আমাদের আজকের গল্পের নায়ক দবির আলী , বয়স ৭০ । জামালপুর শহরের ওভারব্রিজের নিচে সস্ত্রীক ভিক্ষা করেন ১০ বছর ধরে । তার এটা দ্বিতীয় স্ত্রী । স্ত্রী বললে ভুল হবে, ভিক্ষাসঙ্গী। তার আগের স্ত্রী অনেক আগেই মারা গিয়েছেন । এখানে আসার পর তারা একসাথে ভিক্ষা করতে করতে একসময় বিয়ে করে নিয়েছেন । দুইজন একসাথে থাকলে অনেক সুবিধা হয় । যেইবার বড় বন্যাটা হল তারপর থেকে রৌমারিতে নিজের বাপ দাদার ভিটা ছেড়ে দবির আলী এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন । অবশ্য ভিটা বলাটা ঠিক না , কারণ ভিটা থাকলেতো বলা যায় , তিনি যখন সব ছেড়ে এসেছেন তখন ভিটার কোন ছিটেফোঁটাটিও ছিল না । সেই বারের বন্যায় কুসুমগঞ্জ চরের আর সবার বাড়ি ঘরের সাথে তার দোচালা ঘরটিরও ব্রহ্মপুত্র নদে করুন মৃত্যু হয়েছে । কিন্তু এই মৃত্যুতে দবির আলী একটুও কাদেনি শুধু ব্রহ্মপুত্রের উত্তাল জলরাশির দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল । তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার খুব একটা কিছু করারও ছিল না । কারণ মানুষ হিসেবে আমরা যতই বড়াই করি না কেন , দিনশেষে আমরা সবাইযে আল্লাহর প্রতিই নির্ভরশীল সকল বিষয়ে । তিনিই হাঁসান তিনিই কাঁদান । কিন্তু দবির আলী জীবনে আর কখনো হাসতে পারবে কিনা তখন কেউ জানত না । তিনি যখন এই ওভারব্রিজের নিচে প্রথম বার এসেছিলেন তখন আশেপাশে এত দোকানপাট ছিল না । উত্তরপাশে চটের বেড়া দেওয়া একটা পানবিড়ির দোকান আর পূর্বপাশে উন্মুক্ত আকাশের নিচে তিনপাশে পায়া নড়বড়ে তিনটি বেঞ্চ ফেলা একটি লাল চায়ের দোকান । লাল চায়ের দোকান বললাম একারণে যে , তখন এখানে শুধু লাল চা ই পাওয়া যেত , যদিও এখন চারপাশে আধুনিক নির্মান সামগ্রী দিয়ে গড়ে উঠা চা স্টলগুলোতে দুধ চায়ের উপর কফি ছিটিয়ে দেওয়া চাফি সহ পাওয়া যায় ইনস্ট্যান্ট কফিও । দবির মিয়াও এখান থেকে কয়েকবার কফি কিনে খেয়েছেন । স্বাদটা মন্দ না , তার কাছে ভালই লেগেছে , কেমন যেন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খায় প্রতিবার চুমুক দেওয়ার সময় । কিন্তু প্রতিদিন খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও
সব দিনই খেতে পারে না । ঐসব দিনই খায় যেদিন তার মরিচা ধরা স্টিলের থালাতে ধাতব মুদ্রাগুলোর ছড়াছড়ি থাকে । কিন্তু সে সবগুলো মুদ্রা একসাথে থালায় রাখে না , একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রা জমা হওয়ার পর সে ওগুলো আলাদা করে তার কোমরের সাথে বাঁধা পুরাতন প্যান্ট কেটে বানানো ব্যাগটাতে রাখে । এর কারণ হল সে খেয়াল করে দেখেছে যে , থালা ভর্তি থাকলে মানুষজন তাকে ভিক্ষা না দিয়ে তার পাশের জনকে দেয় । ইনকাম বাড়ানোর জন্য একটু চালাকি আর কি । অন্যান্য পেশার মত ক্যারিয়ার এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেমন প্রতিনিয়ত বৈধ অবৈধ নানা পদক্ষেপ নিতে হয় , তেমনি তাকেও ইনকাম বাড়ানোর জন্য খুব সতর্ক থাকতে হয় । কারণ দুনিয়ার অন্যান্য জায়গার মত এখানেও তাকে প্রতিযোগীতার সম্মুখীন হতে হয় সব সময় । তার এই চালাকির বিষয়টি নিয়ে সে কখনো ভাবে নি যে , এটা ন্যায় না অন্যায় । হয়ত সে ভাবতেও চায় না । হতে পারে উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন পূরণের জন্য করা অন্যায় আর বেঁচে থাকার জন্য করা অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান । সে ঠিক করেছে আজ ইনকাম কম থাকলেও কফি খাবে কারণ তার আজ মন ভাল ।
আজ সকালে তার পাশের অন্ধ ভিক্ষুকটি তাকে বলেছে সরকার থেকে নাকি জরিপ করতে আসবে তাদের নিয়ে । দবির আলী ভাবছে এবার হয়ত একটা স্থায়ী ব্যবস্থা হবে তার জন্য । হয়ত এবার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে তার । তার এই স্বপ্ন নতুন না , বন্যায় বাড়ি ঘর ভেঙ্গে এখানে আসার পর থেকেই সে এই স্বপ্ন দেখে । অন্যান্য মানুষদের মত দবির আলীরাও স্বপ্ন দেখে তবে অন্যদের তুলনায় তাদের পার্থক্যটা হল যে , তাদের স্বপ্নগুলো একজায়গায় থমকে থাকে , কখনো বড় হয় না । স্বপ্ন পূরণ হলেতো বড় হয় , তাদেরটা যে পূরণ হয় না কখনো ।
একমাস পর ওভারব্রিজের নিচে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র , যে জায়গাটায় দবির আলী ভিক্ষা করতেন সেখানে মানুষজনের জটলা , দুর থেকে দেখে মনে হচ্ছে মারামারি লেগেছে । কাছে গিয়ে দেখা গেল ঘটনা সত্য , মারমারি ই লেগেছে ।মারমারি লেগেছে দবির আলীর বসার স্থানটি নিয়ে । যারা মারামারি করছেন তারাও এখানে ভিক্ষা করেন অনেকদিন ধরেই । দবির আলীর কথা পাশের চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করতেই দোকানী বললেন দবির আলীতো সপ্তাহখানিক হলো মারা গিয়েছেন । হয়ত হঠাৎ করে দবির আলীরা একসময় এভাবেই পৃথিবী থেকে চলে যান , কিন্তু শুধু বেঁচে থাকে তাদের স্বপ্নগুলো দবির আলীর মত অন্য কারও হয়ে যা কখনো পূরণ হয় না।
বিঃ দ্রঃ এই গল্পটি পুরোটাই কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে । কিন্তু চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও ঘটনাগুলো বাস্তব।
সাকিব
২৬শে মে, ২০১৮
রাত ৩টা ৫।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২২