অনিবার্য পরিস্থিতির সাংবিধানিক বৈধতা
সপ্তম সংশোধনী বাতিল হতে পারে না[/sb
----সুনীল শুভরায়
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চের কাহিনী। আজ থেকে আঠাশ বছরেরও বেশি সময় আগের ঘটনা। স্মৃতিতে মরচে পড়ারই কথা। বর্তমান সময়ের পরিণত যুব নাগরিকরাতো পরিচিতই নন সেই সময়কার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে। হয়তো শুনেছেন, ওই দিনে বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছিল। কিন্তু তার পূর্বাপর ইতিহাস সেভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। সারা বিশ্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে- সেখানে রয়েছে হত্যাকাণ্ডের মহোৎসব। বাংলাদেশেও দুইবার সামরিক আইন জারি হয়েছে। এর একটিকে বলা যায় সামরিক অভ্যুত্থান আর একটি সামরিক আইন জারি। এর মধ্যে পার্থক্য শুধু এই যে, অভ্যুত্থানে রক্তের হলি বয়ে গেছে। আর আইন জারিতে তা হয়নি।
প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানকে তথাকথিত ‘বিপ্লব’ বলে চালানো হয়েছিল। এখনো কোনো মহলে ওটা বিপ্লব নামেই চলছে। মূলত এই বিপ্লবের গোড়াপত্তন হয়েছে ইতিহাসের ঘৃণ্য কলঙ্কময় ঘটনা ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। তারই সুবিধাভোগীরা ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর সেনা-কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের মহা উৎসবের মাধ্যমে সামরিক শাসন কায়েম করে। অপরদিকে এই অপকর্ম জায়েজ করতে ‘বিপ্লব’ শব্দটাকে অপবিত্র করা হয়। সেনা কর্মকর্তা হত্যা করে ঢাকা শহরের রাস্তায় উল্লাসরত কিছু সংখ্যক সৈনিকের ট্যাংক মহড়ার সামনে স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত পক্ষের আনন্দ প্রকাশের নাম যদি বিপ্লব হয়- তাহলে বিপ্লবের আবিধানিক অর্থটাকেই পাল্টে ফেলতে হয়। সেই বিপ্লবে কত সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়নি। সেদিন নিহত হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফ। কারা তাকে হত্যা করল, তার বিচার তো দূরের কথা- হত্যা রহস্যই উদ্ঘাটিত হলো না। যাহোক এই পটভূমিতে যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন, মহামান্য উচ্চ আদালতের রায়ে তাদের ক্ষমতাগ্রহণ অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সব সামরিক ফরমান ও অধ্যাদেশ অবৈধ হয়ে যায়। এর জন্য খোন্দকার মোশতাক, বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু তারা তিন জনই প্রয়াত। দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাদের মরোণত্তর বিচার করা হবে কি-না তা রায়ে বলা হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ে আরো বলেছেন, কোনো অবস্থায়ই সামরিক শাসন জারি বা সংবিধান স্থগিত করা যাবে না। এখানে ‘যাবে না’ বলতে ভবিষ্যৎকে বোঝায়। অতীতের ব্যাপারে কি করা হবে তা সুনির্দিষ্ট নয়। এ ব্যাপারেও মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আরো বলা হয়েছে, “অতীতে সুপ্রিম কোর্ট ভুল করে সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন।” বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম ঘটনা যে, উচ্চ আদালত অতীতের একটি রায়কে ভুল বলে অভিহিত করলেন। আমরা সাধারণ মানুষ “আদালত ভুল করে” বলতে পারব না। তবে আদালতের রায় মনোপুত না হলে উচ্চ আদালতে যাওয়া যায়। এবং সেখানে নিম্ন আদালতের রায়ও অনেক সময় বদলে যায়। এ ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। কিন্তু একবার সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায় তো বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং অতীতে সুপ্রিম কোর্ট সামরিক শাসনকে যে বৈধতা দিয়েছেন সেই রায় অবৈধ হতে পারে না। বর্তমান রায় অনুসারে ভবিষ্যতে কোনো অবস্থাতেই সামরিক শাসন জারি বা সংবিধান স্থগিত করা যাবে না। যদি কখনো করা হয়, তাহলে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। সোজা-সাপটাভাবে আমরা এটাই বুঝতে পারি।
আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ হলো। এখানে একটি বিষয় বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের বড় কারণ হচ্ছে সংবিধানের মৌল কাঠামো পরিবর্তন করা। কিন্তু এই সংশোধনীর মাধ্যমে তো বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথও সুগম হয়েছে। এখন গোটা পঞ্চম সংশোধনী যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কি হবে, সেটা বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছে। এই অবস্থায় কিছু বহাল রেখে কিছু বাতিল করা হলে পূর্ণাঙ্গ রায় কীভাবে বাস্তবায়িত হবে!
এবার আসা যাক দ্বিতীয়বার সামরিক আইন জারির কথায়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বারের মত সামরিক আইন জারি হয়। সেই সময়ের কথা স্মরণ করতে গেলে ইতিহাসের ঘটনাবলীর দিকে চোখ ফিরাতে হবে। তখন সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। তিনি ছিলেন বিএনপির দ্বিতীয় চেয়ারম্যান। অর্থাৎ তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি। দেশে তখন কি ধরনের নৈরাজ্য ও অরাজক পরিস্থিতি ছিল, সে আলোচনায় যেতে চাই না। তৎকালীন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের মধ্যেই তার সার-সংক্ষেপ পাওয়া যাবে। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার তখন দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তার মন্ত্রী পরিষদ দিয়ে দেশ চালাতে পারছিলেন না। প্রেসিডেন্ট নিজে তার মন্ত্রিপরিষদকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করলেন। তিনি নিজের ক্ষমতার স্বার্থ এবং দলের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে দেশের স্বার্থের কথা ভাবলেন। ’৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার দেশবাসীর উদ্দেশ্যে রেডিও এবং টেলিভিশনে ভাষণ দিলেন।
আলোচনার স্বার্থে সেই ভাষণটি এখানে হুবহু উল্লেখ করছি।
বিচারপতি সাত্তারের ভাষণ :
“প্রিয় দেশবাসী,
আসসালামু আলাইকুম। দেশের আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জাতীয় স্বার্থে সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সারা জীবন আমি ঐকান্তিকতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করেছি এবং সর্বদাই দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের সার্বিক অবস্থার যাতে উন্নতি হয়, তাই কামনা করেছি। দেশের এই বর্তমান অবস্থায় দেশের জন্য রয়েছে আমার আন্তরিক মঙ্গল কামনা। আমি পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে এই মোনাজাতই করি যে, তার অসীম রহমতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে শান্তি, ন্যায় বিচার, প্রগতি ও সমৃদ্ধির এক নবযুগের সূচনা হবে। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাকে সবরকমভাবে সাহায্য করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সকলকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। আমাদের দেশবাসীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর মহান প্রচেষ্টায় আমি সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করছি। জাতির প্রয়োজনে দেশের জন্য আমি যে কোনো কর্তব্য পালনে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না। পরম করুমনয় আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। খোদা হাফেজ-
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”
সামরিক আইন কোথাও কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু বিগত শতাব্দীর আশির দশকে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সামরিক আইন ছিল। ধরে নেয়া যায়, গণতন্ত্রের পথে উত্তরনের যাত্রায় এই সামরিক আইন ছিল প্রসব বেদনার মতো। সামরিক আইনের প্লাবন ধোঁয়া মাটিতে সেখানে গণতন্ত্রের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। আজকের শতাব্দীর সূচনার যাত্রায় সেই গণতন্ত্র- বৃক্ষ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে স্বস্তি ও সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে তাও বেরিয়েছে সামরিক আইনের গহ্বর থেকে। তবে ’৮২ সালের সামরিক আইন ছিল একটি ব্যতিক্রম অধ্যায়। বিশ্বের যেসব দেশে সামরিক আইন জারি হয়েছে, তার কোথাও ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা ছেড়ে বিশ্রাম কক্ষে চলে যাননি। যেখানেই সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, সেখানেই সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানকে মরতে বা বন্দিত্ব বরণ করতে হয়েছে। তারপর যিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন, তিনি সামরিক ফরমান বা সামরিক আইন জারি করেছেন। এ কারণে বাংলদেশে ’৮২ সালের সামরিক আইন জারি একটি ব্যতিক্রম ঘটনা হিসেবে অভিহিত হয়েছে। একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিই সামরিক আইন জারি করেছেন এবং তিনি সার্বিক ক্ষমতা গোটা সশস্ত্রবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করেছেন। তৎকালীন সেনা প্রধান হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেই ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন মাত্র। এখানে এক্স, ওয়াই, জেড- যিনিই থাকতেন তাকেই এই ক্ষমতা গ্রহণ করতে হতো। সুতরাং ’৮২ সালের সামরিক আইন জারির জন্য যদি অপরাধ হয়ে থাকে তার জন্য অপরাধী হবেন বিচারপতি সাত্তার। আর তখন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য যদি অপরাধ হয়ে থাকে তার জন্য অপরাধী গোটা সশস্ত্রবাহিনী, কোনো বিশেষ এক ব্যক্তি হতে পারেন না। যিনি সেনাবাহিনীর প্রধান থাকেন, তিনি ইচ্ছা করলেই সবকিছু করতে পারেন না। যেমনটি পারেননি জেনারেল শফিউল্লাহ। তিনি জাতির জনকের যেমন প্রাণ রক্ষা করতে পারেননি, আবার সেই হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা আনতেও পারেননি। এরপর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ঠিক করার চেষ্টা করেও জওয়ানদের সমর্থন না পেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, এমনকি নিজের জীবনও দিয়েছেন। সুতরাং সেনাবাহিনীর প্রধান হলেই তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেন না- আবার কেউ গ্রহণ করার চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেন না- যেমনটি পরেননি জেনারেল মঞ্জুর। বিচারপতি সাত্তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা সশস্ত্র বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছেন- সশস্ত্র বাহিনী তা গ্রহণ করেছেন। এটাই বাস্তবতা।
বলা হয়ে থাকে, জেনারেল এরশাদ বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখল করেছেন। বন্দুকের নল থেকে ফুল বের হয় না- বের হয় গুলি। এটাই ব্যতিক্রম যে, কোনো একটি গুলি ফোটা ছাড়াই ’৮২-এর পটপরিবর্তন ঘটেছে। বিচারপতি সাত্তার শিশু ছিলেন না যে, বন্দুকের ভয় দেখাতেই তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। তিনি ছিলেন বয়সে বৃদ্ধ। জীবনের সামনে তার বেশি সময়ও ছিল না। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই তিনি পার হয়ে এসেছিলেন। শেষ বয়সে জীবনের জন্য এতটুকু ভয় তার মধ্যে থাকতে পারে না। বিচারপতি সাত্তার তার মন্ত্রিসভাকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে বিএনপি আজো তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। তিনি ছিলেন বিএনপির দ্বিতীয় চেয়ারম্যান এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আজ তিনি প্রয়াত। অথচ তার দল দ্বিতীয় চেয়ারম্যানের মৃত্যুবার্ষিকী পর্যন্ত পালন করে না। বন্দুকের নল দিয়ে সবকিছু হয় না। ওটা মাও সেতুং-এর কথা- “বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।” বঙ্গবন্ধু তার প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন- “জনগণই ক্ষমতার উৎস”। সময়ের বিবর্তনে বঙ্গবন্ধুর কথাই যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। বন্দুকের নলের সাহায্যে সাময়িকভাবে কিছু পাওয়া গেলেও যেতে পারে- কিন্তু সেটা হয় ক্ষণস্থায়ী। সেদিন সেনাবাহিনী যদি বন্দুকের নলের সাহায্যে ক্ষমতা গ্রহণ করত, তাহলে তার স্থায়ীত্বকাল কোনোভাবেই নয় বছর হতে পারত না। এই নয় বছরের মধ্যে চার বছর ছিলো সামরিক শাসন, বাকি ৫ বছর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে। তাও এই চার বছর সামরিক শাসন স্থায়ী হয়েছে রাজনীতিবিদদের কারণে। কারণ ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৮৪ সালে এইচ এম এরশাদ সাধারণ নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তখন তার কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। সেদিন সব দল নির্বাচন বর্জন করায় সামরিক শাসন আরো দুই বছর স্থায়ী হয়।
সেদিন বিচারপতি সাত্তার যদি বন্দুকের নলের মুখে সামরিক আইন জারি করে থাকেন- তাহলে বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীও কী বন্দুকের নলের মুখে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন? সেদিন প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনও কী বন্দুকের নলের মুখে দেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপতিকে শপথ করিয়েছিলেন? বিচারপতি নূরুল ইসলাম কিংবা বিচারপতি হাবিবুল ইসলাম ভূঁইয়াও কি বন্দুকের নলের মুখে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন?
ক্ষমতা গ্রহণের পর জেনারেল এরশাদ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, “বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্রের ওপর অতীতে একাধিকবার হামলা এসেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী এদেশের মহান জনগণ ও দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিবার। বিগত ৩০ মে থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা জনগণের সেই সম্মিলিত প্রচেষ্টারই উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে ....৩০ মের পর থেকে আমাকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য অনেকেই অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু সে অনুরোধ আমি দৃঢ়তার সাথেই প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল নিজ স্থানে থেকেই ভালোভাবে দেশ সেবা করতে সক্ষম হবো। ......গণতন্ত্রের মহান মূল্যবোধের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধার কারণে আমি আশা করেছিলাম যে, দেশের রাজনীতিবিদগণ বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন তারা জাতির এই সংকটকালে উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন এবং দেশকে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন। ...... আমার কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না। আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক এবং সৈনিকের গর্ব নিয়েই জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই। যত দ্রুত সম্ভব সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেই আমি আবার ব্যারাকে ফিরে যেতে চাই। “......বর্তমান সামরিক শাসন কোনো সনাতন পুরাতন ধ্যান ধারণার সামরিক শাসন নয়। এ সামরিক শাসনের প্রধান উৎস হলো এদেশের নয় কোটি জনগণ। তাই এর সঙ্গে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জনগণের তাগিদে প্রবর্তিত এই নতুন ব্যবস্থার মূল ল্য হলো দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খার সঠিক প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।”
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এই ক্ষমতা গ্রহণের পর সারাদেশে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিলো সেটাকে এক বাক্যে “স্বস্তি-শান্তি, মুক্তির নীরব বিপ্লব” বলেই অভিহিত করা যায়। সামরিক শাসন জারিতে ভয়ভীতি-আতঙ্কের টু শব্দটি পর্যন্ত হয়নি। সারাদেশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে এই পরিবর্তনকে। যেমনটি হয়েছে, ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনে। ওয়ান-ইলেভেনের আনুষ্ঠানিক পরিবর্তন অনুষ্ঠানে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল বাদে সব দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তার মানে- ওই পরিবর্তনকে তারা স্বাগত জানিয়েছিলেন। ’৮২-এর পটপরিবর্তনেও একই অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতার মধ্যে। আর সে কারণেই পরবর্তিতে এইচ এম এরশাদ যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তখন দেশ বরেণ্য এবং প্রতিথযশা সর্বাধিক সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা তাঁর দলে যোগদান করেছিলেন। এটা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কট্টর সমালোচকরাও স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর মন্ত্রিপরিষদই ছিল সর্বাপেক্ষা দক্ষ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রিসভা। নিশ্চয় তাদের বন্দুকের নলের মুখে তার রাজনৈতিক দলে ভিড়ানো হয়নি।
জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম যিনি তার সামরিক শাসনে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন তিনি ছিলেন একজন বিচারপতি। সামরিক শাসন জারির তিন দিন পর বিচারপতি এফ এম আহসানউদ্দিন চৌধুরী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর জেনারেল এরশাদ যেখান থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন তা হচ্ছে- বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সামরিক সরকারের নিযুক্ত রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়িয়েছেন। এটা করা না হলে সামরিক শাসকরা একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেতেন। এরপর সহযোগিতা পাওয়া গেছে, তৎকালীন মিডিয়ার কাছ থেকে। তখন বাংলার বাণী বা দৈনিক বাংলার মতো পত্রিকা ’৮২-এর পটপরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। দৈনিক বাংলায় “সময়োচিত ব্যবস্থা” শিরোনামের বিশেষ সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে “কিছু কাল ধরে এদেশের জনমানুষের মনে গভীর হতাশা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিলো। চারিদিক দুর্নীতি, চারিদিক অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা অর্থনৈতিক দৈন্য আর খাদ্য সংকট দেশের মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছিলো। গভীর রাজনৈতিক শূন্যতায় অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছিলো গোটা জাতীয় জীবন। বোমাবাজী, ছিনতাই, আর রাহাজানি, রাজনৈতিক দলের পপুটে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের নিরাপদ অবস্থান, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য, সরকারের ব্যর্থতা, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতি এই সমাজে সৎ মানুষের জীবনকে দুর্ভোগময় করে তুলেছিলো। এমন পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থ, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব বিপদগ্রস্ত হওয়ায় দেশ প্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী বিপর্যয় মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে-”
সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পর সাংগঠনিকভাবে যারা প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছেন- তারা হলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সব জেলা ও থানা ইউনিট কমান্ড, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এই ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই সারাদেশে শান্তি, স্বস্তি ও স্থিতিশীলতার সুবাতাস বইতে শুরু করে। বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের দুই দিন পর অর্থাৎ ২৯ মার্চ তারিখ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেন, “প্রত্যেক মানুষের মতো- প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন এক একটি দুর্যোগ ও সংকটের সময় আসে- যখন সে জাতিকে কঠিন ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। বাংলাদেশী জাতির জীবনে সে মুহূর্ত এসেছিলো যখন দেশবাসী সঠিক ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি। জাতির এই প্রত্যাশা আর সিদ্ধান্তকে কার্যকর করেছেন আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী। সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। এছাড়া দেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর অন্য কোনো পথ বা উপায় ছিল না। সামরিক আইন জারি করার আগে পর্যন্ত দেশকে যেভাবে পরিচালিত করা হচ্ছিলো তা ছিলো আত্মঘাতী ও সর্বনাশা। ব্যাপক ও সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির কুটিল প্রচেষ্টা, স্বজন পোষণ, দেশের সার্বিক মঙ্গলের প্রতি দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চরম নির্লিপ্ততা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অকল্পনীয় অবনতি আমাদের প্রিয় দেশকে ঠেলে দিচ্ছিল বিলুপ্তির পথে। সারা জাতির তখন একটাই কাম্য ছিল- সেটা হচ্ছে এই শ্বাসরুদ্ধকর, নৈরাজ্যজনক অবস্থার অবসান হোক। জাতির এই ডাকে সারা দিয়েছেন আমাদের প্রিয় সশস্ত্র বাহিনী।” তিনি কুরআনের আয়াত উল্লেখ করে বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহতালা কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সাহায্য করেন না, যতক্ষণ না সে জাতি নিজের অবস্থা পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়।” নিশ্চয়ই এটা স্পষ্ট যে, ওই সময় কোনো ব্যক্তি বিশেষ ক্ষমতা গ্রহণ করেন নাই, ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন গোটা সশস্ত্র বাহিনী। এবং এই ক্ষমতাগ্রহণকারীদের সাহায্য সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন বিচারপতি, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ সকল পেশার নেতৃবৃন্দ। সুতরাং এই আইন জারির জন্য কোনো ব্যক্তি বিশেষ দায়ী হতে পারেন না।
এই আলোচনার সূত্রপাত এই কারণে যে, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী উচ্চ আদালতে বাতিল হওয়ার পর সপ্তম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল করার ধুয়া উঠেছে। সপ্তম সংশোধনীতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর সামরিক আইনের অধীনে গৃহীত কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয়া হয়েছে। আর অষ্টম সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হয়েছে। সপ্তম সংশোধনী পাস হয়েছে ’৮৬ সালে গঠিত সংসদে। সেই সংসদে প্রধান বিরোধী দল ছিল আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সপ্তম সংশোধনী বাতিল হলে, দেশের কত কিছু অবৈধ হয়ে যাবে তার হিসাব আছে কি? তখন অবৈধ বাছাই করতে গিয়ে কম্বলের লোম বাছার মতোই হয়ে যাবে- কম্বল বলতে কিছু আর থাকবে না। ’৮৬ সালের পার্লামেন্টটাই অবৈধ হয়ে যাবে। ওই সময়ে সচিবালয়ে যত কাজ হয়েছে সব অবৈধ হয়ে যাবে। তখন রাস্তা-ঘাটসহ যত স্থাপনা তৈরি হয়েছে সব ভেঙে ফেলতে হবে। কারণ যদি উন্নয়ন কাজের জন্য বা রাস্তাঘাট, পুল-কালর্ভাট নির্মাণের জন্য যদি কোনো জায়গা-জমি অধিগ্রহণ করা হয়ে থাকে এবং তার জন্য কোনো সংক্ষুদ্ধ দাবি করে বসেন, তাহলে তাকে সব ফেরত দিতে হবে। সামরিক শাসনামলে জাতীয় স্মৃতিসৌধের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা, শহীদ মিনারের নকশা অনুসারে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, মুজিবনগর স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এসবের কী হবে? উপজেলা প্রবর্তন করা হয়েছে, সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড দেয়া হয়েছে। সবই অবৈধ বলে বিবেচনা করা হবে?
সুতরাং এরশাদ-হিংসুকরা যা-ই ভাবুন না কেনো, দেশকে সুনামীর মতো অবস্থার মধ্যে ফেলে দিতে সপ্তম সংশোধনী বাতিল হতে পারে না। আর সামরিক আইন জারির জন্য ক’জনকে শাস্তি দেয়া হবে, গোটা সশস্ত্র বাহিনীকে? যে বিচারপতিরা সামরিক আইনে দেশ পরিচালনায় সাহায্য করেছেন, যারা সামরিক আইনে দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের সবাইকে? আগামীতে সামরিক আইন জারি অবৈধ হতে পারে। অতীতে যে সামরিক আইন জারি হয়েছে তা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নাও হতে পারে- কিন্তু যা হয়ে গেছে এবং সুপ্রিম কোর্ট ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক সেই আইনকে যখন বৈধতা দিয়েছেন, তখন তা বদলানোর আর কি কোনো সুযোগ আছে? আদালতের রায়ে সংবিধানের কোনো সংশোধনী যদি বাতিল করা যায়, তাহলে কোনো সংসদ কি আর কখনো কোনো সংশোধনী পাস করতে পারবে? পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর যদি সপ্তম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিলের প্রশ্ন আসে তাহলে আর সব সংশোধনী বহাল থাকবে কেনো? বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের ক্ষমতা গ্রহণ এবং তার চাকরিতে ফিরে যাওয়ার জন্য একবার সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছে। যেহেতু তার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছে, সেহেতু এটা স্পষ্ট যে, ওই বিচারপতি অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। সুতরাং ওই সংশোধনীও বাতিল করে তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। পঞ্চম আর সপ্তম সংশোধনীর মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে- পঞ্চম সংশোধনী সংবিধানের মূল নীতির ওপর আঘাত হেনেছে এবং কলঙ্কিত অধ্যায় আর হত্যার হলি খেলার বৈধতার জন্য সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু সপ্তম সংশোধনীতে সংবিধান কাটাছেড়া না করে অনিবার্য পরিস্থিতির সাংবিধানিক বৈধতা দেয়া হয়েছে।
অষ্টম সংশোধনী নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে। সোচ্চার বক্তব্য আসছে- অষ্টম সংশোধনী অর্থাৎ রাষ্ট্র ধর্ম ব্যবস্থা বহাল রেখে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণে ব্যক্তিগতভাবে আমি অষ্টম সংশোধনীর পক্ষে নই। কিন্তু এখানে ব্যক্তিগত মত আর বাস্তবতা ভিন্ন রকম। এই দেশে একই রাস্তায় ধর্মের মিছিলে সংখ্যাগরিষ্ঠরা ৯০ ভাগ জায়গা নেবেই। সংখ্যালঘুদের থাকবে ১০ ভাগ। ধর্মপ্রাণ মানুষের এই দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও বাস্তবে এই অবস্থাই থাকবে। যখন রাষ্ট্রধর্ম ছিল না, তখনও যা দেখেছি এবং এখনো যা দেখছি, তার মধ্যে মৌলিক কোনো তফাৎ নেই। বলা হচ্ছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করেছেন রাজনৈতিক কারণে। এই প্রসঙ্গে দু’একটি কথা বলতে চাই। এইচ এম এরশাদ যদি রাজনৈতিক কারণে এটা করতেন, তাহলে তার ফায়দা তুলতে পারতেন। ৯০ ভাগ মুসলমান তার প থাকত। ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তাতে এইচ এম এরশাদের দল জাতীয় পার্টি সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। দেশে অনেকগুলো ইসলামী দল রয়েছে। তারাও জাতীয় পার্টির পক্ষে নয়, তারা বিএনপির পক্ষে সুতরাং রাজনৈতিক বিবেচনায় যদি ধরা হয়, তাহলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অষ্টম সংশোধনী বিতর্কে জাতীয় পার্টির নীরব থাকাই শ্রেয়। যাদের জন্য এই সংশোধনী করা হয়েছে, দেখা যাক তারা কি বলেন। আর যদি ধর্মীয় অনুভূতি বিবেচনা করা হয়, প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত তা যার যার নিজস্ব ব্যাপার।
এখন সংশোধনী বাতিলের রব উঠেছে। তবে পঞ্চম-সপ্তম বা অষ্টম সংশোধনী মন্দ-খারাপ যাই হোক তার একটা পর্যায় আছে। এসব সংশোধনী সংসদে পাস হয়েছে। সামরিক আইনও মন্দ-খারাপ যাই হোক তারও একটা আইনগত ভিত্তি আছে। কারণ সুপ্রিম কোর্টই এই আইনের বৈধতা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের কী দশা হবে? এর তো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। এরা ক্ষমতায় এসেছে কোন ভিত্তিতে- দুই বছর থাকল কীভাবে, এই সময়ের মধ্যে যে দেশ পরিচালিত হলো- তাওবা কোন আইনের বলে, তার কী ব্যাখ্যা আছে? বলা যায়, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে কুরআনের কথা অনুসারে জাতিকেই ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হতে হবে। হয়ত সেই সচেষ্ট হওয়ার প্রেক্ষাপটেই ওয়ান-ইলেভেন এসেছে ’৮২-এর ২৪ মার্চের পটপরিবর্তনের মত। কিন্তু এখন তো তার বৈধতা দিতে হবে। তার জন্য সংশোধনী আনতে হবে। সুতরাং বিদ্যমান সংশোধনী বাতিল করে অতীতের বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করে ভবিষ্যতের পথ সুগম রাখাই শ্রেয়। সংশোধনী বাতিলের দৃষ্টান্ত স্থাপিত থাকলে ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনের বৈধতার জন্য সংশোধনী আনা হলেও ভবিষ্যতে হয়তো তা আবার অবৈধ হয়ে যাবে। আর ওয়ান ইলেভেনের যদি বৈধতা না থাকে তাহলে ২০০৮-এর নির্বাচন এবং নির্বাচনপরবর্তী সরকারও অবৈধ হয়ে যাবে। মুশকিল হলো: ক্ষমতায় থাকলে ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় আসে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ক্ষমতার মধ্যে লুকানো থাকে একটা বিশেষ ধরনের রোগের জীবাণু। এই জীবাণুতে আক্রান্ত হলে মানুষের স্বাভাবিক আচার-আচরণ বিলুপ্ত হয়, শ্রবণশক্তি লোপ পায়, চোখের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হয়, চোখের সামনে যা দেখা যায়, তার সবই হেয় মনে হয়, অতীত ভুলে যায়, ভবিষ্যতের কথা মাথায়ই আসে না এবং বর্তমানকেই শ্রেষ্ঠ সময় মনে হয়। তবে সব রোগ থাক- শুধু ভবিষ্যৎ চিন্তা মাথায় এলেই সংশোধনী বাতিলের ভুত দূর হবে বলেই বিশ্বাস করি।