বউকে বললাম ঠিক আছে তুমি তাহমিনাকে নিয়ে চলে যাও আমি ওকে নিয়ে পরে আসতেছি। আমার ছেলেটি কখনও টেনিস বল, কখনও ফুটবল নিয়ে খেলা করছে। আমি খাটে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছি।
আমার দুঃস্বপ্ন নিয়ে আমি কিছুটা আজ উদ্বিগ্ন, আমি সাধারনত স্বপ্ন নিয়ে একটু ভেবে থাকি, আর দুই দিন যাবত ভেবে তার কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। মাথায় মৃত্যুর চিন্তা ঘুর পাক খাচ্ছে। তাই টিভিতেও মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে আমি ঘুমিয়ে যাই। আকিব, বাবা, বাবা, বলে ডাকছে। তার ডাক শুনে আমার ঘুম ভাঙ্গল। হাসি দিয়ে বল্ল বাবা, ভাও দাও। (ভীতকর জীব জন্তু কে আকিব ভাও বলে জানে)। আমি আমার ল্যাপটপ ওপেন করে দিলাম। আমি টিভিটি অফ করে ভাবছি, আমি যদি ঘুম থেকে না জাগতাম, আমার ২ বছরের ছেলেটি কতক্ষণ আমাকে ডাকতো ? এখন ঘড়িতে সকাল ১১ টা। আকিব আর আমি ছাড়া বাসায় কেউ নেই। ওর মা আসবে সেই রাত সারে ৮ টার দিকে। ও একা একা কি করতো ? এই সব উদ্ভট চিন্তাভাবনা করতেছিলাম। আমার ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে বললাম, বাবা, আম্মু যাবে তুমি? প্রত্যুত্তর আসল, না, আম্মু যাব না। তারপরও এক প্রকার জোর করে নিয়ে যাচ্ছি ওর মায়ের কাছে। রিক্সা নিলাম । ওকে শান্ত করার জন্য একটা বেলুন কিনে দিলাম। হঠাৎ আমার অনেক দিন পর রানা প্লাজার সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ল। সেখানে কতনা বাচ্চাদের মা-বাবা কাজ করতে গিয়ে আর বাসায় ফিরে আসেনি। তাদের ছোট্র ছেলে-মেয়েরা হয়ত আশায় ছিল তাদের বাবা-মা ফিরে আসবে। কেউ হয়ত ফিরেছে আবার কেউ হয়ত আসেনি। তাদের ছেলে- মেয়েরা এখন কে, কেমন আছে? ওদের দিন-কাল কেমন করে কাটছে? কে জানে? আমার ছেলের এমন পরিনতির কথা ভেবে আমার চোখে পানি জমে গেল। তা আবার আকিবের চোখ এড়িয়ে গেল না। আমার চোখে হাত দিয়ে বলল বাবা “ মাম” ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ৯:১৪