এই ব্লগটা লেখা আমার জন্য রিস্কি। কারণ আমি হলে থাকি। আমরা, ঢাবির ছাত্ররা যারা হলে থাকি, এই উত্তাল সময়টা কী করে পার করছি, তার একটা চিত্র তুলে ধরাই এ পোস্টের মূল লক্ষ্য।
৮ এপ্রিল, ২০১৮
৮ এপ্রিল বিকেল থেকেই ছাত্রলীগের পোস্টেড বড় ভাইরা হলের গেটে অবস্থান নিয়েছিল, যাতে হলের কেউ বেড়িয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে না পারে। আমাদের হল গেটে বসে থাকা হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আন্দোলনে যেতে চাওয়া এক ছাত্রকে বলেছে, “আন্দোলনে যেতে হলে এক্কেবারে ব্যাগট্যাগ নিয়ে যা। তোর আর হলে থাকা হবে না!”
কিন্তু যারা আগে থেকেই হলের বাইরে ছিল, তারা আর হলে না ফিরে সরাসরি চলে গিয়েছিল আন্দোলনে। যারা থেকে গিয়েছিল, তারা রাগে ফুসছিল নিজের অক্ষমতায়।
এর মধ্যে স্যার এ এফ রহমান হলে হয়ে যায় একটা অসাধারণ ব্যাপার। হলের ছাত্ররা, যারা বেড়িয়ে পরতে পারেনি, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ক্ষেপে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল হলের ভিতরেই। শুনেছি, সভাপতির সাথে হাতাহাতিও হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
৮ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকেই আমরা হলের বাইরে বেরুতে পারিনি। যখন রাত প্রায় ১ টার দিকে খবর পেলাম কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরা হলের দরজা ভেঙে চলে এসেছে আন্দোলনে, তখন আর আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। আমরা সংগঠিত হয়ে হল গেটে যাই। কিন্তু গেটে এসে দেখি, ছাত্রলীগ প্রস্তুত হচ্ছে আন্দোলনে আক্রমণ করার জন্য। তাদের প্রস্তুতি দেখে, আমাদের অনেকেই পিছিয়ে যায়। তার কিছু পরেই ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
আমি যখন ভিসি চত্বরে পৌঁছি, ততোক্ষণে, ভিসির বাড়ি ভাংচুর হয়ে গিয়েছে। ভিসির বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগ। প্রচুর অস্ত্র- লাঠি, রড নিয়ে তারা এসেছে বিভিন্ন হল থেকে। ঢাকা কলেজ থেকে হেলমেড পরে রড নিয়ে এসেছে শতাধিক নেতাকর্মী! এদের দেখে কে বলবে এরা ছাত্র! তখনও পুলিশ এসে পৌঁছেনি। আমি ভেবে পাই না, ভিসি হামলার সাথে সাথেই পুলিশকে না ডেকে ছাত্রলীগকে ডাকলেন কেন! যেখানে সারাটা দিন পুলিশ টহল দিয়েছে ক্যাম্পাসে?
এরপর শুরু হয় ধাওয়া পালটা ধাওয়া। আমার হলের এক বড় ভাই আন্দোলনকারীদের পিটাতে গিয়ে নিজেই পা ভাঙলেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডিএমসিতে।
একটা কথা না বললে, নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকবো। আমাকে ভিসি চত্বরে যেতে হয়েছে ছাত্রলীগের পরিচয়ে। আমরা যারা ১ম বর্ষের, তারা যদি লীগ না করি, তাহলে হলে থাকতে দেয়া হয় না। আমি তাই বাধ্য হয়েই ছাত্রলীগ। আমি ভিসি চত্বরে নাও যেতে পারতাম, কিন্তু কী হচ্ছে বাইরে সেটা দেখার অদম্য ইচ্ছেয় বেড়িয়ে এসেছি। আর আসতে হয়েছে ছাত্রলীগের পিছেই। কারণ ততোক্ষণে আন্দোলনকারীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কে আন্দোলনকারী আর কে লীগার বোঝা যাচ্ছিল না।
সেদিন ৮ এপ্রিল রাত ২ টায়, মানে ৯ এপ্রিল ভোরে, আমি জীবনে প্রথম পুলিশ ছাড়া অন্য কারও হাতে পিস্তল দেখেছি। যার হাতে পিস্তলটা ছিল, সে হেলমেড পরা- চেহারা দেখতে পারিনি। ঢাবির হলগুলোতে এতো এতো অস্ত্র মজুদ আছে, সেদিন নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না কোনদিন।
৯ এপ্রিল, ২০১৮
৯ এপ্রিল ক্যাম্পাস ছিল থমথমে। আমার ক্লাস ছিল সকাল ১০টায়। কিন্তু তার আগেই বর্জন করা হয় ক্লাস।
সকাল ১০টায় ক্যাম্পাসে ঢু মারতে গিয়েছিলাম। ভার্সিটির সব বাস শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট এর সামনে দাঁড়িয়ে। আজ যেন অঘোষিত ধর্মঘট! অনেকেই ক্লাস করতে গিয়ে ফিরে এসেছে। তবে পরীক্ষাগুলো হচ্ছে।
১২ টার দিকে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম ছিল মধুর ক্যান্টিনে। আমাদের প্রথম বর্ষকে তাই মধুতে যেতে হলো। গিয়েই বুঝলাম, আজ কঠিন কিছু হতে যাচ্ছে। মধুতে প্রচন্ড ভীড়। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সহ সভাপতিকে দেখা গেল ব্যস্ত সময় পার করতে।
আমতলায় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি আনু ভাই কথা বলছেন। শুনলাম, তিনি বলছেন, “এই আন্দোলনটা আমাদের করা উচিত ছিল। কিন্তু পারলাম না। কেন্দ্র থেকে সময়মত নির্দেশ পেলে, আমরা আন্দোলনটাকে নিজেদের করতে পারতাম। এখন বিভিন্ন দল এটার ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে।“
সন্ধ্যায় টিএসসিতে গেলাম। আন্দোলন তুংগে। দেখলাম, আমাদের কয়েকজন বড় ভাই লীগের নির্দেশ অমান্য করে আমদোলনে নেমে পড়েছে পুরো দমে। কোন হলই আজ ছাত্রদের আটকে রাখতে পারেনি। সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। এক বন্ধুর কাছে শুনলাম, তাদের নাকি নির্দেশ দিয়েছে বড় ভাইয়েরা আন্দোলনে নামতে। তাছাড়া জহু হলে ছাত্রলীগের সহ সভাপতি নিজেই এই আন্দোলনের একজন মুখপাত্র।
বুঝতে পারলাম, ছাত্রলীগ পড়েছে মহা ফাঁপরে। কারণ, তারা নিজেদের কর্মীর কাছ থেকেই পাচ্ছে না সাপোর্ট। অন্তত ৯০% কর্মী কোটা সংস্কার চায়। যারা চায়, তাদের অনেকেই নেমেছে আন্দোলনে। তারা না পরছে এই আন্দোলনে ‘শিবির' ট্যাগ দিয়ে হামলা করতে, না পারছে উপর মহলের চাপ সহ্য করতে। ক্যাম্পাসে নিজেদের কর্মী স্বল্পতার কারণে, তারা ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ থেকে নিয়ে এসেছে তাদের গুন্ডাপান্ডা।
কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরাও থেমে ছিল না। তারা প্রস্তুত ছিল সব কিছুর জন্য। তারাও যেখান থেকে পারছিল, সংগ্রহ করছিল, নিজেকে বাঁচাবার অস্ত্র।
আমমি প্রথমে একটা গাছের ডাল ভেঙেছিলাম। পরে একটা রড পড়ে থাকতে দেখে, সেটাই তুলে নিয়েছিলাম।
তারপর ওবায়দুল কাদেরের সাথে মিটিং করে কেন্দ্রীয় কমিটি মিটিং করে ফিরে এলে, আন্দোলন আরও উত্তাল হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নারাজ সবাই। এক মাস সময় চেয়েছে সরকার। এই এক মাসে কত জল ঘোলা হতে পারে! এক মাস পর রমজান, ক্যাম্পাস বন্ধ! তখন কোন কারণে সংস্কার না হলে কিংবা দায়সারা সংস্কার হলে আন্দোলন করার জন্য থাকবে কে?
দুইভাগ হয়ে গেল আন্দোলন। তার পরের কাহিনী আপনারা জানেন।
১০ এপ্রিল, ২০১৮
আজকের দিনটা কোটা আন্দোলনের ইতিহাসে একটা গুরত্বপূর্ণ দিন।
সকালে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলন করেছিল বামেরা। তারা কেন্দ্রীয় কমিটির সিন্ধান্ত মানছে না। আজ ডিপার্টমেন্ট থেকে আমরা গিয়েছিলাম রাজুর সামনে। প্লাকার্ড নিয়ে। প্রায় ঘণ্টা দুই থাকার পর ফিরে এসেছি।
সন্ধ্যায় আজ ঘটেছে অতুলনীয় একটি ঘটনা। কোটা আন্দোলনে ভাগ হয়ে যাওয়া দুটি দল এক হয়ে গেছে। মতিয়া চৌধুরীর উপর ক্রেডিট যাবে। তিনি আমাদের সাধারণ ছাত্রদের “রাজাকারের বাচ্চা” বলেছেন। তারই প্রতিবাদে এক হয়ে মিছিলে নেমেছে সবাই। দুদলই।
প্রতিবাদ মিছিলে অন্তত ১০ হাজার ছাত্র ছিল। আমার সৌভাগ্য, সে মিছিলে ছিলাম। মিছিল যখন মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ পেরিয়ে এ এফ রহমান হলের দিকে গেল, দেখলাম, হলের গেটে তালা দেয়া। গটের ওপার থেকে তাকিয়ে আছে ছাত্ররা। তাদের চোখমুখই বলে দিচ্ছে তারা আসতে চায় আন্দোলনে। কিন্তু পারছে না।
সূর্য সেন হলের পাশ দিয়ে মিছিল হচ্ছিল যখন, তখন হলের ভিতরে থাকা ছাত্ররা ভিতর থেকেই চিৎকার করে আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা।
মিছিল টিএসসি এলে, আমি সিগারেট খাওয়ার জন্য সরে যাই। সিগারেট বিক্রেতাটা আমাকে সিগারেট দিয়ে চলে যাচ্ছিল।
জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, এতো তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছো যে? মাল শেষ?”
সিগারেটমামা বললেন, “মামা, কাল রাতে ছাত্রলীগের হাতে যে অস্ত্র দেখছি, তাতে এই আন্দোলনা থাকা সম্ভব না। আমার জীবনডার দাম আছে। আইজ একদিন সগারেট না বিকাইলেও দিন ঠিকই চলব!”
আজ আন্দোলনে ঠিক হয়, যতদিন না মতয়া চৌধুরী তার বক্তব্য ফিরিয়ে নিচ্ছেন, ততোদিন আন্দোলন চলবে। আগামীকাল ১১ তারিখ সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত অহিংস আন্দোলন হবে।
আজ আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে বুঝিয়ে দিয়েছি, আমরা কোন কনফ্লিক্ট চাই না। ছাত্রলীগ কিংবা পুলিশ হামলা না করলে আমরা কোন ঝামেলা ছাড়াই মিছিল, সভা সমাবেশ শেষ করতে পারি। আজ রোকেয়া হল থেকে বেড়িয়ে এসেছিল অন্তত ৫০০ মেয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে।
তারা আমাদের যে সাহসটা দিয়েছে, তার প্রকাশ করতে পারবো না।
আজ তারা যেভাবে বেড়িয়ে আসছে, যেভাবে ঝাপিয়ে পড়ছে, ঠিক সেভাবেই যদি ধর্ষণের বিরুদ্ধেও আসতো প্রতিবাদে, তাহলে আজ দেশ থেকে ধর্ষণ নামের কালো শব্দটা হয়তো লোপ পেত বেমালুম।
১১ এপ্রিল, ২০১৮
রাত ২ টা ৪৬
শুনলাম, সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগারেরা একজন আন্দোলনকারীর রগ কেঁটে দিয়েছে! কী নির্মমতা।
এতোদিন জানতাম, শিবির রগ কাটে। আজ ছাত্রলীগ তাদের মত আচরণ করলো না?
সুফিয়া কামালের সামনে ৩০০ ছেলে অবস্থান নিয়েছে। জানি না কী হবে।
বাংলা ভাষার নিকৃষ্ট গালি “রাজাকার”- সেই গালি আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়। আমাদের একজন আপুর শরীরের রগ কেটে দেয়া হয়। একজনের শরীরে চালানো হয় ২৬ টা রাবার বুলেট। আমাদের গ্রাজুয়েটরা চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করে।
আমাদের কী করা উচিৎ, বলতে পারেন?
এই লেখার ২য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৭