পর্ব এক-
১.লোকটা আকাশের দিকে তাকাল.সন্ধ্যার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পুরো পরিবেশটা বিষন্ন করে রেখেছে.শিকারের জন্য আদর্শ সময়.
সন্ধ্যা ০৬.৪৫. সময় হয়েছে. লোকটা গাড়ী ঘুরিয়ে বাদামতলী হয়ে দেওয়ানহাট ব্রীজ এর নীচে আসলো.ওই তো মেয়েটা হেঁটে আসছে. আশেপাশে মানুষজন নেই বল্লেই চলে. মৃদ্যু হেসে লোকটা গাড়ির কাঁচ নামালো.
২.নিলু হাঁটছে. দুরে একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে. ওই লোকটার গাড়ি নাতো? নিলু আশা করল যেন ওই লোকটাই হয়. লোকটার সাথে হঠাত্ই পরিচয়. কয়েকদিন লিফটও দিয়েছে. হ্যাঁ ওই লোকটাই. ভালই হয়েছে. আজও গাড়ি ভাড়া বাঁচবে. টিউশনের টাকা আর গাড়িভাড়া ম্যাচ করতে বেশ কষ্ট হয়. গাড়িতে ওঠার ঠিক আগে একটা কালো বিড়াল রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথায় দৌড়ে গেল. নিলু কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়. লোকটার হাসি দেখে নিজেও হাসল. নিলু গাড়িতে উঠে পড়ল.
৩.নিলুর ঘুম ভাঙ্গলো একটা রুমে. কম পাওয়ারের বাল্বে অন্ধকার অন্ধকার রুম. .লোকটা দুরে বসে আছে.নিলুর হাত পা চেয়ারের সাথে বাঁধা.
লোকটা হাসল. অপ্রকৃতস্হের মত হাসি.হাতে একটা ছুরি.
নিলু প্রাণপনে চিত্কার দিলো.
নিলুর চিত্কার সুর্বনা এক্সপ্রেসের হুইসেলের মাঝে হারিয়ে গেল
পর্ব দুই-
-বলে যাও
-১ম খুন নিলুফার ইয়াসমিন. লাশ পাওয়া যায় আগ্রাবাদ শিশুপার্কের মাঠে. ভোরে এক লোক দেখতে পায়. দেওয়ানহাট ব্রীজের নীচে একবাসায় টিউশনি করত. সোমবার টিউশনি করে বের হওয়ার পর আর খোঁজ পাওয়া যায় নি. লাশের মাথা ছিল না. সিটি কলেজের আইডি কার্ড থেকে পরিচয় পাওয়া যায়. লাশ পাওয়া যায় মঙ্গলবার ভোরে. অর্থ্যাত্ অপহরনের পর পরই খুনটা করা হয়.
কর্ণেল সিগারেটে টান দিয়ে বললেন,তারপর-
-২য় ভিক্টিমও নারী. পেশাদার চিত্রশিল্পী,শ্রাবন্তী দত্ত. মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীর এম এম আলী রোড থেকে এক লোক তুলে নিয়ে যায়. মেয়েটা হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠেছিলো. তাই কেউ সন্দেহ করেনি. মেয়েটার বন্ধুরা পুলিশকে জানিয়েছে গাড়িটা টয়োটা ছিল,লাইসেন্স নাম্বার জানে না. লোকটাকেও চেনে না. লাশ পাওয়া যায় বুধবার ভোরে,আমতলার নির্জন রাস্তায়. লাশের সব অঙ্গ ছিলো. শুধু দুটি হাতের একটাও ছিল না. নিখুঁত ভাবে সার্জিকাল নাইফ দিয়ে কাটা হয়েছে. পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলে.
-৩য খুন আজমেরী সোলায়মান, সেও নারী. নৃত্যশিল্পী. লাশ পাওয়া যায় মহসিন কলেজের পাশের রাস্তায় বৃহস্পতিবার ভোরে.
-মিসিং পার্টস?
-দুটি পা. উরু থেকে কাটা. সব খুনই চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটনে.
-তারপর?
-তারপর আর খুন নেই. শেষ লাশ পাওয়ার পর তিনদিন পেরিয়ে গেছে. আজ সোমবার.
-পুলিশ কি বলছে?
-পুলিশ কিছুই বলছে না. বলছে তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে. মিডিয়ায় তোড়পাড় অবস্হা.
-তো আমরা কি করতে পারি? কর্নেল সিগারেটে টান দিয়ে ব্যাক্তিগত সহকারী ফিরোজ এর দিকে তাকালেন.
-২য ভিক্টিম শ্রাবন্তী দত্তের বাবা নির্ঝর দত্ত,বিরাট শিল্পপতি, চাচ্ছেন কেসটা আমরা নিই. আমরা আগে আরো দুজন সিরিয়াল কিলার ধরেছিলাম তা জেনে এইসব তথ্য সব যোগাড় করে নিয়ে এসেছেন. তিনি বাইরা অপেক্ষা করছেন. ডাকব তাকে?
-ডাকো.
কর্নেল ওসমান সুপুরুষ.বয়স পয়তাল্লিশ ছুই ছুই. অসংখ্য পদক পেয়েছেন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন মিশনে তীক্ষ বুদ্ধি ও যোগ্যতার পুরস্কার স্বরূপ. স্ত্রী ছেলেমেয়ের এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর একাই থাকেন. মাঝে মধ্যে শখের বসে দু একটা কেস হাতে নেন.
ফিরোজ এসে ঢুকলো.
-বলুন,মিষ্টার দত্ত. আপনার জন্য কি করতে পারি?
-আমার একটা মাত্র মেয়ে. সেই মেয়েটা এত নির্মমভাবে খুন হল. শুধু আমার মেয়ে না. সিরিয়ালি খুন হয়েই যাচ্ছে. আমি চাই খুনী ধরা পড়ুক. যতটুক সাহায্য আমার পক্ষে সম্ভব আমি করবো.
কর্নেল নির্ঝর দত্তের হাত ধরে বললেন, আমি বুঝি কেমন লাগছে আপনার. আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব. আপনি বাড়ি যান.
-ফিরোজ,একটু পত্রিকা অফিসগুলোতে যাও,থানায় যেতেও ভুলো না. যত ইনফরমেশন পাও নিয়ে আসো. খুব সর্ট পিরিয়ডে খুন হচ্ছে. খুনীর প্যাটার্ন কমপ্লিট হলে আর ধরা যাবে না. যাও জলদি যাও.
পাঁচ ঘন্টা পর.
-কি জানতে পারলে?
-১ম ভিক্টিম নিলুফার ইয়াসমিন মেধাবী ছাত্রী,গরীব ঘরের মেয়ে. ক্লাস ফাইভ,এইটে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পর কলেজ লেভেল গনিত অলিম্পিয়াডে পদকপ্রাপ্ত. পেপারে আগেও ছবি ছাপা হয়েছে. শেষ ছবি মাথা ছাড়া লাশের. ফিরোজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো.
-২য় ভিক্টিম শ্রাবন্তী দত্ত চিত্রকলায় অত্যন্ত দক্ষ. কয়েকটি একক প্রদর্শনী ছাড়াও শিল্পী মহলে ব্যাপক পরিচিত. দু একটা ছবি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে. সুতরাং পেপারে আগেও ছবি ছাপা হয়েছে.
-৩য় ভিক্টিম আজমেরী সোলায়মানও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী. জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার প্রাপ্ত.
-তাহলে আমরা কি কি পেলাম?কর্ণেল মৃদু হাসলেন.
-কি পেলাম? ফিরোজ হাই তুলল.
-১. সবাই মেয়ে ২. সবাই চট্রগ্রামের ৩. সবারই ছবি খুন হবার আগেও পেপারে ছাপা হয়েছে.
-আচ্ছা ভিক্টিমদের সবারই ছবি ছাপা হয়েছে এমন কোন কমন পেপার আছে?
-নতুন দিনের সংবাদ. ফিরোজ ভ্রু বাঁকা করে বলল.
-গুড ওয়ার্ক ফিরোজ
খুনী সম্ভবত এই পেপারটা পড়ে এবং পেপার থেকেই শিকার সিলেক্ট করে.
এবার আসি প্যাটার্নে. যারা খুন হয়েছে সবাই মেধাবী. যে যার ক্ষেত্রে যা দিয়ে সেরা তার সেটাই নেই
-মানে?
-ফিরোজ তুমি দিন দিন গবেট হচ্ছ. গনিত অলিম্পিয়াডে পদকপ্রাপ্ত মেয়েটির মাথা নেই,চিত্রশিল্পীর হাত নেই.নৃত্যশিল্পীর পা নেই.তাহলে বাকি থাকলো কি কি?
-কি কি? ফিরোজ আগ্রহ নিয়ে জিগ্যাস করল.
-বডি গাধা বডি. বডি আর গলা. লোকটা নিজেকে শিল্পী মনে করে. লোকটাকে ধরতে হলে তার মত চিন্তা করতে হবে. সে সব নিখোঁজ অঙ্গগুলো জোড়া দিয়ে কিছু একটা বানাতে চায়. ও হ্যা সব গুলো মেয়ের বয়সই কিন্তু ২৫ বছর.
গত এক বছরে ২৫ বছরের নিচে যত চট্রগ্রামের যত মেয়ে কন্ঠশিল্পী এবং মডেলের ছবি নতুন দিনের সংবাদ পত্রে আহয়েছে পুলিশকে বল তাদের উপর নজর রাখতে. এবং সবাইকে সতর্ক করে দিতে বলো.
-ক্রিং ক্রিং
-হ্যালো ফিরোজ বলছিলাম. কি বলছেন কি. ঠিক আছে আমি কর্নেলকে জানাচ্ছি.
-কি হয়েছে?
-আরো একটা লাশ. কর্নফুলী ব্রীজের পাশে.লাশের গলার অংশটুকু নেই.
কর্ণেল লাফ দিয়ে উঠে বললেন তাড়াতাড়ি মডেল রুম্পা চৌধুরীকে খবর দাও. আগের লাশে গুলোর যে ফিগার দেখলাম মনে হচ্ছে রুম্পা চৌধুরীর সাথে মিলে যাবে. ও হ্যানতুন দিনের সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিক এবং কোতয়ালী থানার ওসি সাহেবের সাথে একটা এপোয়ান্টমেন্ট কর জলদি. লোকটার এখন শুধু বডি দরকার.
পর্ব তিন-
১.লোকটা হাঁটছে.লোকটার মন খারাপ. দুরে দুরে উজ্জ্বল রোদ. লোকটা পেপারের ভাঁজ খুলে নির্দষ্ট পাতায় এলো. হুম ছবির মেয়েটা সুন্দর. বডি হাত পা মাথার সাথে মিলবে মনে হচ্ছে. নাম রুম্পা চৌধুরী. আর দেরী করা যাবে না. অঙ্গগুলি পচা শুরু করবে যে কোন দিন. ফ্রিজ আর মেডিসিন দিয়ে আর কয়দিন. লোকটা হঠাত সে উঠল. কারণ রুম্পার ফোন নম্বর দেওয়া আছে. সে এখন ফ্রী লেখা আছে তারমানে কাজ পাচ্ছে না.তবে আগে সামনা সামনি দেখতে হবে বডি ম্যাচ করবে কিনা. লোকটা ফোন দিল.
-হ্যালো
-রুম্পা চৌধুরী স্পিকিং
-আমি গোলাম হায়দার. আপনাকে দিয়ে একটা বিঞ্জাপন করাতে চাই যদি ফ্রী থাকেন.
-আমি ফ্রী আছি.
-আসলে আমি সামনা সামনি কথা বলতে চাচ্ছিলাম.
-ঠিক আছে. ব্রোষ্ট ক্যাফে সন্ধ্যা ছটায়.
লোকটা মনে মনে হাসল.
-ঠিক আছে.
লোকটা ফোন কেটে দিল.
রুম্পা কর্নেলের দিকে তাকালো. কর্নেল মাথা নেড়ে জানালেন ঠিক আছে.
২রুম্পা বসে আছে. কেউ যে আসছে না. একটা লোক এগিয়ে আসছে. এই লোকটাই হবে বোধহয়. নাও হতে পারে.
-রুম্পা চৌধরী?
-ইয়েস
-আমি গোলাম হায়দার.
রুম্পা ভালো করে লোকটার দিকে তাকালো. ভদ্র নিস্পাপ নিস্পাপ চেহারা,দামী পোশাক তবে একটা হাত বেঁটে আর মনে হয় একটা চোখ পাথরের.
-আসলে আমি একজন উঠতি নির্মাতা. আগে তেমন কাজ করিনি. আপনাকে দিয়েই শুরু করতে চাই. আপনাকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেব. তবে আগে আমার সেটআপটা দেখুন আপনি করবেন কিনা. আমি একটু কাজ করে রেখেছি যদি একটু স্টুডিওতে যেতেন. আসবেন?
-আপনার স্টুডিও কোথায়.
-কর্নফুলী মার্কের পিছনের চারিয়া পাড়ায়. আমার বাসার বেজমেন্টে.
-চলুন.
ক্যাফে থেকে বের হতেই সাদা টয়োটাটা রুম্পার চোখে পড়ল. হঠাত্ একরকম ভয় লাগল. যদি কর্নেল কোনভাবে ওকে মিস করে ফেলেন.
-কই উঠুন
রুম্পা একবার ঢোক গিলে গাড়িতে উঠে পড়ল.
পর্ব চার-
খবরটা একদম প্রথম পাতায় বের হয়েছে.
সিরিয়াল কিলার গোলাম হায়দার গ্রেপ্তার. চট্রগ্রাম নগরীতে গত একসপ্তায় চান্চল্যকর চারটি খুন এবং পঞ্চম শিকার রুম্পা চৌধুরীকে জবাই করার চেষ্টা অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়. কর্নেল ওসমানের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে গোলাম হায়দার রুম্পা চৌধুরীকে তার বধ্যভুমি নিজ বাসার বেজমেন্টে নিয়ে যায়. জবাই করার ঠিক আগের মুহুর্তে কর্নেল ওসমান পুলিশি সহায়তায় গোলাম হায়দারকে গ্রেপ্তার করেন. বেজমেন্টের রুমটি পুরোপুরি সাউন্ডগ্রুফ ছিলো এবং আগে খুন করা লাশের অঙ্গ প্রতঙ্গ গুলো ফ্রিজে পাওয়া যায়. এব্যাপারে গোলাম হায়দার স্বয়ং একটি স্বীকারক্তি দিয়েছেন. নিম্নে তা দেওয়া হল:
"আমি গোলাম হায়দার. বয়স ৩৭. ছোটবেলা থেকেই একা,এতিম. খালার সাথে থাকতাম. একটা চোখ নষ্ট এবং একটা হাত বেঁটে. কিছুই নিখুঁত করতে পারতাম না. খালা খালি চিল্লাতেন. আমাকে দ্বারা যেন কোন কিছুই নিখুঁত হয় না. যাই করি ভুল.বয়স যখন চব্বিস খালা মারা গেলেন. খালার টাকা ছিলো. আমি ছাড়া বুড়ি খালার কেউ ছিলো না. টাকা পেয়ে ব্যাবসা করে একটু লাইনে আসলাম. বেজমেন্টে রুম বানালাম.সবাই জানলো মিউজিক স্টুডিও. আমি মেয়েদের সাথে মিশলাম. আমার টাকা ছিলো. সহজেই মেয়েদের ফাঁদে ফেলতে পারতাম. তবে যাদের খুন করেছি সবাইকে বাছাই করতে বেশ কষ্ট হয়েছে. লাশ যাতে না পচে সেজন্য মেডিসিন নিয়ে একটু পড়তে হয়েছে. ডোমদের থেকে লাশ কাটা শিখতে হয়েছে. যা করেছি সব একটি নিখুঁত মেয়ের জন্য. আমি চেয়েছিলাম একটি নিখুঁত মেয়ে যার সাথে প্রেম করা যাবে. হোক একদিনের জন্য. যে আমাকে বলবে না তুমি খুঁতওয়ালা মানুষ."
কর্নেল পেপার রেখে বাইরে তাকালেন.বাহিরে রোদ উঠেছে। সুন্দর রোদ। একদম নিখুঁত।