ছোটবেলায় গরু রচনা লেখেনি, এমন কোন মানুষ কি আছে? হু আছে, তবে কিনা তারা স্কুলেই যায়নি। বাংলা, ইংরেজী যে মিডিয়ামেই পড়ুক না কেন, গরুর উপস্থিতি থাকবেই। সে তুলনায় বিড়ালেরা অনেক বঞ্চিত;বিড়ালরা পরীক্ষার হলে খুবই গুরুত্বহীন। বাঘ গোত্রের কোন প্রাণীই আমার পছন্দ না; বিড়াল তো আরো না। কোনদিন চিন্তাও করিনাই যে এই বিড়াল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়ে এমনভাবে তার লেজ ঢুকিয়ে দেবে।
২০০৪ সালের এপ্রিল মাস। ব্যাগ বোঁচকা নিয়ে কাঁচুমাচু মুখে আমি হোস্টেলের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রুম বললাম বিলাসিতা করে। আসলে বারান্দার একপাশে হার্ডবোর্ড দিয়ে ঘিরে একটা গণরুমের মত করা হয়েছে, যাতে আমাদের ১১জনকে থাকতে হবে। সেখানে অতিকষ্টে ১১টা চৌকি ঢুকানো হয়েছে, এখন আর আমাদের ঢোকার জায়গা নেই। আমি মনে মনে রেডি, পাবলিক কান্নাকাটি শুরু করলেই আমি রিক্সা নিয়ে সোজা খালার বাসায়। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হলো সরু, মোটা, কিচকিচা- বিভিন্ন সুরের কান্না। আমি তো ব্যাগ নিয়ে সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু সিঁড়ির মাথায় আমাকে আটকে দিলো আলিম হলের ত্রাস কমলি বেড়াল। যতই তাকে আমি হুশ হাশ করি সে শক্ত মুখে দাঁত খিচিয়ে তাকিয়ে রইলো। মানে মানে আবার সেই নরকে ঢুকে পড়লাম, এবং কান্নার আওয়াজকে গানস এন্ড রোজেসের গিটার ওয়ার্ক ভেবে শুনতে লাগলাম।
কিছুদিন পরেই তো সবার সাথে হেভি দোস্তি হয়ে গেলো। কিন্তু বিড়ালের অত্যাচারে আর বাঁচি না। আমি তো বিড়াল দেখলেই চিৎকার দিয়ে পাড়া জাগাই; সুতরাং সবাই আরো বিরক্ত হয়ে গেলো। বিড়ালের জ্বালায় কোন প্যাকেট নিয়ে আসা যায় না; প্লেট যদি খালিও হয় তারপরেও এরা পিছু ছাড়ে না।হলে মোট ১২/১৫টার মত বিড়াল, তাদের লিডার হচ্ছে ভয়ংকর কমলি বিড়াল। এর মাঝে এলো সেই কালরাত্রি। সেদিন রাত দেড়টা পর্যন্ত হাতের হাড্ডি গুড্ডি ভ্যার ভ্যার করে পড়ে গিয়েছি ঘুমাতে। হঠাৎ ঘুমের মাঝেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। ঘুম ভেঙ্গে মনোযোগ দিয়ে খানিকক্ষন মশারীর ফুটা দিয়ে ছাদ দেখলাম। এরপর পাশ ফিরেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পাশের বিছানায় জ্বলজ্বলে এক জোড়া সবুজ চোখ একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ২ সেকেন্ড পরেই আমার চিল চিৎকারে সবাই হাউমাউ করে ঘুম থেকে উঠে পড়লো। কোঁকড়া (আমার এক বন্ধু) ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কে? কে আসছে?” আমি বালিশে মুখ গুঁজে ইইইইই করতে করতে জানালাম মৌসুমী বাসায় যাওয়ায় তার বিছানা আজ বিড়াল দখলে নিয়েছে। কোঁকড়ার সাথে আরো তিনজন অনেক চেষ্টা নিলো বটে, কিন্তু বদমাইস বিল্লি আমার বিছানার নিচ থেকে বের হতে তীব্র অসম্মতি জ্ঞাপন করলো।
এই ঘটনার পরে পরদিন মিটিং বসলো। সিদ্ধান্ত হলো, রুমের ঝুল ঝাড়ার লাঠিটা বিড়াল মারা লাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তিথি জানালো তার দুইটা পা হচ্ছে দুইটা লাঠি। একটা বডি গার্ড পেয়ে আমার বড় আনন্দ হলো। বিড়াল দেখলেই আমি চিৎকার দেই, “তিথিইইইইই”। সে এসে বিড়ালকে এক লাথিতে সৈয়দপুর পাঠায়। কিন্তু আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলোনা। সেদিন তিথি নাই হলে। আমি কি কাজে রুম থেকে বেরিয়েছি; বের হওয়ার সময় দরজাটায় বাইরে থেকে ছিটকিনি দিলাম। কারণ হার্ডবোর্ডের দরজা, বন্ধ হয় না এমনিতে। করিডোরের মাঝামাঝে এসেই দেখি লিডার কমলি পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি প্রথমে বললাম, “ঐ যা যা”। কমলি লেজ নাড়া দিয়ে পা ঘষতে লাগলো। “ওরে আল্লাহ রে” বলেই আমি ঘুরে দিলাম দৌড়। পিছনে কালি বিল্লি এসে উপস্থিত। দুইদিকে আটকা পড়ে বাধ্য হয়ে আমি করিডোরে রাখা টেবিলে লাফ দিয়ে উঠে “বাঁচাও, কোই মুঝে বাঁচাও” বলে চিৎকার শুরু করলাম। কোঁকড়া আমার চিৎকার শুনে লাঠিটা নিয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলো। কিন্তু দরজা তো বন্ধ। সে দরজা শুদ্ধু ঝাঁকাতে শুরু করলো। “দরজা খোল, ত্রিনিত্রিকে বিড়াল আক্রমন করছে”। বিল্লি গুলি আমাকে ছাড়লো না। তিনবার আমি কানে ধরে বললাম, “আর আমি তিথিকে দিয়ে তোদের লাথি দেয়াবো না”। তারপরেও যেতো কিনা সন্দেহ, এমন সময়ে আমার বন্ধু মৌসুমী এসে আমার জীবন বাঁচালো। এই ঘটনার পর থেকে আমি কমলিকে দেখলেই মনে মনে একটা সালাম ঠুকে দিতাম, বাবা তাও তুই আমার থেকে দূরে থাক।
৩য় বর্ষে ৩য় বারের মত আমার রুম পরিবর্তন হয়ে হলো পঞ্চম তলায়। সেই সাথে বিড়ালও পরিবর্তন হলো। আমাদের আবার প্রতি ফ্লোরে বিড়ালরা সমঝোতা করে ঠিক করে নিয়েছে কে কোন ফ্লোরে থাকবে। এর মাঝে আমার দোস্ত, যার সাথে পুরো জীবন আমি পাশাপাশি রুমে কাটালাম; সে আবার চরম পশুপ্রেমী। সে হলে বিল্লিদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। কথিত আছে, ক্লাস টেনে সে এক মা হারা গরুকে বুকে টেনে নিতে গিয়ে একটুর জন্য শিং এর গুঁতা খায়নি। সে বই পড়তে পড়তে বিল্লিদের গায়ে পা ঘসছে, এবং বিল্লিগুলা আল্লাদে ষোলখানা হচ্ছে-এ ছিলো নিত্যদিনের দৃশ্য। তার রুমমেট কুলসুম আমার দলের। তবে আমাদের দুইজনের যুদ্ধ ঘোষনায় কিচ্ছু হলো না। বিল্লি তার পেতে দেয়া বিছানায় নিয়ম করে ঘুমাতে লাগলো, এবং ক্ষোভ বশত কুলসুমের স্যান্ডেলকে টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলো। একেবারে এরিয়া ৫১ এর সতর্কতায় নিজের রুমকে রাখার ফলে কোন বিল্লি ঢুকতে পারলো না বটে, কিন্তু প্লেট নিয়ে রুম থেকে বের হলেই পিছে লাগে।কি করি? স্বপ্নে প্রতিকার পেলাম; বিল্লি পানি পছন্দ করে না। এরপর থেকে সবসময় বিড়াল পিছু লাগলেই আমি পানি ছিটিয়ে দিতাম। বিল্লি পালাতে পথ পেতো না। আমার খুশীতে দাঁত সব বের হয়ে গেলো। তবে ৪/৫ মাসের মাথায় আবার তা ভিতরে ঢুকে গেলো।
সেদিন খুব ভাব নিয়ে গাইতে গাইতে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম। দেখি আমার দরজার সামনে সাদা-কমলা বিল্লি যেন আমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে। সাথে পানির বোতল নেই, কি করি? ভেংগালাম, “যা ভাগ পাজির পা ঝাড়া”। বিল্লি এই গালি সহজভাবে নিলো না, কি কারণে যেন তীরবেগে ছুটি এলো। আমি হতভম্ব; জীবনে দেখিনি কোন বিড়ালের এরকম আচরণ। চিন্তার সময় নেই, দৌড়ে স্নানঘরে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দিলাম। একটু পর দরজা খুলে দেখি পাজি বিল্লি দরজার সামনে বসে আছে। আমি পানি নিয়ে গায়ে দিলাম কয়েকবার; প্রতিবারই ঝাড়া দিয়ে ফেলে ঐভাবেই বসে রইলো। প্রথমে বকা, এরপরে অনুনয়, কিছুতেই কাজ হলো না। আগের মত চিৎকারও দিতে পারিনা; ফ্লোর ভর্তি জুনিয়র। এরা এসে যদি দেখে তাদের সিনিয়র আপু স্নানঘরে বিল্লির ভয়ে আটকা, কেমন হবে? পাক্কা ১৫/২০ মিনিট পর আমার বিড়ালপ্রেমী বন্ধু এসে আমাকে উদ্ধার করলো তার প্রজার হাত থেকে। এরপর প্রায় ১৫ দিন আমি কোন বিড়ালের গায়ে পানি দেইনি।
এর পর এক বছর কেটে গেলো। ততদিনে বিড়ালদের সাথে আমি সাম্যাবস্থায় গিয়েছি। নীচতলার বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে চ্যাঁও ম্যাঁও করে আসি এই বলে যে আমাদের ফ্লোরের বিড়াল তোদের ফ্লোরের বিড়ালদের থেকে ভদ্র। এর মাঝে এক মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটলো। দোতলায় একটি অসামান্য সুন্দরী বিড়াল ছিলো। কি তার গায়ের রঙ, আহা। তার লেজের প্রশংসা করেনি এমন কোন মানুষ বা বিড়াল এ জগতে নেই। বিড়ালপ্রেমী দোস্তের মত, অন্য কোন দেশে তার জন্ম হলে নাকি তার দাম হতো হাজার ডলার। তার প্রেমে বাকি সব বিল্লি হাবুডুবু খেতো। আমাদের ফ্লোরের কমলা বিল্লিকে দেখতাম আরেকটা বদমাইস বিড়ালের সাথে প্রায়ই বিকেলে নীচে হাঁটতে। আমাদের ধারনা হলো এরা জিএফ-বিএফ।
একদিন রাত সাড়ে ১২টায় আমি আর নাজনীন গিয়েছি হলের ছাদে। গিয়ে দেখি রেলিং এর শেষপ্রান্তে আমাদের কমলা বিল্লি নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। হায় হায়, যদি পড়ে যায়! আমি তাড়াতাড়ি গেলাম তাড়াতে। সে আমাকে পাত্তাই দিলো না। এক দৃষ্টিতে নিচের দিকেই তাকিয়ে রইলো। আমরা ১৫ মিনিট হাঁটাহাঁটি করে এসে দেখি এখনো সে একই ভাবে আছে। ততক্ষণে নাজনীন একটু চিন্তায় পড়লো। “এ্যাই ত্রিনিত্রি, এ সুইসাইডের অ্যাটেম্প নিচ্ছে না তো?” সদ্য সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ড শেষ করার জন্য দুনিয়ার সবাইকে আমাদের তখন মানসিক রোগী মনে হয়। আমিও চিন্তায় পড়লাম। এমন গাঢ় অন্ধকার; এর মাঝে আকাশে কারণ ছাড়া বিদ্যুত চমকাচ্ছে। হু হু করে যাবতীয় ভূত প্রেত আর আত্মার গল্প আমার দুই কানের ভিতরে বাজতে লাগলো। আমি বললাম, “ওই, ভূত না তো? ভূত কিন্তু বিড়াল রুপে আসে”। কথা তখনো মুখেই আছে, নাজনীন “বলিস কি” বলেই দৌড়। আমি কি আর দাঁড়াই? “ওরে ওরে থাম আমার জন্য” বলে আমিও এক দৌড়ে কুলসুমের রুমে। তাড়াতাড়ি ঘটনা বর্ণনা করতেই বিড়াল বিশেষজ্ঞ মতামত দিলো, “আমি জানি কেন। ওর বয়ফ্রেন্ড ওরে ছ্যাঁকা দিয়ে আজকে বিকেলে দোতলার সুন্দরী বিল্লির সাথে নিচে হাঁটছে”। পরের দুইদিন কমলা কে ফ্লোরে না দেখে আমি আর কুলসুম ব্যাপক চিন্তায় পড়লাম। সুইসাইড করলো নাকি? ৩য় দিনে ভালোয় ভালোয় ফিরে এলো। আমি অবশ্য দোতলায় গিয়ে বদমাইস বিড়ালের বিরুদ্ধে নালিশ দিলাম, কিন্তু সিফাত বললো যে প্রেম এই যুগে আন্ধা না। বদমাইস বিড়াল টিপিকাল বদমাইস। তাকে লাঠি দিয়ে পিটানোও যাবে না, সে এমনই পাজি।
তবে ভালো কাহিনীও আছে। মাঝে মাঝে অপূর্ব সব বিড়াল ছানা আসতো আমাদের হলে। কি যে আদরের; দেখলেই পুষতে ইচ্ছে করে। অনেকে নিয়েও যেতো বাসায় পোষার জন্য। ছানা বিল্লিগুলোর বেশ কিছু ফটোগ্রাফি করেছিলাম, এখন বিল্লিখোঁজা দিয়েও পাচ্ছি না। ঢাকা মেডিকেলে বিড়াল অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬০০ বিড়ালকে ধরার পর আমরা মহা খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম তাদের নাকি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়া হয়; কষ্টে আমরা শেষ। রুগীদের তারা এত কষ্ট না দিলে প্রতিবাদই করে বসতাম মনে হয়। প্রায়ই দেখতাম কোন আপুর পিচ্চি বাবু হলে দেখা করতে এসে বিল্লি ছানার পিছে দৌড়াচ্ছে। কি যে অপূর্ব দৃশ্য; সে যারা দেখেছে তারাই জানে।
উৎসর্গঃ ব্লগার চানাচুর আপু।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১১ রাত ৮:০০