somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বঙ্গবন্ধুর কবর, জানাজা ও দাফন: কেন তাঁর জানাজায় মাত্র ৩৫ জন উপস্থিত ছিল

১৩ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বঙ্গবন্ধুর দাফন নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। বিশেষ করে, অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলোয়। এক জায়গায় তো লিখেছে তাঁকে নাকি রাতদুপুরে কবর দেয়া হয়েছে!
আসলে নির্ভরযোগ্য সূত্রের অভাবে, হয়েছে এমনটা। এমন বিভ্রান্তির ভিতর আমিও ছিলাম কয়েকদিন। পরে, “বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল” হাতে পেয়ে, আলোর একটা স্পষ্ট রেখা খুঁজে পাই।
সেখান থেকে, যতটা পারি, নিজের ভাষায় লিখছি-
বঙ্গবন্ধুর কবর, জানাজা- এসব নিয়ে প্রথম চিন্তা করেন, মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। তিনি তখন বঙ্গভবনে বন্দী অবস্থায় ছিলেন অনেকটা। তিনি খন্দকার মোসতাককে বঙ্গবন্ধুর দাফন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, সেই বিশ্বাসঘাতক বলেন, “রাস্তাঘাটে তো কতো মানুষ মারা যায়, তাদের সবার দিকে দিকে কি আমার খেয়াল রাখতে হবে? গ্রেভ হিম এনি হোয়ার, বাট নট ইন ঢাকা”। (সুত্রঃ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গ/কে এম শফিউল্লাহ/ ঐ/ পৃষ্ঠা ১৬৯)
তখন তিনি ও এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ঠিক করেন যে বঙ্গবন্ধুকে তার বাবা মায়ের পাশে শায়িত করা হবে। আর খালেদ মোশারফকে তিনি ব্যাবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।

“বুকে ছিল তার চব্বিশটি গুলি। ডান হাতের তালুতে একটি। বাঁ পায়ের গোড়ার পাশে একটি। দুই রানের মধ্যখানে দুইটি গুলি। গোসলের আগে তার গায়ের গেঞ্জি, পাঞ্জাবী, প্লেকার্ড লুঙ্গি, পাঞ্জাবীর পকেটে রুমাল, তামাকের কৌটা, পাইপ, একটি তোয়াইলা, একটি চাদর, এগুলি পাওয়া যায়। জিনিসগুলি ধুয়ে যত্ন কইরা রাখি। ধুইতে গিয়া খালি গেঞ্জিটা হারাইয়া ফেলি।”
কথাগুলো বলেছেন আব্দুল মান্নান শেখ। বঙ্গবন্ধুর কবর খুঁড়েছিলেন এই ব্যক্তি। গোসলও করিয়েছিলেন তিনি।
১৬ আগস্ট সকাল ন’টার দিকে টুঙ্গিপাড়ার পোস্ট মাস্টারের কাছে বার্তা আসে, “পাঁচ ছয়টি কবর খুঁড়তে হবে, লাশ আসছে ঢাকা থেকে”। পরে জানানো হয় ফোন করে, একটি কবর খোঁড়ার জন্য।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, সপরিবারে, একথা গ্রামবাসী জেনে গিয়েছিলো আগেই, রেডিওর মাধ্যমে। তাই হেলিকাপ্টারে বঙ্গবন্ধুর লাশ দুপুর ২টায় থানার মাঠে আনা হলে, অনেক লোক আসে দেখতে। কিন্তু কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি। শুধু ১৫/১৬ জনকে তার কফিন বহন করার জন্য রাখা হয়। কফিনের ভেতরে ছিল বড় বড় কিছু বরফের টুকরা, তাই সেটা হয়েছিলো আক্ষরিক অর্থেই খুব ভারী।
কফিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আনা হলে, কফিন খোলা নিয়ে ফ্যাসাদ দেখা দেয়। এমনভাবে কফিনটা লাগানো হয়েছিলো যে সেটা খুলতে মিস্ত্রী পর্যন্ত আনতে হয়েছিলো। এতো ঝামেলায় না গিয়ে সেনারা কফিনসহ কবর দিতে চাইলে, তাড়াতাড়ি মিস্ত্রী ডেকে কফিন খোলা হয়।
এরপরে হালিম মৌলবিকে ডেকে বলা হয়, তাড়াতাড়ি কবর দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু একজন মুসলমান, ওনাকে গোসল করাতে হবে, কাফন পরাতে হবে এবং জানাজা পরাতে হবে, আর যদি আপনারা বলেন যে বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েছে তাহলে এসবের দরকার নেই।”
তখন তাদের ২০ মিনিট দেয়া হয় মাত্র- গোসল, কাফন, জানাজা’র জন্য।
শেখ সাহেরা খাতুন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের রিলিফের জন্য রাখা শাড়ি দিয়ে কাফন বানানো হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর। আর গোসল করানো হয়েছিলো ৫৭০ কাপড়কাচা সাবান দিয়ে! অনেক লোক জমা হয়েছিলো ততোক্ষণে কিন্তু তাদের কাছে আসতে দেয়া হয়নি। আনুমানিক ৩৫ জন লোক উপস্থিত ছিলেন (তিন সারি) বাংলার এই সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার জানাজায়। এ বিষয়ে, রজব আলী, যিনি বঙ্গবন্ধুর শেষ গোসলের জন্য সাবান কিনে এনেছিলেন দোকান থেকে, বলেন- “বঙ্গবন্ধুর যখন দাফন কাফন চলছিল তখন এতে অনেক সাধারণ মানুষ সরিক হতে চাচ্ছিল, কিন্তু আর্মিরা প্রচণ্ড বাঁধা দেয়। তারা ভাবছিল বেশি মানুষ এসে যদি লাশ ছিনিয়ে নেয়! সেদিন মানুষ যেমন আর্মিদের ভয় পাচ্ছিল, আর্মিরাও ভয় পাচ্ছিল সাধারণ মানুষদের, কখন জানি তারা ক্ষেপে ওঠে!”
আর্মিরা যে ভয় পাচ্ছিল সেটা বুঝতে পারা যায়, কর্ণেল কাজী হায়দার আলীর বক্তব্য থেকে। তিনি সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন-
“হেলিকপ্টারের মধ্যে কারো মুখে কথা নাই, সবাই হয়তো আমার মতোই ভাবছিল, এই কঠিন দায়িত্বে আল্লাহ কেন আমাদের সোপর্দ করলেন? দায়িত্ব পালন করে নিজেরা ফিরতে পারবো কি? দেশের প্রেসিডেন্টের মৃতদেহ তাঁর বাড়িতে যাচ্ছে, লোকেরা কতো কিছু জিজ্ঞাসা করবে, তার জবাব কী দেব? সবাই মনে করবে আমরাই এই অঘটন ঘটিয়েছি, তখন লোকাল এরিয়া থেকে পাল্টা আঘাত আসতে পারে, নিজেরা সামলে ফিরে আসতে পারবো কি?” (সুত্রঃ-বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল/ পৃষ্ঠা- ৮৪)
সেদিন কর্ণেক কাজী হায়দারের সঙ্গে ছিল ১৪ জন সৈনিক। মাত্র ১৪ জন সৈনিক নিয়ে এতো বড় একটা কাজ করা সত্যিই ছিল বিপদজনক। যে কোন কিছুই ঘটতে পারতো। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আক্রমণ ছিল স্বাভাবিক। সেজন্য সেখানে পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখার কথা ছিল। কিন্তু ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম বলেন-
“...টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছে একহাজার ফিট মাটির কাছাকাছি নেমে দেখলাম সেখানে আমাদের অপেক্ষায় কোন ফোর্স নেই। এ অবস্থায় আমরা দুই হাজার ফিট উপরে উঠে যাই। সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় আমরা কখনো একহাজার ফিট কখনো দুই হাজার ফিট উপরে হেলিকপ্টার নিয়ে চক্কর খেতে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমরা ল্যান্ড করি।” (সুত্রঃ ঐ/ পৃষ্ঠা- ৮৫)
এই ভয়ের কারণেই কাউকেই, কয়েকজন ছাড়া, আসতে দেওয়া হয়নি বঙ্গবন্ধুর লাশের কাছে।

একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুর পর যে রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার কথা ছিল, সেটা বঙ্গবন্ধু পাননি। দাফন শেষ হওয়ার পর আর্মি অফিসারেরা সারিবদ্ধ হয়ে তাকে তিনবার স্যালুট করে চলে যায়।
তার জানাজায় হাজার হাজার মানুষ সামিল হতে পারেনি, কিন্তু কোটি কোটি মানুষ হয়েছিলো শোকে স্তব্ধ। তারা কাঁদেনি। তারা পাথর হয়ে গিয়েছিলো।
এরপর পুরো দুই দশক তার নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। না রেডিও, না টেলিভিশন, না সংবাদপত্র- কোথাও ছিলেন না তিনি। শুনেছি, ১৫ আগস্ট এলে নাকি তখন টিভিতে বলা হতো, খবরের এক কোণে, “আজ মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী”! হায়, তিনি কি শুধুই ছিলেন একজন রাষ্ট্রপতি?
আজ মাঝেমাঝে বলতে দেখা যায় অনেককে, ৭৫ এ খুন করা হয়েছে একজন স্বৈরশাসককে। শেখ মুজিব গণমানুষের নেতা থেকে উঠেছিলেন গুটিকয়েক মানুষের নেতা। হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, হত্যা করেছে গনত্রন্ত্র বিরোধী হয়ে যাওয়া একনেতাকে।
তাদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, তাঁকে হত্যার পর হত্যাকারীরা আমাদের কী দিয়েছে? দুই দশকের সামরিক শাসন আমাদের মাথার উপর ছিল না? তারা আমাদের জীবন যাত্রা করতে পেরেছে উন্নত? পেরেছে এনে দিতে শান্তি? বন্ধ করে দিতে পেরেছে দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ?
আপনার উত্তর যদি “হ্যাঁ” হয়, তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ঠিক হয়েছে; ঠিক হয়েছে তার পরিবারকে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রচেষ্টা। আর যদি হয় “না”- তবে ঘৃণা রাখুন মনে সেই হত্যাকারীদের প্রতি।

আজ, মাঝেমাঝে ভাবি, যতটা ঘৃণা করা উচিৎ সেই হত্যাকারীদের, ততোটা কি আমরা করি? মীরজাফরের মতো তবে কেন বলি না, “শালা তুই একটা খন্দকার মোসতাক”, কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে?
এতো দূরের কথা, আমরা ৩০ লাখের খুনে যাদের হাত ভেজা, সেই পাকিস্তানকেও ঘৃণা করি না।
প্রজন্ম, কিছু ঘৃণা রেখো মনে।
০৫/০৬/২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৩
৫৩টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বিহনে কাটে না দিন

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:০৩



অবস্থানের সাথে মন আমার ব্যাস্তানুপাতিক,
বলে যাই যত দূরে ততো কাছের অপ্রতিষ্ঠিত সমীকরণ।
তোমাকে ছেড়ে থাকা এতটাই কঠিন,
যতটা সহজ তোমার প্রতিটি চুল গুনে গুনে
মোট সংখ্যা নির্ণয় করা।
তোমাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

×