ডেনালীতে বা আশে পাশে অনেক হোটেল, মোটেল আছে, কিন্তু ভয়াবহ দাম৷ সস্তা খুজতে গিয়ে বেশ দুরে যেতে হলো৷ বেড এ্যান্ড ব্রেকফাস্ট৷ বয়স্ক মহিলা নিজের বাসার রুমগুলো ভাড়া দিচ্ছে৷ এমনিতে খারাপ না৷ কাচা রাস্তায় মাইলখানেক গাড়ি চালাতে হলো৷ বেশ অন্ধকার, ১০/২০ মাইলে হয়তো আর কিছু নাই, কেমন খা খা শুন্যতা৷ রাতে একটু ভয়মেশানো অনুভুতি হচ্ছিল৷
খোলা মাঠের মতো জায়গায় বুড়ির দোতলা বাড়ি৷ আরও কাস্টমার আছে, তাই চুপচাপ চাবি নিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম৷ কথা ছিল অরোরা দেখার চেষ্টা করব, যদিও প্লেনে দেখে আসছি, এখন মাটি থেকে দেখতে চাই৷ ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে এলাম৷ ঘুটঘুটি অন্ধকারের মধ্যে বিশাল আকাশ৷ ভয়াবহ৷ আকাশটাও কেমন অপরিচিত৷ ধ্রুবতারা সবসময় উত্তর দিগন্তে দেখে এসেছি, এখানে একদম মাথার উপরে৷ সপ্তর্ষী মন্ডলও তাই৷ আমাদের দেশে যেমন তারা গুলো পুর্ব থেকে পশ্চিমে যায়, এখানে ব্যাপারটা তা নয়৷ ধ্রুবতারা যেমন কখনই অস্ত যায় না এখানে৷ সপ্তর্ষী, লঘু সপ্তর্ষী, ড্রাকো সারারাত আকাশে থাকে, ধ্রুবতারার চারপাশে ঘুরতে থাকে৷ কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল আমার৷ কে জানে ঝোপঝাড়ে হয়তো কোন ভাল্লুক লুকিয়ে আছে৷ মিনিটখানেক আকাশ দেখে দৌড়ে রুমে ঢুকলাম, থাক পরে দেখবো সবার সাথে, একা দেখে কাজ নেই৷
সকালে তাড়াতাড়ি উঠলাম৷ ৮ টায় ডেনালীর বাস৷ ১৩/১৪ ঘন্টার জার্নি৷ ব্রেকফাস্ট ছিল ভালই, মাফিন, ব্রেড, ডিম, কমলার রস এসব৷ খেয়েদেয়ে বুড়ির সাথে ছবি তুলে ডেনালীর রাস্তা ধরলাম৷ একবার বাসে ঊঠলে কোন খাওয়া নেই, এজন্য সাবওয়ে থেকে স্যান্ডউইচ কিনলাম৷ বাসের টিকেট কিনতে গিয়ে দেখি আমার বাত্সরিক ন্যাশনাল পার্ক পারমিট এক্সপায়ার করে গেছে৷ আরেকটা কিনতে হলো৷ বহু লোকজনের ভীড়৷ ক্যাম্পিং করতে যাচ্ছে অনেকে, কেঊ বাসে আমাদের মতো, অনেকে আবার গাইডেড ট্যুর নিয়েছে৷
ডেনালী, আলাস্কার মধ্যভাগের বিশালাকৃতি ন্যাশনাল পার্ক৷ ৯ হাজার বর্গ মাইল আকারে, মানে বাংলাদেশের পাচ ভাগের একভাগ৷ পুরো উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে উচু চুড়া এই পার্কের মধ্যভাগে, মাউন্ট ম্যাকিনলী৷ এমনিতে পাহাড়ি পার্কটার নীচু এলাকায় তৈগা বনভুমি, একটু উচুতে গেলে তুন্দ্রা এলাকা শুরু হয়েছে৷ তুন্দ্রার ঘটনাটা হচ্ছে মাটির নীচে এখানে জমাট বাধা বরফ, সারা বছরে কখনই ঐ বরফ গলে না, এজন্য বড় গাছ জন্মাতে পারে না৷ প্রানীর মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রীজলী ভালুক (বা ব্রাউন বেয়ার), বল্গা হরিণ, মূজ, ডাহ্ল ভেড়া, গ্রে উল্ফ৷
গ্রীজলী ভালুক তাদের হিংস্রতার জন্য পরিচিত৷ অনেকে দেখলাম পেপার স্প্রে (মরিচের গুড়া) নিয়ে এসেছে, ভালুককে ভয় দেখানোর জন্য৷ আমাদের অবশ্য বাস থেকে নেমে বীরত্ব দেখানোর কোন ইচ্ছা নেই৷ আর এমনিতে জংলী প্রানী খুব ভয় পাই, আমার আফ্রিকান পুর্বপুরুষরা লক্ষ বছর আগে সাভান্নাতে সিংহ দেখে যে ভয় পেত সেটা এখনও আমার ভেতরে আছে৷ চিড়িয়াখানায় ভয় লাগে না, কিন্তু যতবারই সত্যিকার জংগলে গিয়েছি ততবারই বেশ ভয় পেয়েছি৷ অথচ এখানে অনেকে বেশ অবলীলায় ক্যাম্পিং করতে যাচ্ছে৷ গ্রীজলী ভালুকের আক্রমন বেশ কমন৷ যে বিরান এলাকা, কোন সেল ফোন, বা লোকালয় নেই কয়েকশ মাইলের মধ্যে, সুতরাং বিপদে পড়লে নিজের বুদ্ধিই ভরসা৷
বাসের ড্রাইভার নেটিভ আমেরিকান, হয়তো আলেউট বা আথাবাস্কান৷ রাস্তা বেশ আকাবাকা, এবং কাচা৷ ১৪ ঘন্টা এই জার্নি করতে হবে ভেবে একটু ভয়ই লাগছিল৷ শুরুতে গতদিনের বিকেলের মতোই প্রকৃতি , একটু ইনটেন্স৷ আস্তে আস্তে ইনটেন্সিটি আরও বাড়তে লাগলো৷ বাস একপাশের পাহাড় ঘেষে যাচ্ছিল, মাঝে বিশাল ছড়ানো উপত্যকা, আর আকাবাকা নিনানা (Nenana) (ছবি দিয়েছি) এবং স্যাভেজ নদী৷
বাসের যাত্রীদের বেশির ভাগ অন্যদেশ থেকে এসেছে, জাপান বা ইউরোপ থেকে৷ সবাই হাতে ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে রেডি৷ অনেকে দেখি একদম টেলোফটো লেন্স ওয়ালা ক্যামেরাও নিয়ে এসেছে৷ এত হাকডাক দেখে বেশ দাম দিয়ে কেনা SLR টা লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছিল৷ সবচেয়ে সহজলভ্য মনে হয় ক্যারিবু, অনেক দেখলাম রাস্তার আশে পাশে, মনে হয় এরাই গ্রীজলীর সহজ শিকার৷ আগের দিন একটা মুজ দেখলেও আজকে একটাও দেখলাম না৷ পাহাড়ের গায়ে কিছু ডাহ্ল ভেড়া (Dahl Sheep) দেখলাম, এত দুরে যে খালি চোখে বোঝা যাচ্ছিল না, দূরবীন দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, যে ভেড়া ছিল ওগুলো৷ কিন্তু দুপুর পর্যন্ত গ্রীজলীর দেখা মিললো না৷ আরেকটা ব্যর্থতা মাউন্ট ম্যাকিনলী দেখতে না পাওয়া, মেঘে পুরোটাই ঢেকে ছিল৷
দুপুরে একটু বিরতি দিয়ে বাস চলতেই রাস্তার পাশে মনে হলো ঝোপে কালো মতো কি যেন নড়ছে৷ ড্রাইভার তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল৷ নাহ, ঠিকই আছে একটা বাচ্চা ভালুক, তার মানে মা ভালুকটা নিশ্চয়ই কাছেই আছে৷ বলতে বলতেই বের হয়ে আসলো বিশালাকৃতির একটা গ্রীজলী৷ এরা মনে হয় মানুষের সাথে বেশ পরিচিত৷ তেমন পাত্তা দিল না আমাদের বাসটাকে৷ গাছগুলোর আড়ালে মনে হয় আরেকটা বাচ্চা ছিল৷ পানির ধারে একটু ঘুরে ফিরে আবার হেলে দুলে ভালুক বাচ্চা সমেত গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল৷ উত্তেজনায় বেশী ছবি তোলা হয় নি৷ তবে ১৪ ঘন্টা জার্নির পয়সা উসুল, ভালুক না দেখলে আসলে কষ্ট লাগতো৷
বাকী রাস্তা ক্যারিবু আর তুন্দ্রা দেখতে দেখতে ৩টার দিকে ওয়ান্ডার লেকে পৌছলাম৷ লেকের আশে পাশে বেশ বড় করে ওয়ার্নিং দেয়া৷ বেয়ার কান্ট্রি৷ যেকোনো সময় ঝোপ থেকে বের হতে পারে৷ বাসের ২০-৩০ জন লোক থাকাতে তেমন ভয় করছিল না৷ আর ভালুক ব্যাটারও তো ভয় আছে৷ অনেকে ব্লু বেরী খাচ্ছিল জংলা জায়গাটা থেকে৷ আমি মুখে দিয়ে দেখলাম এমন আহামরি কিছু না, দোকানে যেগুলো পাওয়া যায় ঐগুলাই, আধোয়া আর কি৷ বাথরুম টাথরুম সেরে নিলাম৷ ক্যামকর্ডারের ব্যাটারী দেখি যায় যায় অবস্থা৷ লোকালয় থেকে এত দুরে কোন ইলেকট্রিসিটিও নাই যে চার্জ দেব৷
আসলে যে টা ভুল করেছিলাম তা হলো যথেষ্ট খাবার না নিয়ে আসা৷ বিকালের মধ্যে ভালো ক্ষুধা লাগলো৷ ফেরার পথে ক্ষুধায় দেখি প্রাকৃতিক দৃশ্যও আর ভালো লাগছে না৷ দলের দু-একজন ঘুমিয়ে ক্ষুধা চাপা দেয়ার চেষ্টা করলো৷ সন্ধ্যা নাগাদ ফিরলাম, টায়ার্ড, তারওপর আধাদিন কাচা রাস্তার জার্নিতে শরীরে হাড়গোড় অনেকগুলাই ব্যথা করা শুরু করেছে৷
[চলছে…]
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালাঃ ডেনালী, আলাস্কা (৩)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন