১১ এপ্রিল, ২০১৮
ভোর ৫ টা।
সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীর রগ কাটার জন্য সুফিয়া কামাল হলের সভাপতিকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। শুনলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বহিষ্কার করেছেন প্রোভোস্ট।
এসব শুনে হাসি পাচ্ছে খুব। যে ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিপক্ষে দাঁড়াতে ক্যাম্পাসে বহিরাগত নিয়ে আসে, যে ছাত্রলীগ রামদা, রড, লাঠি নিয়ে আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করে, তারাই ভায়োলেন্ট আচরণের জন্য তাদেরই এক কর্মীকে বহিষ্কার করলো!
কাল ছাত্রলীগের সভায়, কলাভবনের সামনে, নিজের চোখে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবদ আল হাসানকে দেখেছি, বলছেন, “যারা ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, তারাই করছে এ আন্দোলন।“
কাল আমরা মিছিলে নেমে, আন্দোলন করে দেখিয়ে দিয়েছি, আমরা অহিংস আন্দোলন করতে পারি। আমাদের উপর আক্রমণ না করা হলে, আমরা নিজেদের রক্ষার্থে বাঁশ, রড, লাঠি তুলে নেই না।
ভোর ৬ টা।
হলের ভিতরে নিজেকে নপুংশক মনে হচ্ছে। সব হল থেকে বেড়িয়ে পড়ছে ছাত্ররা। জসীম উদ্দিন হলের ছাত্রলীগের সভাপতি আন্দোলনে যেতে দিতে বাধ্য হয়েছেন ছাত্রদের। জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের আওতার বাইরে চলে গেছে।
আমরাই পারছি না কিছু করতে।
এখনও অনেক ছেলে জেগে আছে। যে ছেলেটা রাত বারোটায় ঘুমিয়ে সকাল আটটার ক্লাস ধরতো, সেও আজ স্ক্রল করছে আপডেটের জন্য।
কিছুক্ষণ পর একটু চিতকারের শব্দ পাওয়া গেল। আমাদেরই প্রথম বর্ষের কয়েকজন ছেলে বড় ভাইদের চোখ এড়িয়ে, সুফিয়া কামালের সামনে গিয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গায়ে হাত দেবে না হয়তো। এখন আর কোন ছাত্রের গায়ে হাত দেয়ার সাহস ছাত্রলীগের নেই।
এই আন্দোলনকে বিরোধীতা করার অধিকার সকলের আছে। এটা কোন আকাশ থেকে পতিত আন্দোলন নয়। ভুলচুক থাকবেই। ছাত্রলীগও বিরোধীতা করতে পারে। তারা যদি শুধু আন্দোলনে বাধা না দিয়ে বিরোধিতা করতো!
সকাল ১০ টা
ছটার দিকে একটু ঘুমিয়েছিলাম। উঠে দেখি ৬ টা মিসডকল, বাবা ফোন দিয়েছিল। প্রেমিকা ১১টা ম্যাসেজ দিয়েছে। “এখন তুমি কোথায়? সেইফ আছো?”
মা একটু পর ফোন দিয়ে বলল, “বাবা, তোমার আন্দোলন করার দরকার নাই। তোমার বাবা টেনসন করছে খুব। তোমার কিছু হইলে কিন্তু আমি বাঁচবো না!”
আমার বাবা মা এই কোটা সংস্কারের পক্ষে। তারা চায় আন্দোলন হোক। কিন্তু তাদের নিজের ছেলে আন্দোলন করুক, এটা চায় না!
কী আজব দুনিয়া।
সাড়ে এগারোটা
হল থেকে বের হতে পেরেছি। বের হওয়ার আগে একটা পাতায় সাক্ষর করেছি। যদি আমাদের ১ম বর্ষের কাউকে আন্দোলন করার জন্য নির্যাতন করা হয়, যদি কাউকে এজন্য হল থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাহলে যেন আমাদের সবাইকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। আমরা প্রায় ৬০ জন সাইন করেছি।
প্রায় বারোটার দিকে দেখলাম জীবনের সবচেয়ে বড় মিছিলটা। গত কালের মিছিল্টা এর কাছে শিশু। গতকাল অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিল। আজ হিসেব করলে, সে সংখ্যাটা আজ এক লাখে গিয়ে পৌঁছবে। ঢাকার প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, প্রতিটা অনার্স কলেজ থেকে ছাত্ররা এসেছে।
মেয়েরা এতো এসেছে কল্পনাও করা যায় না। ঢাবির প্রতিটা হলের মেয়েরা অংশগ্রহণ করেছে নিজেদের তাগিদে।
আমাদের হলের বড় ভাইদের দেখলাম মিছিলে। আমার পাশে সূর্য সেনের একজন ছিল। সে স্লোগানে সাথে তাল দেয়া থামিয়ে বললো, “আমাদের হলের সবাই এসেছে প্রায়। হলে আর কেউ নেই বোধহয়!”
আজ মিছিলে সবচেয়ে কম আছে হয়তো জিয়া হলে ছাত্ররা। জিয়া হল ছাত্রলোগের ঘাটি। কাল নাকি অস্ত্র নিয়ে অনেক বহিরাগত জিয়া হলে ঢুকেছে। জিয়া হলে গেস্টরুমে যেভাবে শাস্তি দেয়া হয়, আমার মনে হয় না, কেউ লীগের কথা না মেনে হল থেকে বাইরে আসবে। কেউ এলে, সে সংশপ্তক।
মিছিল থেকে হলে ফিরে যাওয়ার সময় একটা ছোট বাচ্চাকে কাঁঠালিচাঁপা ফুল কুড়োতে দেখলাম। কী নিষ্পাপ ফুটফুটে বাচ্চা। তার হাতের কাঁঠালিচাঁপা প্রাণ পেয়েছে আরেকবার।
এই নিষ্পাপ শিশুটাও একদিন চাকরি পাবে না কোটা সংস্কার না হলে। হতাশায় ভুগে একদিন আত্মহত্যার কথাও ভাবতে পারে।
আমাদের এই ছোট্ট বাচ্চাটার জন্য হলেও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
কাল ভোরে “কোটা সংস্কার চাই” গ্রুপে এই আন্দোলনের কমিটি থেকে একটা স্ট্যাটাস দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, যাতে hsc পরীক্ষার্থীদের কোন সমস্যা না হয়, তাই সকাল ১০ টা পর্যন্ত আন্দোলন রাজপথে নামবে না। আর দুপুর একটার পর এক ঘণ্টার জন্য আন্দোলনে বিরতি থাকবে।
আমার কাছে পোস্টটার স্ক্রিনশর্ট নেই। থাকলে হুবহু স্ট্যাটাসটা তুলে দিতে পারতাম।
দুপুর একটায় আবার রাজু ভাস্কর্যের সামনে ফিরে আসি। এসেই একটা অতুলনীয় বিষয় দৃষ্টিগোচর করতে সক্ষম হই আমি। বাংলাদেশের কোন আন্দোলনে এমনটা আগে হয়েছে বলে মনে হয় না।
একটা ambulance রাজু ভাস্কর্যের সামনে দিয়ে মেডিকেলে যাবে। অন্যান্য সব রাস্তায় জ্যাম। তাই বাধ্য হয়ে এ পথে আসা। আন্দোলনকারীরা রাস্তা থেকে উঠে পথ করে দিয়েছে ambulance কে। যাতে কোন বাধা না পায়, তাই সবাইকে সরে যেতে বলা হয় মাইকে।
আমার তখনই মনে পড়ে যায়, এটা ছাত্রদের আন্দোলন। এ আন্দোলন কারো ক্ষতির জন্য নয়। এ আন্দোলনে একটাও প্রাণ যাক, চাই না আমরা।
টিএসসির ভিতরে এলাম। বাইরে উত্তাল স্লোগান। রোদে ঝলসে গেছে সবার মুখ। অনেককে দেখলাম প্লাকার্ড লিখছে লাল, কালো, নীল কলমে। এরা হয়তো চারুকলার ছাত্র। বড়বড় লম্বা চুল। মুখে দাড়ি।
আজ এই আন্দোলনে, প্রতিটা ছাত্রের সাথে আমার অন্তরের মিল খুঁজে পাচ্ছি আমি। গণ আন্দোলন এমনি হয় কি?
আমাদের ডিপার্টেমেটের ডিনের কথা মনে পড়ছে এখন। তিনি গতকাল অপরাজেয় বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে ভিসির উপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি, এতো ছাত্রছাত্রীর উপর যে হামলা হলো, তার জন্য একটা কথাও বললেন না!
আমার ডিপার্টমেন্টে এ সপ্তাহে কালচারাল প্রোগ্রাম ছিল। নাম না বলি, আমাদের এক ম্যাম বলেছেন, “তোমরা কালচারাল প্রোগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নাও!”
এ আন্দোলনের মধ্যে কালচারাল প্রোগ্রাম! আমরা মিছিলে না গিয়ে কবিতা আবৃত্তি করবো, গাইবো আর নাচবো?
আমাদের স্যার আর ম্যামেরা কোনধরনের স্টেটমেন্ট দেয়নি এখনও। আমার জানা মতে, ঢাবির শিক্ষকেরা সব আন্দোলনে ন্যায়ের পক্ষে থাকে। অথচ আমাদের শিক্ষকেরা এখন অমেরুদণ্ডী!
ভাবতেও খারাপ লাগছে, এই ঢাবিতই একদিন মুনির চৌধুরীর মত শিক্ষক ছিলেন, যিনি ভাষা আন্দোলনের জন্য জেল খেটেছেন। আর আজ, আমাদের সম্মানিত শিক্ষকেরা সরকারকে তেল দিয়ে যাচ্ছেন সমান তালে!
জগন্নাথ ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। আমার এলাকার ভাই। বললেন, “জগন্নাথ রাস্তায় আছে। তোমরাও লেগে থাকো। তুমি সেইফ থাকিও।“
সর্বশেষ খবর
শোনা যাচ্ছে, আমাদের ভিসি কোটা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন!
জানি না কথাটা কতটা সত্যি। মিথ্যে হলেও আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। আজ, আন্দোলনের এই পর্যায়ে, একজন অমেরুদণ্ডী তেলবাজ ভিসির কোটা সংস্কারের পক্ষে কথা বলায় কিছু যায় আসে না। জাবির ভিসি গতকালই তার ছাত্রদের উপর রাবার বুলেট চালানোর প্রতিবাদ করেছেন। আর আমাদের ভিসি, আমাদের উপর আন্দোলন চালানোর জন্য ছাত্রলীগকে ফোন করেছিল।
সেই ভিসি কোটার পক্ষে থাকলেই বা লাভ কী আমাদের!!!
Update:
ছাত্রলীগের সভাপতি, পোস্ট দিয়েছেন ফেবুতে। লিখেছেন আজ সংসদ টিভিতে শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার নিয়ে কথা বলবেন। সাধারণ সম্পাদকও একই কথা বলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন, সরকারী চাকরিতে কোন কোটা থাকবে না।
এদিকে কোটা আন্দোলন বিরোধী কেন্দ্রীয় কমিটি, প্রধানমন্ত্রীর নিজ মুখ থেকে কিছু না শোনা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি জারি রাখতে সবাইকে আহবান করেছে।
টিএসসিতে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে মিছিল আসছে।
সূর্যসেন হল ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে গিয়ে দুটো জিনিস চোখে পড়ল। ডাকসুতে বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি ডিপার্টমেন্ট এর শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের সাথে দেখা করে তাদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন।
মধুতে এখনও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আছেন অনেকে।
Disaster management and vulnerability studies থেকেও একটা কোটা বিরোধী মিছিল রাজুর সামনে গেল।
আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে এপর্যন্ত কোন বিবৃতি কিংবা মৌখিক সমর্থনও দেয়া হয়নি।
ব্রিটিশ কাউন্সিল unavoidable circumstance(!) এর কারণে আজ দুপুর একটাতেই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে!
আমরা এখন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের অপেক্ষায়।
আপডেট:
সকাল বেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মধুর ক্যান্টিনে প্রেস কনফারেন্স করে বলেছিল, কোন কোটাই আর থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রীর সংসদে দেয়া ভাষণও তাই বলছে।
তার অনেক কথাই মানি, কিন্তু তিনি যেভাবে একচেটিয়া ভাবে আন্দোলনকারীদের সমালোচনা করলেন, তাতে ক্ষুদ্ধই হয়েছি। একবারও তিনি আমাদের উপর পুলিশি আক্রমণের কথা বললেন না, বললেন না ছাত্রলীগের সসস্ত্র প্রতিরোধ আর হামলার কথা। এমনকি চেপে গেলেন রগ কেটে দেয়ার ঘটনাটাও।
তিনি বলেছেন, আমরা তার নাতি নাতনির বয়সী। আমাদের কীসে ভালো হয়, সে নিয়ে তিনিও ভাবেন। তাহলে তিনি এতোদিন এই কোটা সংস্কার করলেন না কেন?
হলের টিভি রুমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনার পর সরাসরি টিএসসি চলে গেলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। আনন্দের ঢেউ বাধ ভেঙে ফেলেছে। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত ক্যাম্পাস। করতালি আর মাঝেমাঝে গান। টিভি চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার করছে পুরো আন্দোলন।
হল থেকে যারা গিয়েছিলাম, তারা আনন্দ রেলি করতে করতেই ফিরে এলাম।
কিন্তু হলে এসেই মেজাজ ঠান্ডা রাখা কষ্টকর হয়ে গেল। দেখলাম, হল গেটে হল ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক দাঁড়িয়ে। তারা আনন্দ রেলি বের করার প্রস্তুতি নিচ্ছে!
কীসের আনন্দ রেলি? যাদের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, যাদের কুপোকাত করতে একের পর এক মিথ্যে কথা ছড়িয়েল, যাদের একজনের রগ কেটে দিয়েছিল, তাদের বিজয়ে এখন ছাত্রলীগ আনন্দ মিছিল করবে?
কী হাস্যকর!
কেটে পড়লাম হল থেকে। ছাত্রলীগের আনন্দ রেলিতে অংশ নিয়ে নিজেকে আর ছোট করতে পারবো না। দরকার হলে হল ছাড়ব, তবুও না।
এই যে গণ আন্দোলনটা হলো, এর ভিলেন হিসেবে থাকবে ছাত্রলীগ। তারা যতই চেষ্টা করুক ঢাকতে পারবে না কৃতকর্ম।
তারপরও আমরা খুশী আজ। জয় বাংলা স্লোগানটা হয়তো বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ শব্দযুগল। এই দুই শব্দ কণ্ঠে যে শক্তি এনে দেয়, তা আর কোন শব্দ পেরেছে বলে জানি না।
এখনও জানি না, আমরা আন্দোলনে সফল হয়েছি কিনা, কিন্তু এই যে এতোটুকু পাওয়া- এটাই আমাদের প্রেরণা যোগাবে বহুকাল।
জয় বাংলা!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১২:৫৭