আগের পর্ব
ট্রেন চলছে শামসুর রাহমানের কবিতার মত। ট্রেনের বাড়ি কই? ট্রেনের কোন বাড়ি নেই, ছুটে চলার জন্যই তার জন্ম। কিন্তু মানুষের বাড়ি থাকে। ছুটতে ছুটতে মানুষকে তার ঘরে ফিরতে হয়। সব পাখি ঘরে ফেরে, এ জীবন ফুরায় সব লেনদেন! সবাইকে একদিন ফিরতে হয়, এই যে গত সাত বছর আমি বরইবাড়িতে ফিরি না। ভেবেছিলাম কখনই ফিরবো না। আজ ফিরছি। কিন্তু সত্যি কি জীবনের সব লেনদেন ফুরিয়ে যায়? আমার সাথে হেনার তো লেনদেনই হল না।
একদিন বিকেলে কবির দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো। চোখমুখ দেখে বুঝে গেলাম কোথাও সমস্যা হয়েছে। দেরি না করে বেরিয়ে গেলাম, সোজা বেলপুকুর পাড়। আমার স্মৃতিতে খুব পরিস্কার গাঁথা আছে সেই দিনটা। তখন গ্রীষ্মকাল, বিকেল হবার আগের মুহুর্ত। কাঠফাটা তপ্ত রোদে হেনা দাঁড়িয়ে আছে, সাথে সুপ্তি। পুরো মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে, দু’চোখ বেয়ে অনর্গল গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। আমাকে দেখে সেই কান্নায় নতুন মাত্রা যোগ হয়ে সে আছড়ে পড়লো ঘাটের সিড়িতে।
সুপ্তি কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘ভাই ওকে থামান। কাঁদতে কাঁদতে মারাই যাবে!’
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কি হলো! হেনার পাশে বসে, মাথায় হাত দিয়েছি কেবল। ও আমার বুকি ঝাপিয়ে পড়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। তুমি আমাকে বাঁচাও। আমি অন্য কারো ঘরে যাব না’।
আমি অস্থির হয়ে বলি, ‘কিসের ঘর, কার ঘর? আমিতো আছি তোমার পাশে’।
সুপ্তি বলল, ‘চাচা ওর বিয়ে ঠিক করেছে, ছেলেরা কাল দেখতে এসেছিল। আজ সকলে জানিয়েছে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে’।
হেনা আমার দিকে অসহায় চেয়ে আছে। হঠাৎ করে আমার স্বাভাবিক পৃথিবীতে যেন ঝড় বেয়ে যাচ্ছে। সেই মাতাল হাওয়া এসেছে এতদিনের স্বপ্ন, তীলে তীলে গড়া পরিকল্পনাগুলোকে লন্ডভন্ড করে দিতে। মাস্টার্স পরীক্ষা তখন দুই মাস বাকি। আমি পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে আমার অথই জীবনের তল খুঁজছি। হেনা চিৎকার দিয়ে বলল, ‘কিছু বলছো না কেন?’
‘কিছু হবে না। ধৈর্য ধর। আমিতো আছি!’ আমি অনেক শক্ত করে ওকে ধরি।
‘তুমিতো জানো আব্বা আর সংসার টানতে পারছে না। আমাকে তার বোঝা মনে হয়।আগামী শুক্রবার আব্বা যাবে ছেলের বাড়ি দেখতে সেখানেই দিন তারিখ ঠিক করে আসবে’।
সুপ্তি নির্লিপ্ত ভাবে যোগ করে, ‘ছেলে সরকারী ইঞ্জিনিয়ার। অনেক টাকা-পয়সা ওয়ালা। আর হেনাকে দেখে এত পছন্দ হয়েছে যে চাচাকে বলে দিয়েছে বিয়ের সব ব্যয় তার। এমন দুর্দিনে চাচা এই সুযোগ ছাড়বে না’।
আমি দিশেহারা হয়ে যাই, ছটফট করি। আমার বাবা-মা কিছুতেই লেখাপড়া শেষ করার আগে আমার বিয়ে দিবে না। মাকে বোঝানো যাবে কিন্তু বাবাকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না। কবির দাড়িয়ে শুনছে সবকিছু। চরম আক্রোশে বলে উঠলো, ‘ছেলের ঠিকানা দাও, দুইটা ঠ্যাং ভেঙ্গে দিয়ে আসি। কিভাবে বরইবাড়ি বিয়া করতে আসে দেখব’
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৬