একটা মাতাল রাস্তা দিয়ে গান গাইতে-গাইতে আসছে।জড়ানো কন্ঠস্বর।কথাগুলোও এলোমেলো।সুহানা নিশ্চিত,এটা তার উনি নন।তার উনি স্যুটেড-বুটেড।গান গাইলে হিন্দী গান গায়,তবে রাস্তায় নয়,বাতরুমে।
গলির মাতাল গানের তালে তালে পা ফেলছে,নাকি পা ফেলার তালে তালে গান গাইছে বোঝা যায় না।তবে গানটা হিন্দী নয় বাংলা,তা বেশ বোঝা যায়।
সুহানাদের বাড়ির তিনদিকে বস্তি।সেই সুবাদে গলি রাস্তা।রাতদিন কত লোক হাঁটে চলে কে আর অত শত খেয়াল রাখে।তবে রাতের গলি কিছুটা গোলকধাঁধার মত আকর্ষণ করে।কাছেই আদিবাসি পাড়া।আদিবাসি মেয়েরা দল বেঁধে দোকান যায়।সুর করে গান গায়।সাঁওতালি ভাষা।ভাষা না বুঝলেও সুরটা ভাল লাগে।
আদিবাসি মেয়েরা গান গাইলেই পাশের বাড়ির রহিম সাহেব নাচতে শুরু করেন।বেশ কয়েকবার দেখেছে সুহানা।এখন সে দেখছে মাতালের গান শুনে রহিমের প্রতিক্রিয়া।
সুহানাদের ঘর থেকে রহিমের বাড়ির সবকিছু দেখা যায়।অনেককিছু দেখেও না দেখার ভান করে সুহানা।এখন সে দেখছে,অন্ধকার বারান্দায় বসে সিগারেটে টান মারছেন রহিম।পাশের গলিতে কেউ গান গাইছে,সেটা তিনি খেয়াল করেও করছেন না।অতএব নাচের প্রশ্নই নেই।
গেটে কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে।ধীরপায়ে দরজার কাছে গেল সুহানা।দরজার ম্যাজিক-আইয়ে চোখ রাখল।অন্ধকার।ম্যাজিক-আই হাত দিয়ে আড়াল করে রেখেছে কেউ।বিচলিত সুহানা বলল—কে,কে ওখানে?
--আমি,চিনতে পারছো না?
--না,কে আপনি?
--যার খোঁজ-খবর নিতে তোমার সারাটা দিন কাটে,আমি সে-ই।
--আমি সারাদিন একজনেরই খোঁজ নিই,সে আমার স্বামী।
--স্বামী বলছো কেন,ওর সাথে তুমি পালিয়ে এসেছো,বিয়েও হয়নি তোমাদের।
--লোকদেখানো বিয়েতে আমরা বিশ্বাস করি না।
--তার ফল কি হয়েছে দ্যাখ,তোমার স্বামী তোমাকে নিয়ে আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে,রাতবিরেতে মদ খেয়ে ফেরে,সবদিন ফেরেও না।
--- আপনি কে,এতকিছু জানলেন কি করে?
--তুমি যেমন অন্যের খোঁজ রাখছো,এমনও তো হতে পারে,তোমারও খোঁজ রাখছে কেউ?
--না,আমার কেউ খোঁজ রাখে না,বাবা-মাই রাখে না,তা আপনি তো কোন ....
--বলো,বলো,থামলে কেন?
--বেশ আমি থামবো না,দরজা খুলে দিচ্ছি,আপনি ভেতরে আসুন,দেখি আপনি কে?
-- না,আজ আর ভেতরে যাব না,আসব অন্য একদিন।তখন কথা হবে।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।গলিতে আলো আছে,লোকটাকে নিশ্চয় দেখা যাবে।
গলিতে দাঁড়িয়ে আছেন রহিম।পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন।লাইটার জ্বালালেন।ধোঁয়া ছাড়লেন একরাশ।ইনিই কি তবে সেই লোক?এতদিন তো ওকে পাগল বলেই জানতো সুহানা,লোকটা তবে সত্যি পাগল নয়?
সুহানার খুব ইচ্ছে করছে রহিমের কাছে যেতে।কথা বলতে।আবার ভয়ও হচ্ছে তার।অচেনা,অজানা একজন মানুষ,কি ভাববেন কে জানে।ফের গলির দিকে তাকাল সুহানা,রহিম নেই।
ক’দিন ধরেই মাথাটা কেমন ঘুরছে সুহানার।খেতে-বসতে-ঘুমোতে কিছুতেই মন বসছে না।রুটিন-বাঁধা জীবন ছেড়ে অনিয়মের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যেন।আগে কত সিরিয়াল দেখতো,এখন ভাল লাগে না।
মোবাইল বাজছে।বসার ঘরে গেল সুহানা।নিশ্চয় আরিফ।বলবে,আজ আর যাচ্ছি না,তুমি কষ্ট করে একা থাক লক্ষীটি।
ঠিক তাই।মোবাইলে এমন ভাবে বলল,যেন নিজের বাড়ি নয়,হোটেল থেকে বলছে।বিচিত্র কিছু নয়।দিনদিন চলন-বলন কেমন আলাদা হয়ে যাচ্ছে আরিফের।সুহানার প্রতি ভাললাগা কি ছ-মাসেই ফুরিয়ে গেল?
মোবাইল বিছানায় ছুঁড়ে বাইরে এল সুহানা।দরজা খুলে সিড়ি দিয়ে নেমে এল নিচে।নিচের তলায় বাড়িওলা ও তার তম্বী-বউ থাকে।অন্যদিন বলে,কোথায় যাচ্ছো বউমা?
আজ কিছু বলল না। বললেও জবাব পেত না।সুহানা ঝগড়া করতে যাচ্ছে।
--হ্যালো,আপনাকে বলছি।
গলির অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন রহিম।ঘুরে দাঁড়ালেন।তাঁর মুখের ধৌঁয়া উড়ে এসে জড়িয়ে গেল সুহানার খোঁপায়। বললেন—আমাকে বলছো,বল কি সমস্যা?
--আপনি কি সমস্যার আশায় গলিতে দাঁড়ান নাকি?
মৃদু হাসলেন রহিম।বললেন—আমার নিজের সমস্যার সমাধান খুঁজে পাইনে,যাক কি বলছিলে বলো।
--আপনি কি একটু আগে আমাদের কলিংবেল বাজিয়েছিলেন?
--কই না-তো?
--তাহলে গলিতে দাঁড়িয়ে কি করছেন?
হাসলেন রহিম।সে হাসিতে যেন কষ্টের সুর।বললেন—একটু আগে একটা মাতাল গান গাইতে গাইতে গেল,কি যে চিন্তা করছিলাম,এখন আর মনে পড়ছে না।এখন বেরিয়ে দেখছি মাতালটা ফিরে আসে কিনা।
--এলে কি করবেন?
--ওকে গানটা আবার গাওয়া করাব।
--গানের তালে নাচবেন বুঝি?
--এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়।
--তাহলে পরের বাড়িতে ব্যক্তিগত বিষয় আলোচনা করতে যান কেন?একটু আগে গেছিলেন,আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
--তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে,এই গলির বাইরে কোথাও যাইনি আমি।
--আমিও কিন্তু এই গলিতে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি।
--আমি তোমার বাবার বয়সী,তোমাকে শুধু-শুধু ভয় দেখাতে যাব?
--আদিবাসী মেয়েদের গানের তালে নাচেন তো খুব?
--হুম,ওটাও আমার ব্যক্তিগত বিষয়।
--আপনাদের মত বুড়ো ভামদের আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি,বজ্জাত কোথাকার।
আরো কয়েকটি নোংরা কথা গড়গড় করে বলল সুহানা।কি-যে বলল তা তার নিজেরও খেয়াল নেই।কোন প্রতিবাদ করলেন না রহিম।চুপচাপ শুনলেন।ঝড় থামলে,নিজের বাড়ির দরজার দিকে হাঁটলেন।
একমাস পরে রহিমের দরজায় টোকা দিলো সুহানা।শীতের সকাল।মিষ্টি রোদের বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক।শুধু তার শরীরে কান্নার কম্পন।হাতের স্যুটকেশ পাহাড়ের মত ভারি মনে হচ্ছে।
দরজা খুলে সুহানাকে দেখে চমকে উঠলেন রহিম।তার ঠোঁট থেকে জ্বলন্ত সিগারেট পড়ে গেল মেঝেয়।আমতা-আমতা করে বললেন—আবার কিছু হয়েছে নাকি,আমি কিন্তু আজ বাড়ির বাইরে বের হইনি।
--হয়েছে অনেক কিছু,তারজন্যে আপনি দায়ী নন।তাই ক্ষমা চাইতে এলাম।
--না,না,ক্ষমা-টমার কি আছে,মানুষ-মানুষকে ভুল বুঝতেই পারে।
--আমার স্যুটকেসটা আপনার ঘরে রাখতে দেবেন।
--ওহ,স্যুটকেস,এসো ভেতরে এসো।
একতলা বাড়ি।ঘরের বিছানা আর বইপত্রে অযত্নের ছাপ।আগেই সেসব দেখেছে সুহানা।আজ সেইসব এত কাছে,এত স্পষ্ট,মনে হয় যেন ব্যাঙ্গ করছে।
--বসো ওই চেয়ারটায়,চা খাবে?
রহিম বারেবারে চা খান এটা সুহানা জানে।কলতলায় তাঁর স্যসপ্যান ধোয়ার কসরৎ দেখে,পাশের রান্নাঘরে ছুটোছুটি দেখে,কত হেসেছে।আজ সেগুলো কি বিদ্রুপ করছে?
বলল—না,আপনি খান,আমি এখনই একজায়গা যাব।
--ওহ হ্যাঁ, তুমি তো স্যুটকেসের কথা বলছিলে,বাবার বাড়ি যাচ্ছো বুঝি?
--সেখানে আর ফেরার পথ নাই।
--তাহলে কোথায় যাচ্ছো ?শ্বশুরবাড়ি?
--ওখানে আমাকে ঢুকতে দেবে না।
রহিমের কপালে ভাঁজ পড়ল।সিগারেট ধরিয়ে বললেন,মনে হচ্ছে কোন সমস্যা,কি ব্যপার বলো তো?
--যার সঙ্গে আমি পালিয়ে এসেছিলাম,সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।আজ বাড়িওলা বলল,সেদিন রাতের লোকটা আমার স্বামীই ছিল।আমাকে ভয় দেখিয়ে বাড়িওলার কাছে লুকিয়েছিল।
--আমারও সেদিন এমনই কিছু সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু তুমি যা কথার ঝাড়ু মারলে,সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।
ঘরের দেয়ালে টিকটিকি।উঠোনে জোড়া শালিক।দুজনের চোখের বিষণ্নতা ছুঁয়ে ফেলছে সময়।
--কুড়ি বছর আগে বউ মারা গেছে,কেউ কোন খারাপ কথা বলতে পারেনি,যাকগে সেকথা,তুমি কি থানায় যাবে?
--যাব ভাবছিলাম,জানি গিয়ে কোন লাভ হবে না,ওরা টাকা-পয়সা দিয়ে সব ম্যানেজ করে রেখেছে।তবু নিজেকে বোঝানোর জন্যে যাওয়া।
--হ্যাঁ,জীবনের অনেককিছুই আমরা নিজেকে বোঝানোর জন্যে করি।আমার কথায় ধর না,মা-মরা মেয়েকে কত কষ্ট করে মানুষ করলাম,সে-ই কিনা ছেড়ে পালালো।
--পালিয়েছে?
--হ্যাঁ,একটা আদিবাসী ছেলের সঙ্গে।
--আদিবাসী,আচ্ছা,ও যদি ফেরে,আপনি আশ্রয় দেবেন?
--হ্যাঁ দেব,এখনও প্রায় প্রতিদিন আমি বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামে যাই।মেয়ের খোঁজ করি।ওদের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করি।
--এমন বাবা পাওয়া ভাগ্যের কথা। নিজেকেই শোনাল যেন সুহানা।রহিমও শুনলেন তা।বললেন—বুড়ো ছেলেটাকে দুবেলা রেঁধে খাওয়াতে পারবি মা?
--পারব না,আমি কিছুই পারব না।বলে নিজের দুহাতে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করল সুহানা।
শালিখ-দুটির চোখ তখন সকালের রোদ প্রতিফলিত হচ্ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২৩