নির্বাচনের আগে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি যে প্রসঙ্গটা আলোচিত হয়েছে সেটা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী। আওয়ামিলীগ তো দাবী করবেই, আমাদের সুশিল সমাজ, গণমাধ্যম এমন কি সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ববর্গ এবং দেশের বুদ্ধিজীবিদেরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে রাতের ঘুম হারাম করে দিতে দেখেছি। অথচ এখন পরিবেশ অনুকূলে, সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছয়মাসের উপরে চলে গেল, এই প্রসঙ্গ যেন সবাই বেমালুম ভুলে গেলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সবাই গলা ফাঁটিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী করেছিলেন, যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর কোনো কাজ নাই, বিচার করাই একমাত্র কাজ। একটা সরকার দেশের ক্রান্তিলগ্নে এসে দেশকে একটি মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিচক্ষণতার কারণেই আমরা এতো শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন পেয়েছি। আমাদের সবার সমস্যা হলো আমরা একশটা ভালো কাজ করলেও কোনো প্রশংসা করিনা, কিন্তু নিজের আশানুরূপ একটি কাজ না হলে সমালোচনার জোয়ারে ভাসিয়ে দেই।
যা বলছিলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবল চাপের মধ্যে বাড়তি চাপ দেয়া হলো, তা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী। যাই হোক, নতুন সরকার আসলো, তারপর এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী কেমন যেন মিইয়ে যেতে থাকলো। আমি এই জুলাই মাস থেকে ব্লগে ফিরে এসেছি। গত পাঁচমাস আমি অফলাইনে ছিলাম। তো, ব্লগে ফিরার পর থেকে এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে কোনো পোস্ট আমার চোখে পড়েনি (আমার চোখে পড়েনি অথবা হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে), হয়তো সবাই এই বিষয়টা এখন ভুলে গেছেন, অথবা এই প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা ব্লগের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
এরকম তো হবার কথা ছিলনা। যে প্রসঙ্গটা নিয়ে এতো আলোচনা-সমালোচনা সে বিষয়টা সবাই বেমালুম ভুলে যাচ্ছে এটা তো কোনো ভালো লক্ষণ না। তাহলে কি আমরা ধরে নেবো, যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী ছিল শুধুমাত্র নির্বাচনের একটা হাতিয়ার? বিরোধীদলের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার হাতিয়ার? তা না হলে এখন এতো চুপচাপ কেন সবাই?
আমরা বাঙালী জাতি হুজুগে চলি। কি হলো না হলো তা না দেখে না বোঝেই শুধু লাফাই, কিছু করতে গেলে কাউকে আর খুজে পাওয়া যায়না। এখন নতুন প্রসঙ্গ সবাই পেয়ে গেছে, "টিপাইবাঁধের প্রতিবাদ"। এই প্রসঙ্গ সবার মাথায় সিন্দাবাদের ভূতের মতো ঢুকে গেছে। অনেকদিন থাকবে, তারপর যথারিতি আবার চলেও যাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবীও এক সময় সিন্দাবাদের ভূতের মতো মানুষের মাথায় ঢুকেছিলো। এখন পর্যন্ত টিপাইবাঁধের প্রতিবাদে অনেক লেখাই পড়েছি, প্রতিবাদ আর কাউকে করতে দেখলাম না। ল্যামপোস্ট দেখিয়ে দিয়েছে যে তাদের মেরুদন্ড আছে। তারা প্রতিবাদ করতে জানে। আর বাকিরা? আমরা তাদের বাহবা দিয়ে যাচ্ছি, মাঝে গড়ে উঠলো প্রথমআলোর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ। প্রথমআলো বর্জনের আহবানে পোস্ট এসেছে, কিন্তু কই, টিপাইবাধের প্রতিবাদে একটা মানববন্ধনের তো কোনো আহবান আমার চোখে পড়লোনা! আমাদের ভাবখানা এমন যে, আমরা টিপাইবাধের কথা চিন্তা করে অস্থির হই এবং এটা ভেবে পুলকিত হই যে আমরা দেশের জন্য কতোটা চিন্তা করি! আমরা চাইলে পারতাম টিপাইবাধের প্রতিবাদে রাজপথে একটা মিছিল বের করতে, পারতাম সভা সমাবেশ করতে, তা না করে আমরা করছি কী? "প্রথমআলো বর্জন করো", যেন সব দোষ প্রথমআলোর, এই সরকার যে টিপাইবাধের চামচামি করছে, সেটা কোনো দোষ নয়। যেন প্রথমআলো (নতুন নামঃ প্রথমকালো) বর্জন করলেই টিপাইবাঁধ রুখে দেয়া হবে!
আমার আরো অবাক লাগে, এই টিপাইবাঁধ নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর নিষ্কৃয়তা দেখে। ক্যাম্পাসে এখন পর্যন্ত এই ইস্যু নিয়ে কোনো প্রতিবাদ সভা, মিছিল , কোনো কিছুই দেখলাম না। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চালের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সবাইকে গলা ফাটিয়ে মিছিল করতে দেখলাম। চালের দাম শুধু বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বেই বেড়েছিলো। ক্যাম্পাসের "সশিক্ষিত" পোলাপানেরা সেটা জানার পরও প্রতিবাদে গলা ফাটিয়েছে। আর, এখন যে টিপাইবাঁধ নির্মিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে, সে বিষয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই! অথচ টিপাইবাঁধ নির্মিত হলে দেশের মারাত্বক পরিবেশ বিপর্যয় হবে।
আমাদের আসলে সাহস নেই। ল্যাম্পপোস্টের সাহস আছে, তারা দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা তাদের সাহসকে বাহবা দিয়ে দিয়ে নিজেরা ধন্য হচ্ছি, কিন্তু কেউই নিজেরা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিনা। একথা ভুলেও কাউকে বলতে দেখছিনা, যে, আসুন; আমরা রাস্তায় নামি প্রতিবাদ করতে।
এই যে এতো কথা বলছি, আমিও সেই দলেরই একজন। কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই।
এই টিপাইবাঁধ প্রসঙ্গে বিরোধীদলের উচিত ছিল প্রতিবাদী হয়ে ওঠা, অন্তত একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা, এ কথা বলছি , কারণ আমার আপনাদের চেয়ে বিরোধীদলের সাংগঠনিক ক্ষমতা অনেক বেশি, তারা ডাক দিলেই অনেক মানষ জড়ো হবে, তারা সেটা না করে যা করছে সেটা হলো মৌখিক প্রতিবাদ, ভাবটা এমন, যেন তাতেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, তারচেয়ে বড়কথা এই ইস্যু ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে। হায়রে! কি আমাদের দেশ, আর কি আমাদের জনতা!
পুরনো কথায় ফিরে আসছি, ছয়মাস তো পেরিয়ে গেলো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কী আদৌ হবে?
নাকি সেটা ছিলো একটা বড়ো ধরণের রসিকতা?