মশা কামড়ালে সহ্য করা যায় তবুও- ঘুমালে তো টেরই পাই না। কিন্তু মশা যখন কানের কাছে ভোঁভোঁ করে তখন, সেটাকে না মারা পর্যন্ত শান্তি নেই। ব্যাটারা এতো বজ্জাত যে, কানের কাছে একটু ‘পো’ করেই হাওয়া। টর্চ লাগিয়েও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনভাবে মশারীর ভিতরে ঢুকলে তো কথাই নেই- ঘুমানো তো দূরে থাক, কিছু চিন্তা পর্যন্ত করার অবকাশ পাওয়া যায় না। পুরো কনসেনট্রেসনটা মশার ভোঁভোঁতে স্থানান্তর হয়ে যায়।
কাল সারারাত একটা মশা আমার কানের চারপাশে ভোঁভোঁ করতে করতে চক্কর মেরেছে। রীতিমত ২ ঘণ্টা ধরে মারার চেষ্টা করেছি। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুসও আমার জায়গায় থাকলে হাল ছেড়ে দিতেন- এতোবার চেষ্টা করতেন না নির্ঘাত। কিন্তু শেষমেশ সব চেষ্টাই বিফলে গিয়েছে। শেষে ভোঁভোঁ থেকে বাঁচতে ইয়ারফোনে ফুল সাউন্ড দিয়ে গান শুনতে হয়েছে।
আমাকে কে যেন বলেছিল, মশার যখন যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, তখন সেটা ভোঁভোঁ করে। তথ্যটার সত্যতা নিয়ে আমি মাথায় ঘামাইনি, বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম। তাই কাল রাতে, “শালার মশার যৌন উত্তেজনা কি এতো বেশি যে, এর তাড়নায় সারারাত তারপাচ্ছে!” ভাবতে আমার বাঁধেনি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে এই থিয়োরি বলেছিলামও একজনকে। শোনার পর সে ঝারি মেরে বলেছিল, “কচু জানো!”
কচু জানার অপবাদ থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো গুগোল করেছি সকালে। গুগোলই আমার একমাত্র বন্ধু যে সব কথার জবাব দেয় বিরক্ত না হয়ে। আমারও তাকে জিজ্ঞেস করতে বাঁধে না। ‘জেসি আইসেনবার্গ এতো স্পিডে কেন কথা বলে’ থেকে শুরু করে ‘কী করলে প্রতিদিন গোসলের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়’ পর্যন্ত সব জিজ্ঞেস করি। হলফ করে বলতে পারি, গুগোল আমাকে যতকিছু শিখিয়েছে, কোন শিক্ষকই ততোটা শেখাতে পারেনি এতোবছরেও।
যাক গে, বলছিলাম মশার ভনভনের কথা। গুগোল করে যা জানলাম, সেটাই বলছি এখন।–
আমাদের বিরক্ত করার জন্য, কিংবা ঘুমের ডিস্টার্ব করার জন্য মশা ভোঁভোঁ করে না। ভোঁভোঁ করে কারণ, ভোঁভোঁ না করে তারা থাকতে পারে না। তারা যখন উড়তে শুরু করে, আপনা থেকেই তাদের ডানায় শব্দ সৃষ্টি হয়। মশার ডানাগুলো খুব-খুব-খুব ছোট। বাতাস কেটে উড়তে তাই একটা মশাকে সেকেন্ডে ৩০০ থেকে ৪০০ বার ডানা ঝাঁপটাতে হয়! তবে বাতাসে ডানা-সঞ্চালনের কারণে শব্দ সৃষ্টি হয়, এমনটা নয়। ওড়ার সময় মশার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে ডানার সংঘর্ষ ঘটে- এতেই সেই বিরক্তিকর শব্দের উৎপত্তি ঘটে।
মশারা সাম্যবাদী- নারীপুরুষ বৈষম্য নেই তাদের মধ্যে। নারী মশা হোক পুরুষ- তারা উড়লে শব্দ সৃষ্টি করবেই। তবে তাদের একটা দিক মানব জাতির সাথে মিলে যায়। মানবদের মধ্যে নারীরা যেমন বেশি চিল্লানোর সক্ষমতা রাখে, মশাদের ক্ষেত্রেও তাই। নারী মশারা পুরুষ মশার চাইতে অনেক বেশি শব্দ সৃষ্টি করে।
অবশ্য পুরুষ মশার শব্দ আমরা শুনতে পারি না, তারা আস্তে শব্দ সৃষ্টি করে বলে নয়। পুরুষ মশা রক্ত খায় না। আমাদের রক্তের বদলে ময়লা আবর্জনাতেই তারা টেস্ট পায় বেশি। ফলত তারা থাকে আমাদের নাগালের বাইরে। তাই তাদের সৃষ্ট শব্দ আমরা শুনতে পাই না।
-মশা উড়লেই যদি শব্দের উৎপত্তি হয়, তবে সবসময় আমরা মশার ভ্যানভ্যানানি শুনি না কেন?
-শুনি না কারণ শব্দ উৎপন্ন হলেই সেগুলো আমরা শুনবো এর কোন মানে নেই। আমাদের শ্রাব্যতার সীমার মধ্যে থাকলে তবে আমরা শুনতে পাবো। না হলে, পাবো না। যখন মশার ভোঁভোঁ আমরা শুনি না, তখন মশাটা শ্রাব্যতার সীমার নিচে শব্দ সৃষ্টি করে।
মশার ভনভনানির আরেকটা দিক হলো, এর মাধ্যমেই মশারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কয়েকজন বিজ্ঞানী নাকি গবেষণা করে দেখেছেন, যখন কোন স্ত্রী মশা শব্দ না করে চুপচাপ বসে থাকে, তখন কোন পুরুষ মশা তার দিকে আকৃষ্ট হয় না সঙ্গমের জন্য। আবার সে মশাটাই যখন পোপো করে গান ধরে, তখন সেই সুরে মুগ্ধ হয়ে পুরুষ মশারা আকৃষ্ট হয় তার দিকে। এই ব্যাপারটাকেই বোধহয় শাস্ত্রীয়সঙ্গীত বোদ্ধারা বলে থাকেন, “সুর-সঙ্গম”!
মশার অবশ্য কান নেই। ওদের এন্টেনায় একটা শ্রবণ অঙ্গ আছে, এর মাধ্যমেই তারা শুনতে পায়।
একটা ধারণা আমাদের মধ্যে প্রচলিত যে, শব্দ করলে মশারা কামড়ায় না। ধারণাটা সত্য। সত্য ততক্ষণ, যতক্ষণ না তারা আপনার শরীরে ল্যান্ড করছে। আপনার শরীরে ল্যান্ড করার সাথে সাথে মশাটার পাখার ঝটপটানি বন্ধ হয়ে যাবে, ফলে আর শব্দ হবে না। দেখা যাচ্ছে, গান গাওয়া অবস্থায় কোন মশা আপনাকে কামড়াচ্ছে না। আবার যখন কামড়াচ্ছে, তখন গান গাচ্ছে না। সুতরাং কেউ যদি বলে, মশা শব্দ করা অবস্থা কামড়ায় না, তাকে আপনি ভুল বলতে পারেন না।
মশার ভনভনানি সম্পর্কে গিয়ে, মশা সম্পর্কিত আরও বিভিন্ন তথ্য জানতে পারা গেল। সবচেয়ে বিস্ময়কর ও চমকপ্রদ তথ্যগুলো জানা হলো মশার কয়েল সম্পর্কে। সেটা নিয়ে একটু বলি।
সুস্থ সুন্দর পরিবেশে মশা জন্ম গ্রহণ করতে পারে না। মশার জন্মস্থল হলো, অচল বদ্ধ পানি। যেকোন বন্ধ পানির উৎসই মশার ডিম ফোটার অনুকূল পরিবেশ হতে পারে। যেমনঃ ফুলের টবে জমে থাকার পানি, ড্রেনের জমে থাকা ময়লা পানি, পলিথিনে জমে থাকা পানি, বন্ধ জলাশয়, কৌটায় জমে থাকা পানি ইত্যাদি। এসব আমাদের দেশে যত্রতত্র দেখতে পাওয়া যায়। দেশের জনসংখ্যা খুব বেশি বলে, এসব নজরে আসার পরও আমরা বা আমাদের সরকার কোন স্থায়ী সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছি/পারছে না। ফলাফল, মশার অত্যাচার। কোনকোন জায়গায় মশার অত্যাচার এতো বেশি যে দিনের বেলাতেও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসা যায় না।
মশার হাত থেকে বাঁচতে ৩য় বিশ্বের আর সব দেশের মত, আমাদের দেশের মানুষেরাও ব্যবহার করছে কয়েল। ব্যবহার না করে উপায় নেই, সারাদিন তো আর মশারীর ভিতরে ঢুকে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু যে কোয়েলটা আমরা ব্যবহার করছি, সেটা কি নিরাপদ?
Chest Research Foundation এর ডিরেক্টর সন্দীপ সালভি মশার কয়েলের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বলেছেন, “Not many people know about it, but the damage done to your lungs by one mosquito coil is equivalent to the damage done by 100 cigarettes”
[ব্যাপারটা সম্পর্কে খুব বেশি মানুষ অবগত নয়। কিন্তু একটা মশার কয়েল আপনার ফুসফুসের ততটাই ক্ষতি করে, যতোটা করে ১০০ টা সিগারেট]
Tiwanese institution of medicine এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, তাইওয়ানে যতজন ফুসফুস ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের ৫০% লোকই ধুমপান করত না। ধারণা করা হয়, সেই ৫০% লোকের ক্যানসারের কারণ কোয়েলের ধোঁয়া!
বিস্তারিত পড়ুন- Click This Link
https://www.worldofchemicals.com/28/chemistry-articles/an-unhealthy-sleep-how-safe-are-mosquito-coils.html
এখন প্রশ্ন হলো, কয়েলের এতো ক্ষতিকর দিক জেনে লাভ কী! দিনশেষে তো মশার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আবার কয়েলের কাছেই আশ্রয় নিতে হবে!
আসলে মশার হাত থেকে বাঁচতে খুব বেশি পরিশ্রমের দরকার হয় না। সামান্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলেই এনাফ। আগেই বলেছি, মশা বদ্ধ জলাশয় ছাড়া বাচ্চা ফোটাতে পারে না। আপনি যদি আপনার চারপাশে পানি জমতেই না দেন, তবে এতো মশা পয়দা হবে কোথা থেকে? গোটা দেশ আপনাকে পরিষ্কার করতে হবে না। শুধু নিজের বাড়ি আর তার আশপাশটা পরিষ্কার রাখলেই এনাফ। মশা আলোকিত স্থানে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ। তাই বাড়ির জানালাগুলো দিনের বেলা খোলা রাখুন। দেখবেন মশার হাত থেকে দিনে অন্তত রক্ষা পাচ্ছেন। রাতে ঘুমানোর সময় মশারী খাটানোর চেষ্টা করুন, কয়েলের বদলে। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না, কয়েলের ধোঁয়া সারারাত ধরে আপনার ফুসফুসে ঢুকে সেটার বারোটা বাজাক!
মনে রাখবেন, মশার কামড়ে আপনার বড়জোর ডেঙ্গিজ্বর বা ম্যালেরিয়া হতে পারে। কিন্তু সেই ম্যালেরিয়া বা জ্বরের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে কয়েলের আশ্রয় নিলে আপনার ক্যানসার পর্যন্ত হওয়ার প্রব্যাবলিটি আছে। ডেঙ্গি জ্বরের চিকিৎসা আছে, ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধ প্রতিকার দুটোই আছে। কিন্তু ক্যানসার হলে?
সুতরাং কয়েল ব্যবহার বন্ধ করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১:৪৩