আগের পর্ব
২৩ শে জুলাই ২০০২। হেনার বিয়ের দিন। হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও যাবতীয় হিসেব কষে দেখি কিছুই করার নেই। কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে, হেনার মুখটা বারবার চোখে ভাসছে। নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছি না। ওর এমন নিশ্চিত সুন্দর জীবনের কথা ভেবে যত ভালোবাসা, যত প্রেম সব সঁপে দিলাম অদৃষ্টের হাতে। হেনা যখন আমার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরেছে আর যোগাযোগ করে নি। যে অভিমান আর কষ্টের পাহাড় বুকে জমা পড়েছে তা ডিঙ্গানো যায় না। আমি কেমন যেন ঘায়েল হয়ে গেছি। আমার হাত পায়ে কোন শক্তি নাই। চারপাশ ঘোলা ঘোলা লাগে। রুমের দরজা ব্ন্ধ করে শুয়ে আছি। ঘর ধোয়ায় অন্ধকার।
সন্ধ্যার দিকে, একটি গাড়ির শব্দ শুনলাম তারপর হঠাৎ বাড়ির দরজায় ধপধপ আওয়াজ। মা দরজা খুলে দেখে রায়হান, কবির, মহী দাঁড়িয়ে আছে। রায়হানের কাধে বড় ব্যাগ, মহীর হাতে হকি স্টিক। রায়হান আমার ঘরে এসে বলে, ‘চল, আর সময় নেই’।
আমি উদ্ভ্রান্ত তাকিয়ে থাকি। ‘কোথায় যেতে বলছিস?
কবির পকেট থেকে ভাজ খোলা একটি চিঠি বের করে দিল।
প্রিয় সানি,
আমাদের বাসার কথা মনে আছে? দুই রুমের লাল বাসা। বেলকনিতে ক্যাকটাস। তোমার সিগারেট খাওয়া কিন্তু শুধু বেলকনিতেই চলবে অন্য কোথাও নয়। শুক্রবার সকালে আলসেমিতে যখন তোমার ঘুম ভাঙ্গবে না, আমি পুবের জানালা খুলে দেব। রোদ পড়বে তোমার চোখে-মুখে। শীতের সকালে তোমার বালতি ভর্তি গরম পানিতে আমার ভাগ বসানোর কথা ছিল আসলে একসাথে গোসলের বাহানা। তুমি তাও বুঝলে না! রান্নার পর নোংরা পাতিলগুলো ধোবার দায়িত্ব তোমায় দিয়েছি বলে কি এত মন খারাপ! আর মন খারাপ কর না। আমাদের সেই ছোট্ট সংসার হল না।
তুমি তো আমাকে নিতে আসবে না। তোমার বাস্তবতা এমন নিঠুর করলো যে আমার হৃদয়ের রক্তের স্রোত তোমাকে গলাতে পারলো না। তবু আমি অপেক্ষায় থাকবো। আর যদি পথের শেষে তোমার ছায়া না পাই, তবে আমায় ভুল বুঝো না, আমার জীবন তো একান্তই আমার!
ইতি
তোমার মৌসুমী
চিঠি হাতে আমি থর থর করে কাঁপছি। জানি না কিসে ভর করলো আমায়। আমার প্রেম, আমার হেনা যেন আর্তনাদে ডাকছে আমায়। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো, যদি হেনা আত্মহত্যা করে। মহী, রায়হানের চোখেও টগবগে খুন। কাধের ব্যাগ থেকে লাঠি, ছুরি নিয়ে শুরু করেছি দৌড়। সেই যাত্রা যদি একবার স্বপন ভাই বা জেরিনকে দেখাতে পারতাম। ভালোবাসায় উন্মত্ত যুবকের দিশেহারা যাত্রা।
আমরা পৌছাতে দেরি হয়ে গেল। বরযাত্রী পৌছে গেছে ততক্ষণে। বাড়িতে ঢোকার মুখেই বিয়ের গেইট ভেঙ্গে চুরমার করলো কবির। বাড়ির উঠানে করা হয়েছে বরের প্যান্ডেল। রায়হান ঢুকে গেছে প্যান্ডেলের ভিতর। এক হাতে রামদা অন্য হাতে চাপাতি। বিয়ের লাল-নীল বাতির মত ওর হাতিয়ার চিকচিক করছে হ্যাজাকের আলোয়। বরপক্ষের দুটি ছেলে তেড়ে আসতেই, হুংকার দিয়ে উঠলাম। ‘খবরদার কেউ সামনে আসবি না। একদম খতম করে ফেলব’। তারপর হেনার এক চাচাতো ভাই এগিয়ে আসল। মহী হকি স্টিক দিয়ে বেদম পেটাতে শুরু করেছে ওকে। বাড়ির ভিতর থেকে মহিলা-বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ আসছে। আমি আর কবির ভিতরে ঢুকে হেনা কে খুঁজছি। নববধুর সাজে হেনাকে পাওয়া গেল। আমার হেনা। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে অবাক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে উল্লাসে ছুটে আসলো। বাম হাতে লাঠি আর ডান হাতে হেনার হাত। ওকে জাপটে ধরে থাকা মহিলাগুলোকে কবির ছাড়িয়ে দিচ্ছে প্রচন্ড আক্রোশে। তখন দেখা গেল বেলা আর সুপ্তিকে। বেলা শান্তস্বরে সবাইকে বলছে, ওদের যেতে দিন। হেনাকে নিয়ে মাইক্রোবাসে উঠব, এমন সময় আবার বাধা আসলো। কে যেন হেনার হাত ধরে টানছে। পিছনে ঘুরে লাঠি তুলেছি মারার জন্য, আলো আধারের মধ্যে বিস্ময়ে দেখি আমার বাবা। ঘোর কাটতে না কাটতে প্রচন্ড জোরে চড় বসিয়েছেন আমার গালে। আমি হেনার হাত ছেড়ে দিলাম
শেষ পর্ব................
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪৩