এক জিগরি বন্ধুর পাল্লায় পড়ে, তার জন্য বিভিন্ন সাইটের আর্টিকেল লিখতে হয়েছিল আমাকে। এমন সব বিষয় নিয়ে লিখতে হয়েছিল যেসবের নাম পর্যন্ত শুনিনি, দেখা তো দূরে থাক। তাদের মধ্যে একটি বেবিস্ট্রোলার। এ জিনিস মুভিতেই দেখেছি শুধু- দেখতাম, মা তার বাচ্চাকে একটা চাকা লাগানো চেয়ারের মত কিছুতে বসিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে- শপিং’এ যাচ্ছে, একাজ সেকাজ করছে। শুধু শিশুটির দেখাশুনার কাজেই মাকে আর আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে না। শিশুটিকে সাথে নিয়ে করতে পারছে নিত্যদিনের কাজ। এদিকে আমার মা আমাকে কোলে করেই মানুষ করেছেন, শুনেছি। আমার বেবি স্ট্রোলার ছিলেন বুয়া- সেই আমাকে কোলে করে এবাড়ি ওবাড়ি করে বেড়াত।
আর আমিই কিনা লিখলাম ‘বেবিস্ট্রোলারের’ রিভিউ!
সেই বেবিস্ট্রোলারের কত কত ‘ভ্যারাইটি’, কত কত স্টাইল। আমব্রেলা স্ট্রোলার, জগিং স্ট্রোলার, ডাবল স্ট্রোলার, ট্রাভেল স্ট্রোলার ইত্যাদি ইত্যাদি। শিশুদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাল্টে যায় সেসবের সাইজ, স্টাইল, সুবিধা। শুনেছি রিমোট কন্ট্রোল ‘বেবি স্ট্রোলারও’ আসছে বাজারে। কর্মব্যস্ত মায়েদের জন্য এ এক আশির্বাদ। কিছু ‘বেবি স্ট্রোলার’ এতো বেশি সুবিধা দেয় যে, চাইলে বাচ্চাকে নিয়ে এভারেস্টও জয় করা যেতে পারে অনায়াসে।
আমেরিকানেরা নিজেদের কাজ নিয়ে খুব বেশিই ব্যস্ত থাকে বুঝি। এতোটা ব্যস্ত যে বাড়ির কার্পেট পর্যন্ত নিজের হাতে পরিষ্কার করে না। কার্পেট পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য সেদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে। তারা সপ্তাহে কিংবা মাসে একদিন শতশত ডলারের বিনিময়ে এসে কার্পেট পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। আমি এই ‘কার্পেট ক্লিনিং’ নিয়েও লিখেছি বিস্তর। লিখেছি ফিডার, ‘ডায়পার’- এমনকি ‘সেক্সটয়ের’ও রিভিউ। আমার নিজের চুলে গত পাঁচ বছরে একবারও চিরুনির দাঁত লাগতে দেইনি। ইচ্ছে করেই। সবসময় এলোমেলো থাকে। কিন্তু গুগোল ঘেঁটে, বিভিন্ন সাইটের আর্টিকেল পড়ে ‘হেয়ারকেয়ার’ নিয়ে আর্টিকেল লিখতে একটুও প্রবলেম হয়নি।
মাছের তেলেই তো মাছ ভেজেছি, এ আর কী এমন কঠিন কাজ।
এসব লিখতে গিয়ে দুটো জিনিস শিখেছি ভাল করে। প্রথমটা হলো, অনলাইনের সব সাইটকে বিশ্বাস করতে নেই। এমনকি অনেকক্ষেত্রে উইকিপিডিয়াকেও না। কারণ হেঁজিপেঁজি সাইটগুলোয় আমার মত বিশেষ অজ্ঞরাও বিশেষজ্ঞ সেজে ক্যানসারের অবধি পথ্য বাতলে দিতে দ্বিধা করে না। আর উইকিপিডিয়া তো সবার জন্য উন্মুক্ত। যেকেউ গিয়ে যেকোন প্রবন্ধ এডিট করে আসতে পারে ইচ্ছামতো।
আর ২য়টি হলো, কপিরাইটের প্রতি শ্রদ্ধা। যে বন্ধু কাজটা দিয়েছিল, সে জানত, সেসব ব্যাপারে আমার জ্ঞান শূন্যেরও নিচে, ঋণাত্মকের ঘরে। সেই বলেছিল গুগোলের সাহায্য নিতে- দেদারছে। কিন্তু সাথে ল্যাজুর জুড়ে দেয়ার মত করে বলেছিল, “খবর্দার কপি করবি না। আর্টিকেল সেন্ট পার্সেন্ট ইউনিক হওয়া চাই। একটা লাইন কপি করলেও ধরা খেয়ে যাবি। বিভিন্ন সাইটের লেখা পড়বি কিন্তু লিখবি নিজের ভাষায়।”
সেই প্রথম আমি plagiarism শব্দটার সাথে পরিচিত হই। বন্ধুটির কাছ থেকেই। যার সহজ সরল অর্থ ‘চুরি’। কিন্তু ব্যাপারটা এতো সহজ সরল নয়। Plagiarism.org এর মতে, কোন আইডিয়া চুরি করা কিংবা চুরি করে ব্যবহার করা; বৃহৎ লেখার কোন অংশ লেখকের অনুমতি না নিয়ে প্রকাশ করা বা প্রকাশ করে নিজের বলে চালিয়ে দেয়া; কপিরাইট ওয়ালা কোন বইয়ের কোন পৃষ্ঠার ছবি তোলা বা ফটোকপি করা অথবা লেখার কোন অংশ বা পুরোটা অনুবাদ করা; কোন ব্যক্তি’র অনুমতি না নিয়ে তার সম্পর্কে বই লেখা, সিনেমা অথবা ডুকুমেন্টারি তৈরি করা (মৃত হলে, পরিবারের কাছে অনুমতি না নিয়ে এসব করা); কোন লেখকের কোন বাক্য ধার করে শব্দ পরিবর্তন করা বা বাক্যের গঠন পরিবর্তন করা; কোন উদ্ধৃতি সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রদান করা; কোন ওয়েবসাইটের ছবি নিজের ওয়েবসাইট বা অন্য ওয়েবসাইটে ব্যবহার করা ইত্যাদি plagiarism এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কপিরাইট ভঙ্গ করাই হচ্ছে plagiarism। এ এক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আজ এই plagiarism, ‘পাইরেসি’- সোজা বাংলায় চুরিচামারি নিয়েই কথা বলবো। হয়তো প্রসঙ্গত চলে আসবে সমসাময়িক কিংবা অন্যান্য বিষয়াবলী।
বই নিষিদ্ধ করা, কিংবা বইয়ের কেনাবেচা বন্ধ করে দেয়াটা একধরণের মূর্খতা। এসব সাময়িক বাঁধার সৃষ্টি করে বটে কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতার পথ আটকাতে পারে না কোনভাবেই। আমাদের দেশে একজন সর্বজন স্বীকৃত বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা। তিনি বেশ আলোচিত- কখনো কখনো বিতর্কিতও। কিন্তু তার রচনা, তার সাক্ষাৎকার পড়ে যতটুকু বুঝেছি, জেনেছি, তাতে তাকে স্রেফ ভ্রষ্ট বুদ্ধির সাম্প্রদায়িক মানুষই মনে হয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের বই এদেশে প্রকাশ বন্ধ করার পেছনে তার হাত ছিল সবচেয়ে বেশি।
৪৭ এ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর, ঢাকায় আলাদা একটা সাহিত্য গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে ঢাকাই প্রকাশনা শিল্প। প্রকাশিত হতে থাকে তরুণ লেখকদের অজস্র বই- কবিতা, গল্প, নাটক। শামসুর রাহমান হয়তো ঢাকাই প্রকাশকদের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।
দেশভাগের আগে পুব বাঙলার পাঠকদের মনের খোরাক মেটাত কোলকাতা হতে প্রকাশিত বইগুলিই। দেশভাগের পরও বাঙালি পাঠকদের কোলকাতার বইয়ের প্রতি ভালবাসা কিংবা টান কমে যায়নি। যাওয়ার কথাও নয়। সুন্দর প্রচ্ছদ, ভাল বাঁধাই- আর সবচেয়ে বড় কথা ভাল মানের বই- পাঠক আচমকা সে বই পড়া ছেড়ে দেবে কেন? আমাদের লেখক সমাজও সেসময় হাপিত্যেশ করে বসে থাকত কোলকাতার বইয়ের জন্য। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে বই আসা বন্ধ হলো। কিন্তু চোরা পথে বই আসা বন্ধ হয়নি। একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের পর আবার মুক্ত করা হয় কোলকাতার বই এদেশের বাজারে। এদেশের লেখকদের সাথে সাথে বইয়ের দোকানগুলোয় জায়গা করে নেয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রকাশনীর বই। সেসব বইয়ের পাঠক তৈরিই ছিল এদেশে- পাঠকেরা সেসব বই লুফে নিতে দ্বিধা করেনি একটুও।
এই জায়গায় লেগেছে গেরোটা। আমাদের সাহিত্যিকেরা দেখলেন, তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না তাদের সাথে। তাদের লেখা বইয়ের চাইতে মানুষ পশ্মিমবঙ্গের লেখকদের বই পড়ছেন অধিক। হারিয়ে যাচ্ছেন তারা। নিজেদের বইয়ের বাজারে টিকিয়ে রাখার প্রবল ইচ্ছাই জন্ম দিল ক্ষোভের। এই ক্ষোভকেই আন্দোলনে রুপান্তরিত করলেন আহমদ ছফা। ক্ষোভটা এখনও লক্ষ করা যায় বিভিন্ন লেখকের কর্মকান্ডে। (নাম উল্লেখ করে তাদের আর হাইলাইট করতে চাই না। তারা এসব করে স্টান্টবাজি হিসেবে- এক আধটু আলোচিত হওয়ার জন্য) আহমদ ছফা ১৯৯৪ সাল থেকে এদেশে পশ্মিম বঙ্গের লেখকদের বই প্রকাশের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগানো শুরু করলেন। তার ও আর কিছু সাহিত্যিকের কর্মতৎপরতায় ১৯৯৮ সাল থেকে বন্ধ হলো কোলকাতা’র বইয়ের একুশে বইমেলায় প্রকাশ।
সাহিত্য অথবা শিল্প কোন প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। সাহিত্য মান ও উৎকর্ষতাই মুখ্য। বই বিক্রির হিসেবে কিংবা জনপ্রিয়তায় বিচার হয়না কিছুই। তাই যদি হয় তাহলে ড্যান ব্রাউন কিংবা সিডনি শেলডনই বিশ্বসেরা লেখক। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের মত অনেকেই শুনেছি একসময় তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। এখন তাদের নাম কেউ মুখেও নেয় না। এর বহুবিধ কারণের একটা হলো, সেসব সাহিত্য সুপাঠ্য হলেও মানহীন- একটা নির্দিষ্ট সময় পর তারা আবেদন হারিয়েছে পাঠকের কাছে। আমাদের সাহিত্যিকেরা এই সামান্য জিনিসটি বুঝতে পারেননি। বই বিক্রির তাগিদে, আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছনোর নেশায় কোলকাতার প্রকাশনীর বই এদেশে আমদানি নিষিদ্ধ হলে, কোন লেখকের কাছ থেকে তাই কোনরূপ প্রতিবাদ আসেনি। তারা যে একজন পাঠকের অধিকারে হাত দিয়েছে সে ব্যাপারেও একবার নজর দেয়নি। ভাবেনি। হয়তো ভাবার মত মানসিক শক্তি তাদের নেই।
৯৮ সালে কোলকাতার বই নিষিদ্ধ হওয়ার আগে বাংলাদেশের লেখকদের বই যে বিক্রি হয়নি তা তো নয়। হুমায়ূন আহমেদ তার অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয়। কাজী আনোয়ার হোসেন জনপ্রিয় ‘ধ্বংস পাহাড়’ থেকেই। কোলকাতার বই নিষিদ্ধের পিছনে আহমদ ছফার প্রথম ও প্রধান যুক্তিটি ছিল, পাঠকেরা বাংলাদেশী সাহিত্যিকদের বই না কিনে পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের বই কিনছে। তার এই খোরা যুক্তির সবচেয়ে বড় উত্তর হুমায়ূন আহমেদ, কাজী আনোয়ার হোসেন ও ইমদাদুল হক মিলন।
আসলে ‘পপুলার ফিকশন’ বলে একটা টার্ম আছে- যার ধর্ম সাধারণ পাঠককে আকর্ষণ করা। সে সাহিত্য কাহিনী নির্ভর, চমকপ্রদ ও স্টান্টবাজ। যে পাঠকেরা হুমড়ি খেয়ে পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের দিকে ঝুঁকে গিয়েছিল, তাদের পনেরো আনাই ‘পপুলার ফিকশন’ খোর। তারা যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য পড়েছে, তেমনি পড়েছে হুমায়ূন আহমেদকে। কিন্তু ভুল করেও এক্সপেরিমেন্টাল কিছুতে হাত দেয়নি। স্বভাবতই, পপুলার ফিকশনের বাইরের বইয়ের বিক্রি বাড়েনি- আগেও শতকরা আড়াইজন পাঠক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সন্দীপন কিনত, এখনও তাই কেনে।
আহমদ ছফা উদাহরণ হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে শওকত ওসমানের বই বিক্রির তুলনা করে দেখিয়েছিলেন- সুনীলের বই শওকত ওসমানের চাইতে অনেক বেশি বিক্রি হয়/ হতো। ‘মৌলবি’ আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে হয়তো জিজ্ঞেস করতাম, “কোলকাতার বই নিষিদ্ধের পর শওকত ওসমান কি তবে বেস্ট সেলার হয়ে গিয়েছিলেন? তার বই কি লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল?”
সে নতিজা তো দেখা যাচ্ছে না।
বইয়ের আমদানি বন্ধ করে তারা পাঠকের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছেন মাত্র। পাঠক কোলকাতার, বটতলার, আমেরিকার, ঢাকার যে কোন স্থানের বই পড়ে মানসিক চাহিদা মেটাতে পারে- সে একান্ত তার ব্যাপার। পাঠকের চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের লেখকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়নি। কোন ভূখণ্ডের লেখকের দ্বারা সম্ভবও নয় সে দায়িত্ব নেয়া।
প্রকাশকের দিকটা এখানে উঠে আসতে পারে। বলা হতে পারে, তারা মার খেয়ে যাচ্ছে, ব্যবসা হচ্ছে না। এসব লেইম যুক্তি। প্রকাশকেরা প্রচার ভাল ভাবে করলে, বই-প্রকাশেচ্ছু লেখকের পকেট না দেখে পাঠকের পকেটের দিকে নজর দিলে এসমস্যা হত না।
বই আমদানি বন্ধের ফলে অপর যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা হলো পাইরেসি। কিছু প্রকাশক দেদারছে ওপার বাঙলার বই নিজের মনে করে ছেপে চলেছেন। সে বইয়ের পৃষ্ঠার মান খারাপ, প্রচ্ছদ ও বাঁধাই নিম্নমানের; দাম কম। এর ফলে বাঙালি পাঠকেরা লেখকের পেটে লাথি মেরে সেসব বইই কিনছেন বেশি, দাম হাতের নাগালে বলে। এতে দেশিও প্রকাশনা শিল্প তো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেই- বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পেশাদার লেখকেরা। সবাই তো আর শখের বসে সাহিত্য রচনা করে না। নেশাকে পেশা হিসেবে নেয় অনেকে- তাদের পেট শুকচ্ছে। কোলকাতার বই এদেশে প্রকাশের অনুমতি থাকলে হয়তো কমত এই পাইরেসি। পাঠকেরা অন্তত পাইরেটেড বইয়ের বিকল্প পেত খুঁজে- এখন তো সে উপায়ও নেই।
এসব ব্যাপারে কাউকে নজর দিতে দেখা যায় না। মাঝেসাঝে প্রতিবাদ হলেও কার্যকর কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। অবশ্য আমাদের নামীদামী প্রকাশকেরাও চুরি চামারি করতে অভ্যস্ত। কিছুদিন আগে মার্কিন থ্রিলার লেখক নিক পিরগ এক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, তার যেসব বইয়ের বাংলা অনুবাদ আমাদের একুশে বইমেলায় এসেছে (3 am, 3.10 am, 3.21 am, 3.46 am), তার একটির জন্যও অনুমতি নেয়নি ‘বাতিঘর’। বাতিঘর অনেক অনেক অনুবাদ প্রকাশ করে, এখন তো সন্দেহ হয় তারা হয়তো কোনটার জন্যই অনুমতি নেয় না।
বই পাইরেসিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন রিটন খান- আমার বই ডট কমের অ্যাডমিন। তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে খ্যাত অখ্যাত সব লেখকের বই স্ক্যান করে পিডিএফ বানিয়ে আপলোড করছেন নিজের সাইটে। লেখকের বা প্রকাশকের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। তার সাইটের বদৌলতে এপারের ওপারের যেকোন লেখকের বই পাচ্ছেন বিনামূল্যে। তবে আপনি আর টাকা দিয়ে বই কিনবেন কেন? শুধু আমার বই ডট কম নয়, এমন বেশ কয়েকটি সাইট আছে যারা বিনামূল্যে ইবুক দিয়ে যাচ্ছে। ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়......” সুতরাং এসব সাইটও ‘আমার বইয়ের’ মত কপি রাইটের তোয়াক্কা করছে না।
আমাদের সাহিত্যে ঈদ সংখ্যা, পূজা সংখ্যা- এসব উৎসব ভিত্তিক সংকলনগুলোর একটা বিশেষ মর্যাদা আছে। সাধারণত এই সংখ্যাগুলোয় প্রকাশিত লেখাগুলো সেবছর বই আঁকারে প্রকাশিত হয়। রিটন খান সাহেবের বদৌলতে আপনি সেই ঈদ বা পূজা সংখ্যাগুলোকেও পাচ্ছেন বিনামূল্যে, মাত্র কয়েক এমবি খরচ করে!
আর তবে টাকা দিয়ে বই বা পত্রিকা কেনা কেন?
ভাগ্যিস দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণ আছে। নাহলে হয়তো এতদিনে দেখতাম, তারা প্রতিদিন পত্রিকাগুলোও স্ক্যান করে আপ করা শুরু করে দিয়েছে!
পিডিএফের মাধ্যমে আপনি বইগুলো পাচ্ছেন বটে পড়ার জন্য, হয়তো সেসব আপনার চিন্তাধারাকেও করছে উন্নত- কিন্তু সবই হচ্ছে পাইরেসির মাধ্যমে; লেখকের মেধার মূল্য না দিয়ে। লেখক-প্রকাশক বইটা পকেটের টাকা খরচ করে ছেপেছেন, আপনি সেটা পাবেন নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে। অন্যথা হলে, আপনি চুরি করছেন। এখানে বইয়ের দামের কথা উঠতে পারে। সত্যি বলতে, এ এক অজুহাত। এক জিবি ইন্টারনেটের দাম এখন ৯৪ টাকা, গোল্ডলিফের একটা শলাকার দাম ৮ টাকা- সে হিসেবে একশ পৃষ্ঠার একটা বইয়ের দাম ১৫০ টাকা হওয়া খুব বেশি কি? তারপরও দামে না কুলালে পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়তে পারেন। আপনাকে তো বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে না।
একটা পরিসখ্যানে* দেখা গেছে, ৪৪.৬% জার্মান সপ্তাহে অন্তত একটা বই পড়ে। আর ৫৮.৩% জার্মান অন্তত একটা বই কিনে থাকে। তাহলে তারা সপ্তাহে একটা করে বই পড়ে কোথা থেকে? উত্তরটা হলো লাইব্রেরী। উইকিপিডিয়া বলছে জার্মানিতে পাবলিক লাইব্রেরীই আছে ৬৩১৩টি! স্কুলের, কলেজের লাইব্রেরী, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাইব্রেরী তো আছেই। সৈয়দ আবুল মকসুদের ইউরোপ ভ্রমণবৃত্তান্তে পড়েছিলাম, প্রতিটি নতুন বইয়ের একটা করে কপি প্রত্যেকটা লাইব্রেরীতে পাঠানো হয়। সরকার এসব বই কেনে। তারমানে যে কোন প্রকাশক ও লেখক নির্ভয়ে বই প্রকাশ করতে পারে এটা ভেবে যে, অন্তত ৬০০০ বই সরকার থেকে কেনা হবেই!
আমরা গরীব দেশের মানুষ। আমাদের সরকার জার্মান সরকারের মত এমন কাজ করতে পারবে না অর্থনৈতিক কারণে। তার উপর ৫% লোকও পাওয়া যাবে না যারা সপ্তাহে অন্তত একটা করে বই পড়ে। কেনে তো আরও কম।
এই নড়বড়ে অবস্থায় যদি পাইরেটেড ইবুক এসে বইয়ের ক্রেতা ১%-ও কমিয়ে দেয়, সেটাই অনেক ক্ষতি। আমার বই ডট কমের মত সাইটগুলো বাংলা সাহিত্যের জন্য, প্রকাশনার জন্য কতোটা ক্ষতিকর সেটা বোঝার জন্য এর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।
এবারে আবার সেই আমেরিকার কিচ্ছায় চলে যাই। সেখানে কপিরাইটের অবস্থা কেমন? কেউ যদি কোন লেখার কোন অংশ লেখকের অনুমতি ব্যতিত কপি করে নিজ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে, তবে লেখক তাকে প্রথমে একটা লেটার বা মেইল পাঠাবেন, লেখাটা রিমুভ করে দেয়ার জন্য। এরপর রিমুভ করলে ভাল, না করলে দোষী প্রমাণিত হলে তাকে গুনতে হবে এক লক্ষ ডলার জরিমানা। কোন লেখা পুরো কপি করলে, মূল লেখক DMCA এর কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারে। DMCA সেই সাইটের মালিকের সাথে সাথে যোগাযোগ করে লেখাটা রিমুভ করতে বলে। যদি রিমুভ না করে তবে তাদের সুপার ইন্টেলিজেন্ট কম্পিউটার এক্সপার্টদের দ্বারা সাইটটি ডাউন করে দেবে!
আর এদিকে আমারবই.কম কপিরাইট আইনের বারোটা বাজিয়েও টিকে আছে বহাল তবিয়তে। পর্ন আমাদের জন্য ক্ষতিকর অবশ্যই, তার চাইতে বেশি ক্ষতিকর এধরনের ইবুক সাইট। এই সাইটগুলো বন্ধেও তাই অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।
বইয়ের গুরুত্ব কত বেশি সেটা বুঝতে কিংবা বোঝাতে মহাপুরুষের বানী উদ্ধৃত করতে হয় না। এই বইকে জীবন্ত রাখতেই আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে প্রকাশনীগুলোকে। আমাদের দেশে কপিরাইট আইন প্রয়োগের অভাবে নষ্ট হচ্ছে বইয়ের বাজার, কমে যাচ্ছে পাঠক। আবার এমন সব হতচ্ছাড়া বিধান তৈরি হচ্ছে যাতে করে নষ্ট হচ্ছে পাঠকের স্বাধীনতা। এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তির পথ সরকার কতৃক নির্দেশিত হবে না। সচেতন হতে হবে আমাদেরই। সরকারকে বাধ্য করতে হবে সকল মতের, সকল দেশের বই এদেশে প্রকাশিত হতে দেয়ার অনুমতির জন্য। পাইরেসির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, কথা বলতে হবে মুক্তমত ও পাঠকের স্বাধীনতার জন্য।
২৮ ফেব্রুয়ারি- ১লা মার্চ, ২০১৭
তথ্যসূত্র- Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৭ রাত ২:৪৬