শৈশবের শুরুটা আমার ঠিক কখন থেকে শুরু হয়েছিল তা পরিষ্কার মনে নেই। ছোট বেলায় দাদুর বাড়িতে ছিলাম দু’বছর, আমার যখন দু’বছরের তখন যাই, ফিরে আসি চার বছর বয়সে। নানা আর নানীকে আমি দাদু ও দিদা বলি। ভাসাভাসা স্মৃতি মনে আছে, এক দৌড় দিয়ে বাড়ির উঠান পার হয়ে গিয়ে মেঠো বারান্দায় উঠতাম, কুনোব্যাঙ ধরতাম। রামপুর চা বাগানের পরিবেশটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম, যদিও সুনসান নীরবতা সব চা বাগানেরই একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। দাদুর জমিজমা ছিল, বাসার উঠানে ধান বস্তার পর বস্তা এনে রাখা হতো, সেই বস্তার উপর লাফ মেরে উঠা, পাকা ধানের নেশা ধরানো গন্ধ অনুভব করা, খুব কাছ থেকে ধানকে বিশাল ডেকচিতে সেদ্ধ করতে দেখা, ধান নিয়ে চুলার ভেতর ফেলে দিলেই নিমেষেই খই হয়ে যেতে দেখা, ধানের খড়ে লাফালাফি করে চুলকানি শুরু হলে সরিষার তেল লাগানো...কতকিছু যে করেছি ছোটবেলায় ওখানে। একবার একটা বাছুরের নাভি টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, আমার কাছে মনে হয়েছিলো এই আজাইরা জিনিসটা বাছুরের পেটে কেন লাগানো থাকবে! আমি অতি আনন্দিত হয়ে দিদাকে দেখালাম সেই শুকনো নাভি, দিদা দেখে হতভম্ব। পরে দেখেছিলাম সেই বাছুরের নাভি থেকে রক্ত ঝরছে, মলম লাগানো হয়েছিল। পরে অবশ্য ঘটনা চক্রে সেই বাছুর গাভী-সহ আমাদের বাসাতেই এসেছিলো অনেক পরে, সেই বাছুরের সাথে আমার খাতিরও হয়ে গিয়েছিল খুব, আমি যখন ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ি তখন সেই গরুর পিঠে চড়ে বসতাম, বেটা একটুও নাড়াচাড়া করতো না।
ছোটবেলা থেকেই আমার পশুপাখির সাথে খাতির একটু বেশি, যা এখনও বহাল আছে, আমার কাছে মনে হয় আমি পশুপাখিদের সাথে কোনও ভাবে যোগাযোগ করতে পারি, নিজে বেশ কয়েকবার তার প্রমাণও পেয়েছি, কিন্তু কীভাবে সেটা এখনও ধরতে পারি নি। যাই হোক, সম্ভবত ছোট বলেই বকাঝকা শুনতে হয় নি তখন। তাছাড়া দাদুর বাসায় আমার একটু প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল, আমি ছিলাম এই সিঁড়িতে প্রথম ছেলে। মায়েরা পাঁচ বোন, ভাই নেই। বড় মাসীর আবার হয়েছে মেয়ে, সবাই টেনশনে ছিল এই সিঁড়িতেও কি শুধু মেয়েই হবে! দাদু আমাকে রেখে দিতে চেয়েছিলেন, আমাকে বড় করে আমার লেখাপড়া থেকে শুরু করে সব কিছুই নিজের কাছে রেখে করাতে চেয়েছিলেন, বাবা-মা রাজি হয় নি। রাজি হবার কথাও না অবশ্য, নিজের ছেলেকে নিজের বাবা-মার কাছে রেখে দেয়াও মানুষের পক্ষে কঠিন। ওই সময় আমি তিন চাকার সাইকেল চালিয়ে উঁচু বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলেছিলাম, আমার নিচের ঠোঁট তাই ঐ সময় থেকেই একটু মোটা হয়ে গেছে, আর ঠিক হয় নি।
সে সময় কোথাও বেড়াতে গেলে সবাই মিলে ট্র্যাক্টরে করে বের হতাম। বাগানের ট্র্যাক্টরের পেছনে টেইলরের উপর মোড়া তোলা হতো এবং সেই মোড়ায় আমরা সবাই বসতাম। সে এক মজার ব্যপার! আমি দাদুর কোলে বসতাম। সেইসব দিনগুলোর কথা ভাবলে মনে হয় যেন গত জন্মের কথা!
খুব সুন্দর রুটিন মাফিক জীবন ছিল আমার তখন, এটা অবশ্য আমার নিজের কথা না, শোনা কথা। সেই দু’বছরের মাঝের কোনও এক সময়ে আমি আমার জীবনের প্রথম সিগারেটের টানটা দিই, যদিও অভিজ্ঞতাটা মোটেও সুখের ছিল না। এক সন্ধ্যায় আমি উঠানে দৌড় ঝাপ দিচ্ছি, কারা জানি বাসায় বেড়াতে এসেছে। দেখলাম কে একজন বারান্দা থেকে সিগারেটের টুকরো নিচে ফেলেছে। আমি গিয়ে সেই টুকরো মুখে নিয়ে দিলাম টান, পর-মুহূর্তে যা মনে হল, আমার বুকের ভিতর যেন আগুনে জ্বলে গেছে, এতোটাই কড়া ধোঁয়া! সেই যে সিগারেট ভীতি মাথায় ঢুকে গেলো, তারপর আর আঠারো বছর ভয়ে সিগারেট মুখে নিয়ে দেখি নি। যাই হোক, আমাকে কয়েক বার নিজেদের কাছে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল বাবা-মা, আমাকে বাসায় নিয়ে আসলে দুঃখে আমি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিতাম। ঐ দিকে আমার দিদারও আমার বিরহে বাকরুদ্ধ অবস্থা, তখন আবার আমাকে রামপুর ফিরিয়ে না এনে উপায় থাকতো না। বাসায় নিয়ে আসার পর একবার আমি ষোল দিন না খেয়ে ছিলাম, অবস্থা বেগতিক দেখে আমাকে রামপুরে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আমি দিদাকেই তখন মা থেকে বেশি ভালবাসতাম, দিদাকেই মা মনে করতাম। দিদাও আমাকে নিজের ছেলের মতনই যত্ন করে রাখতেন। আমাকে রামপুর থেকে নিয়ে আসলে আমার জিনিসপত্র যা যেভাবে ছিল সেভাবেই রেখে দিতেন, আধা বোতল দুধ থাকলেও ঐভাবে রেখে দিতেন। আমার মনে আছে, দিদা পান খেতেন, আমি চাইলে মুখ থেকে পানের ছাবড়া একটু বের করে দিতেন, সেই ছাবড়াই খেতে অমৃত লাগতো। আমার মনে হয় নাতী-নাতনীদের মধ্যে দিদা আমাকেই সবচে বেশি ভালোবাসেন। আমি ছিলাম দিদার চোখের মণি। সেই দিদা এখন একা, পাঁচ মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে, সবাই দূরে থাকে। তাঁর নিজেরও শরীর খারাপ, হার্টের লেফট ভেন্ট্রিক্যল নষ্ট, এলভিএফ ডিজিস। অবস্থা ভালো না। এখন হাঁটতেও পারেন না ঠিক মতো। আমার খুব খারাপ লেগেছে দেখে কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। প্রকৃতি কিছু জিনিস সম্পূর্ণই তার নিজের মতো করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে যেগুলো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে এখনও দিদার হাতের রান্না সেই আগের মতনই সেরা। আমি যেসব সবজি অপছন্দ করি সেগুলোও দিদা রান্না করলে ঠিকই তৃপ্তি নিয়েই খাই। দিদা আমাকে ছোটবেলায় মায়ের মমতা দিয়ে বড় করেছেন, সেই জন্য দিদার কাছে আমার ঋণ শোধ করার মতো নয়।
সেই সময় আমি নাকি প্রায় সময়ই ঝিম মেরে বসে থাকতাম। দাদু দিদা দেখলে আমার ঝিম মারা ভাঙ্গিয়ে দিতেন। তাদের ভয় ছিল, আমি যদি না আবার সাধু সন্ন্যাসী হয়ে যাই! ভয় পাওয়ার কারণও ছিল অবশ্য। আমি নাকি আনমনে কথা বললে কথা মিলে যায়। একবার বলে ছিলাম আজ বাসায় বাবা-মা আসবে, ঠিকই সেই দিন ওরা এসে উপস্থিত, আমি আরও বলেছিলাম ছোট একটা বাচ্চা মাথায় ব্যথা পাবে, বাসায় ওরা আসার পর দেখা যায় আমার ছোটটা সত্যি সত্যি মাথায় আঘাত পেয়েছে। পুরো বিষয়টাই কাকতালীয়, কিন্তু ছোটরা কোনকিছু বললে সেটা বেশ গুরুত্বের সাথেই করা হয় দেখে আসছি।
সেই ছোটবেলা থেকেই আমার নেইল পলিসের প্রতি এক ধরণের বিতৃষ্ণা কাজ করতো, যা এখনও বহাল আছে। শৈশবে আমার হাত পা এ অনেক বার নেইল পলিস লাগানোর চেষ্টা করে ছিল মাসীরা, পারে নি। ঘুমে থাকলেও কীভাবে যেন টের পেয়ে যেতাম। আমি কেন এমন হলাম কারণটা আমি এখনও বের করতে পারি নি। নেইলপলিশ, মেহেদী, আলতা এইগুলো দেখলেই আমার শিরশির করে উঠে। ছোটবেলায় নেইলপলিশ বা মেহেদী লাগানো হাত দিয়ে ভাত মেখে দিলে আমি খেতাম না। আমার ভালো লাগে পরিষ্কার হাত পা, কোনও কৃত্রিমতা নয়, সেটা সেই ছোটবেলা থেকেই।
এখন আমি যা, সেটা গড়ার পিছনে রামপুরের ভূমিকা ঠিক কতটুকু সেটা হিসেব করে বলা আমার জন্য একটু কঠিন, তবে বলা যেতে পারে পৃথিবীটা আমি রামপুর থেকেই দেখা শুরু করেছি। আমাকে অনেক বার বাসায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেও এনে রাখা যাচ্ছিলো না। বাসার একটা স্মৃতি আমার মনে আছে, সবজি বাগানের ঢুকার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছি আমি, ভিতরে যেতে পারছি না কারণ দুই ফিট উঁচু একটা বেড়া, সম্ভবত গরু ছাগল আটকানোর জন্য দেয়া। সেটা দিনের বেলার স্মৃতি, সন্ধ্যার স্মৃতি একটাই মনে আছে, বাবা অফিস থেকে ফিফটি হোন্ডা নিয়ে ফিরেছে, আমি দৌড়ে বারান্দায় গেছি দেখতে, বাবা ড্যাশ-বোর্ডে নিউট্রালের সবুজ বাতি আর সিগন্যালের কমলা বাতি বারবার জ্বালিয়ে নিভিয়ে আমাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে, আমিও মোটামুটি মুগ্ধ, কেননা রামপুরে দাদুরও একটা ফিফটি হোন্ডা ছিল, সেটা ছিল নীল, বাবারটা লাল। মা শোবার ঘরে ড্রেসিং টেবিলে বসে কি যেন করায় ছিল। যাই হোক, আমাকে মুগ্ধ করার অনেক চেষ্টা করেও কাজ হয় নি তখন, রামপুরে নিয়ে রেখে আসতে হয়েছে। তখন বাবা ছিল চাম্পারায় চা বাগানে। পরে বাবা যখন সিলেটের লাক্কাতুড়া চা বাগানে বদলি হয়ে চলে আসলো, তখন আমি স্থায়ী ভাবে বাবা-মায়ের সাথে থাকতে চলে আসলাম, সম্ভবত শহর ঘেঁষা পরিবেশটাই আমাকে বাবা-মার সাথে থাকতে সাহায্য করেছে।
সেই থেকে শুরু হল আমার শৈশবের সম্পূর্ণ নতুন এক অধ্যায়।