আগের পর্ব
ট্রেন এসে থেমেছে বরইবাড়ি স্টেশনে, রাত ভোর হতে চলল। লোকজন ঊর্ধ্বশ্বাসে নামছে। কারন এখানে ট্রেন বেশিক্ষন দাঁড়ায় না। প্লাটফর্মে পা দিতেই বেশ কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ল। সাত বছর আগের ফাকা প্লাটফর্মে এখন শেড হয়েছে। জীর্ণ হাসান ভাইয়ের পান-সিগারেটের দোকান আজ দালান হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটা দোকান ছিল, এখন রীতিমত স্টেশন বাজার! চারপাশটা ভাল করে দেখে নেবার অনেক সময় আছে। অফিস থেকে ১০ দিনের ছুটি নিয়েছি। সবার আগে এখন বাড়ি যেতে হবে।
মায়ের চিঠি পেয়ে ফিরছি। আমার মা, তসলিমা বেগম। বরইবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। এই সাতটি বছর শুধু মায়ের সাথে যোগাযোগ ছিল। নিয়মিত চিঠি লিখতাম। আমি কি করি, কোথায় থাকি, প্রতিদিন কি কি খাই। সবকিছু মার জানা চাই। কিন্তু মা নিজের কথা বলেন না। বরইবাড়ির কথা বলেন না। আমার বন্ধুদের কথা বলেন না। প্রথম প্রথম পাগলের মত করতাম, হেনার কথা জানতে চাইতাম। কিন্তু মা কিছু বলেন না।
শুধু একদিন বললেন, ‘জেনে রাখো, সে সুখেই সংসার করছে’। আর কিছু বলেন না।
আমি বলি, ‘মা আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে না’! মা কিছু বলেন না। বাবার কথা বলেন না। আমি বলি, ‘মা আমার কি কখনই ফেরা হবে না’!
‘তোমার বাবা এক কঠিন শর্ত দিয়েছে আমাকে। যেদিন তার মান ভাঙ্গবে, সেদিন এসো’।
মায়ের চিঠি পেয়েই রওনা দিয়েছি। মা লিখেছেন, ‘চলে এস রাশেদ। তোমার অপেক্ষার দিন শেষ। এবার ফেরার পালা। তোমার বাবা তাই বলেছেন’।
রিক্সা করে বাড়ি ফিরছি, সাথে একটি কাপড়ের ব্যাগ রিক্সার পাটাতনে। মায়ের জন্য শাড়ি-চাদর, বাবার জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবী। সেই পুরোনো রাস্তা, ডানে স্কুলের মাঠ, একটু এগিয়ে বামে বেলপুকুরের পাড়; অন্ধকারে কিছু দেখি না। রাস্তা অতিক্রম করা দু একজন ট্রেনের যাত্রী, কেউ আমায় চিনছে না। রিক্সার টুনটান শব্দে কখন বাড়িতে এসে নেমেছি মনে নেই, দরজার নক করলাম দুই বার। বুকের ভিতর দুরু দুরু করছে। এই আমার জন্মস্থান, এই সেই বাড়ি। আমার শৈশব, কৌশোর, যৌবন। দরজা খুলতে কেউ আসছে, আমি পায়ের শব্দ পাই। বাবার জন্য অপেক্ষায় আছি।
কিন্ত মা ডাক দিলেন, কে এত রাতে?
আমার গলার স্বর ভারি হয়ে এসেছে, চোখ ভর্তি পানি। কোন কথা মুখ দিয়ে বেরুতে চাইছে না।
মা আবার বলল, কে?
তবে কি বাবা! আমি আর ভাবতে পারি না।
আমার গাল বয়ে গড়িয়ে পড়ছে লোনা জল। বাষ্পরুদ্ধ গলায় অস্ফূট আওয়াজ বের হল,
‘মা, আমি রাশেদ’।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:৩৩