মুভির জন্য ট্রেলার খুব জরুরী। অবশ্যই। অনেক সময় ট্রেলার দেখেই আমরা ঠিক করি, মুভিটা দেখবো কিনা। অন্তত আমার ওয়াচলিস্ট ট্রেলারের উপরই নির্ভর করে। ট্রেলার অবশ্য আমাকে কম ঠকায়নি। কিছু ভালো- ভাল কেন বলছি-অসাধারণ কিছু ট্রেলার আমাকে দিয়ে খুব নিম্ন মানের মুভিও দেখিয়ে নিয়েছে। তবে যাই বলুন, ট্রেলার খুব প্রয়োজনীয়। অত্যন্ত ব্যবসাসফল মুভি ‘টেকেন’ এর কোন ট্রেলার ছিল না। ট্রেলারে গল্পের অনেকটাই বলা হয়ে যাবে, ভেবে, পরিচালক আর সেদিকে যাননি। পরে সেটা তার আফসোসের কারণ হয়েছিল নির্ঘাত। অনেকেই ট্রেলার পাননি বলে মুভিটিই দেখতে যাননি, এমনটা পড়েছি কয়েক জায়গায়!
যাক গে, মুভির ট্রেলার নিয়ে কথা বলতে বসিনি। চাইছি বইয়ের ট্রেলার নিয়ে বলতে। আজকাল সব মুভিরই ট্রেলার হয়। বুক ট্রেলার এর থেকে আলাদা কিছু নয়। ঠিক একই ধরণের ভিডিও- যেটা পাঠককে বইটা পড়তে উদ্বুদ্ধ করে, ঠিক যেমনটা করে থাকে মুভিট্রেলার। বুকট্রেলারে অবশ্য হাইলাইট করা হয় লেখককেই বেশি, কন্টেন্ট এর চেয়ে। পার্থক্য এটুকুই, মুভিট্রেলারের থেকে।
বইয়ের যে ট্রেলার হতে পারে, এমন কোন ধারণাই আমার ছিলনা। ভাবিওনি কোনদিন। আজ ড্যান ব্রাউনের পেইজে তার নতুন বই origin এর ট্রেলার দেখে গুগোল করে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। ভিডিওটা দেখে এটুকু বুঝতে পারলাম, কেন বুক-ট্রেলার জরুরী। কয়েক সেকেন্ডের ভিডিওটা দেখেই কেন জানি মনে হলো, বইটা না পড়লে জীবন বৃথা! আমার মত অনেক নাদান পাঠকেরই নিশ্চয়ই এমন অনুভূতি হয়েছে।
ওয়েস্টার্ন লেখকেরা তাদের বইয়ের প্রচারণার জন্য যতটা পরিশ্রম করেন, তার অর্ধেকও আমাদের দেশের সিনেমাগুলো জন্য করা হয় না বোধহয়। বুকটুর, ক্যাম্পেইন, পত্রিকায় ঝকঝকে বিজ্ঞাপন, প্রচুর সাক্ষাৎকার এবং অধুনা ট্রেলার- কিছুই বাকি রাখেন না। আমার এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, সে নাকি রেডিমেড রিভিউ লিখে গুডরিডসের জন্য- কিছু পাবলিকেশন এজন্য পে করে। ভাবুন!
আমাদের জগতটা ভিজুয়াল হয়ে গিয়েছে অনেকটা। আমরা যত না পড়ি, দেখি তার চেয়ে বেশি। এই যে আমি লিখছি, এটা খুব বেশি হলে ১০০ বার পঠিত হবে। কিন্তু ঠিক একই বিষয়ে কোন ভিডিও তৈরি করতে পারলে, হয়তো আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হতো। আসল কথা তো মানুষের কাছে ধারণাটা পৌঁছানো। মাধ্যম কোন ব্যাপার নয়। ট্রেলার জিনিসটা একারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুব ভাল মানের একটা রিভিউ যত না পাঠক টানতে পারবে, তার চাইতে অনেক বেশি পাঠককে হয়তো আকৃষ্ট করা যাবে এই ট্রেলার দিয়েই। অবশ্যই, রিভিউয়ের বিকল্প ট্রেলার নয়।
Rye Barcott নামের এক লেখকের নিবন্ধে পড়লাম, তার বইয়ের ট্রেলারের জন্য নাকি প্রোডিউসারেরা ৫০০০-১০০০০ ডলার দাবি করেছিল! যথেষ্ট বেশি খরচ বলে, তিনি নিজেই বানিয়েছিলেন একটা ভিডিও। আমাদের দেশেও এখন প্রচুর ভিডিও তৈরি করা হচ্ছে। মনে হয় না সেসবে খুব বেশি খরচ হয়।
আমাদের, বাংলা সাহিত্যের পাঠকের সংখ্যা খুব কম। তাদের তুলনায়। আবার ফেলে দেয়ার মতও নয় সংখ্যাটা। হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়ে দিয়েছেন, শুধু লেখালেখি করেও এদেশে সব কিছু করা সম্ভব। যেটা দরকার, সেটা হলো, পাঠকের কাছে পৌছনো। প্রচারণাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর এজন্য ট্রেলার একটা খুব ভালো মাধ্যম হতে পারে। ব্যস্ততার কারণে হয়তো আমি ৩০০ শব্দের কোন রিভিউ নাও পড়তে পারি, কিন্তু ৩০ সেকেন্ড এর একটা ভিডিও? দেখাই যায়!
তবে বইয়ের প্রচারণা হিসেবে ট্রেলার- এটায় গাইগুই করার মত ব্যাপারও আছে। একটা ১৫০ পৃষ্ঠার বইকে কি একটা ভিডিও ৩০ সেকেন্ডে রিপ্রেজেন্ট করতে পারবে? সম্ভব কি সব বইয়ের ট্রেলার বানানো?
না। একটা ৩০ সেক এর ট্রেলার পুরা বইকে কোনদিন রিপ্রেজেন্ট করতে পারবে ন পুরোপুরি। দরকারও নেই এর। মুভির ট্রেলারগুলো কি মুভির পুরোটা তুলে ধরতে পারে? ট্রেলারে শুধু দেখানো হবে, বইটা কেন গুরুত্বপূর্ণ- কী কী বিষয় আছে এতে, সেটার কৌতূহলোদ্দীপক অধ্যায়গুলো কী ইত্যাদি। আর এসব করা হবে একটা আকর্ষণীয় পন্থায়- যেন ভিডিওটা দেখা শেষে, পাঠকের বা ভিউয়ারের মনে বইটা পড়ার একটা স্পৃহা তৈরি হয়। কাজটা সহজ নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু সম্ভব।
আর, হ্যাঁ, সব ধরণের বইয়ের জন্যই ট্রেলার বানানো যেতে পারে। কবিতা থেকে শুরু করে গুরুগম্ভীর শব্দওয়ালা উত্তরাধুনিক গল্পের জন্য পর্যন্ত। তবে ভিডিওর ধরণ আলাদা হতে বাধ্য। চোখ ট্যারা করিয়ে দেয়া কোন থ্রিলারের ট্রেলার আর ঘানিটানা নগরজীবনের গল্পের ট্রেলার আলাদা হবে- এতে আর আশ্চর্যের কী? পশ্চিমারা সব ধরণের বইয়ের জন্যই ট্রেলার বানাচ্ছে- লক্ষ্য একটাই- বইয়ের বিক্রি বাড়ানো। ওরা পারলে আমরা পারবো না?
একজন লেখক একটা বই লেখার জন্য কতকিছুই তো করেন। অনেক নির্ঘুম রাত, অনেক অফিসচুরি; আমপ্রতিবেশীর/বন্ধুর ট্যারাকথা; আর অনেক পরিশ্রমের ফসল একটা বই। এই মূল্যবান জিনিসটার প্রচুর প্রচার জরুরী। আর এজন্য ট্রেলার তৈরি করে দেখা যেতেই পারে। ব্যর্থ হলে ক্ষতি নেই- নতুন কিছু করার থ্রিলটা লেখকেরা অন্তত বই প্রকাশের আনন্দের সাথে সাথে পাবেন!
28/6/2017
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৭ সকাল ১১:৫১